রিতুর চোখ ধাঁধানো গোল যেন আকাশে ছোড়া একটি বার্তা 

Ritu Porna Chakma

রবিবার ইয়াঙ্গুনে থুউন্না স্টেডিয়ামের স্কোরবোর্ড যখন ৭-০, এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে বাহরাইনকে বিধ্বস্ত করে পাওয়া বাংলাদেশের বড় জয়ে পেছনের মানবিক গল্পগুলো তখন স্বাভাবিকভাবে আড়ালে। কিন্তু বাকিসবগুলোর মধ্যে একটি গোল—তার সাহসিকতা ও অর্থবহতায়—সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে গেছে।

বাংলাদেশের দ্বিতীয় গোলটি আসে রিতু পর্ণা চাকমার দুর্দান্ত দূরপাল্লার শট থেকে। এটি কেবল একটি 'গোলাজো' (চোখ ধাঁধানো) নয়। এটি যেন ছিল আকাশে ছোড়া একটি বার্তা—একদম সেই দিনে, যেদিন তিন বছর আগে তার ছোট ভাই একটি মর্মান্তিক বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়।

ম্যাচের পর সামাজিক মাধ্যমে রিতু লেখেন, 'আজ তোর মৃত্যুবার্ষিকী। তিন বছর পার হয়ে গেল। সিজি, তোকে অনেক ভালোবাসি, অনেক মিস করি। সবাই আমার ভাইয়ের আত্মার শান্তির জন্য দোয়া করো।'

তার সেই নিখুঁত, সাহসী ও নির্ভুল শটটি যেন একইসঙ্গে ব্যক্তিগত শোক ও পেশাদার গর্বের বহিঃপ্রকাশ। যারা তার ক্যারিয়ারের পথচলা অনুসরণ করেছেন, তাদের কাছে এটি ছিল পুরোনো চেনা রিতু: সেই ফরোয়ার্ড, যে নিখুঁত সুযোগের জন্য অপেক্ষা করে না, বরং সুযোগ তৈরি করে নিজেই।

একই রকম সাহসী মনোভাব দেখা গিয়েছিল ২০২৪ সালের সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে, যেখানে তার বাম পায়ের কার্ল শটে বাংলাদেশ শিরোপা জিতে নেয় কাঠমান্ডুতে। সেই গোলই তাকে এনে দেয় টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের খেতাব। রোববারের গোলটি ছিল সেই প্রতিভার আরেকটি প্রমাণ।

রাঙামাটির প্রত্যন্ত গ্রাম মগাছড়িতে বেড়ে ওঠা রিতুর পথ ছিল অনিশ্চয়তায় ভরা—পাহাড়ের পথ পেরিয়ে এখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনে অধ্যয়নরত। প্রতিটি ধাপে তিনি নিজের স্বপ্নের সঙ্গে ভাইয়ের স্মৃতিও বয়ে নিয়ে চলেছেন।

ইয়াংগুনেও তিনি শুধু নিজের নয়, পুরো দলকেও টেনে নিয়ে গেছেন সামনে। বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্স যেমন ছিল দলগত সংহতি ও কৌশলগত নৈপুণ্যের নিদর্শন, রিতুর গোলটি তেমনি তৈরি করে দেয় আত্মবিশ্বাসী এক সুর—ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে ৩৬ ধাপ এগিয়ে থাকা বাহরাইনের বিপক্ষে সাহসী এক ঘোষণা।

পিটার বাটলারের ৩-৫-২ ছকে উইংয়ে খেলছিলেন রিতু। শুধু জায়গা তৈরি নয়, তার ছিল বিশ্বাস। তার গতিময়তা বাহরাইনকে ব্যাকফুটে ঠেলে রাখে, আর দূর থেকে শট নেওয়ার আত্মবিশ্বাস ফুটিয়ে তোলে পুরো দলের মানসিকতা।

অনেক সতীর্থের মতোই, রিতু যখন বুট পরেন, তখন প্রতিবারই নিজের জীবনের সেই পথরেখাটুকু নিয়ে নামেন মাঠে। আর সেটা বোঝা যায়। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেছিলেন, 'আমার কাছে ফুটবল মানেই জীবন। আমি স্বপ্ন দেখি একটা একাডেমি খোলার, আমার ভাইয়ের নামে। ওকে সঙ্গে রাখার এটাই আমার উপায়।'

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে এই জয়টা হয়তো অনেকের কাছে সহজ মনে হতে পারে। কিন্তু যারা জানে এই জায়গায় পৌঁছাতে কতটা সংগ্রাম করতে হয়েছে, তাদের কাছে এটি কেবল মৃদুমন্দ হাওয়া নয়—আরও বড় কিছু।

এই জয় গুরুত্বপূর্ণ বহু অর্থে—স্কোরবোর্ড, পয়েন্ট টেবিল, এবং আন্তর্জাতিক মনোযোগ—সবকিছুর বিচারে।

আর এর কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে রিতু পর্ণা চাকমা, যিনি আবারও প্রমাণ করলেন—প্রত্যেকটি গোলের পেছনে লুকিয়ে থাকে একটি গল্প। আর এই দলের পেছনে আছে এমন এক আগুন, যা কখনো নিভতে চায় না।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh rubber imports rise 33 percent FY25

Rubber imports rose 33% last fiscal year

Import reliance grows as domestic rubber supply chain faces disruption

15h ago