বিমা আইন সংশোধনের উদ্যোগ, আসতে পারে যেসব পরিবর্তন

বিমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া ও পুনর্গঠন, পারিবারিক মালিকানার আধিক্য রোধ এবং নিয়ম ভাঙলে বড় অংকের জরিমানা করার ক্ষমতা দিতে সরকার বিমা আইন ২০১০ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে।

বিদ্যমান আইনটি ১৫ বছরের পুরোনো হওয়ায় এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার পরিপূর্ণ ক্ষমতা না থাকায় এই সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে 'বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)'।

আইডিআরএর সদস্য (আইন) তানজিনা ইসমাইল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আইনের প্রয়োগক্ষমতা বাড়াতেই ব্যাপক সংশোধনের উদ্যেগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যমান আইনে যা সম্ভব নয়।'

নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির আরেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, অনেক বিমা কোম্পানির বিরুদ্ধে বিপুল অংকে দাবি পরিশোধে ব্যর্থতা ও নিয়ম না মানার নানা অভিযোগ রয়েছে। শৃঙ্খলা ফেরাতে তাই কঠোর শাস্তির বিধান যুক্ত করতে আইন সংশোধন জরুরি।

সংশোধিত বিমা আইনের খসড়া শিগগির আইডিআরএ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে, যাতে জনগণ ও অংশীজনরা এ বিষয়ে মতামত ও প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন।

আইডিআরএর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিমা দাবি নিষ্পত্তির হার ছিল মাত্র ৫৭ শতাংশ। অর্থাৎ, মোট ১৬ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকার দাবির বিপরীতে পরিশোধ হয়েছে মাত্র নয় হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা।

আর কিছু কোম্পানির পরিস্থিতি এতটাই সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে যে, চলতি বছরের মার্চে ছয়টি বিমা কোম্পানিকে দাবি নিষ্পত্তির জন্য কর্মপরিকল্পনা জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

দেশে বর্তমানে ৮২টি বিমা কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে ৩৬টি জীবন বিমা এবং ৪৬টি সাধারণ বিমা। আইডিআরএর তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ বছরে ২৬ লাখেরও বেশি বিমা পলিসি বাতিল হয়েছে।

কর্মকর্তারা জানান, খসড়া আইনে বিমা খাতে ব্যাপক পরিবর্তনের প্রস্তাব রয়েছে।

খসড়া আইনের একটি নতুন ধারা অনুযায়ী, কোনো বিমা কোম্পানি বা এর সহায়ক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের স্বার্থহানি করলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেই কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করতে পারবে।

এছাড়া, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এমন পরিচালনা পর্ষদ ভেঙেও দিতে পারবে। তবে দুই বছরের মধ্যে তা পুনর্গঠন করতে হবে।

সেইসঙ্গে মালিকানা নিয়েও আসছে কড়া সীমাবদ্ধতা। কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা পরিবারের সদস্য সরাসরি, পরোক্ষভাবে বা যৌথভাবে কোনো বিমা কোম্পানির ১০ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিক হতে পারবেন না।

জীবন বিমা এজেন্টদের কমিশনেও পরিবর্তন আসছে। খসড়া আইনে প্রথম বছরের প্রিমিয়ামের ওপর কমিশন ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব রয়েছে।

পাশাপাশি, নবায়নের ক্ষেত্রে কমিশন বাড়বে। দ্বিতীয় বছরে ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে হবে ১৫ শতাংশ। তবে, পরবর্তী বছরগুলোতে পাঁচ শতাংশ হার অপরিবর্তিত থাকবে।

খসড়া আইনে বলা হয়েছে, নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তারা যদি গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রের উপস্থিতি নেই বলে মনে করেন, তাহলে তারা বিমা কোম্পানির অফিসে প্রবেশ করে তল্লাশি চালাতে পারবেন, প্রয়োজনে তালা ভেঙে নথি জব্দ করতে পারবেন এবং পুলিশের সহায়তা নিতে পারবেন। এমনকি, দাবি নিষ্পত্তির জন্য কোম্পানির সম্পত্তি বিক্রিও করতে পারবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

কোনো কোম্পানি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে মূলধন ঘাটতি পূরণ করতে না পারলে নতুন পলিসি বিক্রি বা প্রিমিয়াম সংগ্রহে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

পাশাপাশি ১০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা এবং প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা করে দণ্ড দেওয়া যেতে পারে ঘাটতি পূরণের আগ পর্যন্ত।

খসড়া আইনে পরিচালক, শেয়ারহোল্ডার বা তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ঋণ নিতে বিমা কোম্পানির সম্পত্তি বন্ধক রাখা নিষিদ্ধ করা হচ্ছে।

এছাড়া, ১০ বছরের ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায়িক বা পেশাগত অভিজ্ঞতা ছাড়া কেউ বিমা কোম্পানির পরিচালক বা চেয়ারম্যান হতে পারবেন না। আর পরিচালকের টানা মেয়াদ সর্বোচ্চ ছয় বছর নির্ধারণ করা হয়েছে।

খসড়া আইনে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। বর্তমানে যেখানে সর্বনিম্ন জরিমানা পাঁচ লাখ টাকা, সেখানে সংশোধিত আইনে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা উভয় শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার খসড়া আইন নিয়ে মন্তব্য জানতে আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম আসলাম আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সাড়া পায়নি দ্য ডেইলি স্টার

আইডিআরএর মিডিয়া ও যোগাযোগ পরামর্শক সাইফুন্নাহার সুমি বলেন, 'ব্যাংক খাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের যেমন নিয়ন্ত্রণ আছে, বিমা খাতে আমাদের সেটা নেই। আমাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা যথেষ্ট সীমিত।'

তিনি আরও বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার ক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া বর্তমান যে সংকট সেটা দূর করা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সহসভাপতি আদিবা রহমান বলেন, '২০১০ সালে আইন প্রণয়নের পর থেকে কোনো সংশোধন হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় কিছু দিক অবশ্যই সংশোধন করা উচিত।'

তিনি বলেন, 'আইন সংশোধন এমনভাবে করতে হবে, যাতে কেউ ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারে। কারণ অতীতে আইনের অনেক অপব্যবহারের নজির রয়েছে।'

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলোকে শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতা ফিরিয়ে আনার একটি উদ্যোগ বলে মনে করেন।

তিনি বলেন, ১৯৯১ সালের ব্যাংক কোম্পানি আইনের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক একই ধরনের ক্ষমতা ভোগ করে।

'এটা ভালো উদ্যোগ। আইন সংশোধিত হয়ে এসব বিধান যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত ও প্রয়োগ করা হলে বিমাখাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে,' যোগ করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক মো. মাইন উদ্দিন বলেন, 'এই আইন কতটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে সেটাই হবে মূল বিষয়।'

Comments

The Daily Star  | English

Ishraque alleges political obstruction in DSCC mayoral appointment

Announces establishment of 'Mayor's Cell' to monitor service delivery in the city

1h ago