সুরতহাল-ময়নাতদন্ত ছাড়াই গোপালগঞ্জে নিহতদের দাফন-সৎকার, হয়নি মামলা

১৭ জুলাই ২০২৫ গোপালগঞ্জ শহরে এনসিপির সমাবেশে হামলা | ছবি: সংগৃহীত

গোপালগঞ্জে 'মার্চ টু গোপালগঞ্জ' পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে নিহত চারজনের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন-সৎকার সম্পন্ন হয়েছে।

এই ঘটনায় পুলিশ ২৫ জনকে আটক করলেও আজ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি।

ঢাকা রেঞ্জ পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) রেজাউল করিম মল্লিক সাংবাদিকদের এই তথ্য জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, 'এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে। আটক ২৫ জন গোপালগঞ্জ থানা হেফাজতে আছে। যৌথবাহিনী গতরাত ৩টার দিকে তাদের থানায় হস্তান্তর করে। বর্তমানে গোপালগঞ্জ শহরের পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।'

গতকাল এনসিপির 'মার্চ টু গোপালগঞ্জ' পদযাত্রা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে শহরে একাধিক হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এসব হামলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) ও তাদের নিষিদ্ধ ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জড়িত ছিলেন।

সংঘর্ষে কমপক্ষে চারজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক মানুষ এবং অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। ঘটনার পরপরই শহরে কারফিউ জারি করা হয়।

গোপালগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. আবু সাঈদ মোহাম্মদ ফারুক বলেন, 'সংঘর্ষে আহত মোট নয়জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় গতরাতেই তাদের ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।'

গোপালগঞ্জ শহরের একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠায় রাত কেটেছে। আজ সকালেও শহরের পরিস্থিতি ছিল থমথমে। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করে।

সিটি করপোরেশনের কর্মীদের রাস্তা থেকে ইট, বাঁশ ও কাঠ সরাতে দেখা গেছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় কিছু দোকানপাটও খোলা ছিল।

বৃহস্পতিবার গোপালগঞ্জ লঞ্চঘাট এলাকার চিত্র | ছবি: ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

এদিন বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গোপালগঞ্জ শহরের ব্যাংকপাড়া, মধ্যপাড়া, চৌরঙ্গী, মিয়াপাড়া, বেদগ্রাম, লঞ্চঘাট ও পাচুরিয়া সদর হাসপাতালের পাশে নবীনবাগসহ বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখা গেছে স্বাভাবিক দিনের চেয়ে ভিন্ন চিত্র। রাস্তায় পুরুষের সংখ্যা কম, নারীরা টুকিটাকি কেনাকাটা করছেন।

কারফিউয়ের কারণে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। পুলিশ লাইনস মোড় এলাকায় অবস্থানরত পরিবহন শ্রমিকরা বলেন, 'রাস্তায় মানুষ নেই, তাই লোকাল বাস চলছে না।'

তবে গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী দূরপাল্লার বাস চলছে।

এদিকে গোপালগঞ্জে নিহত চারজনের দাফন ও সৎকার সম্পন্ন হলেও, তাদের কারও সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়নি। হয়নি ময়নাতদন্ত।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, নিহতদের মধ্যে পোশাক ব্যবসায়ী দীপ্ত সাহাকে বুধবার রাতে পৌর শ্মশানে সৎকার এবং টাইলস মিস্ত্রির সহকারী রমজান কাজীকে (বাদ এশা) দাফন করা হয়।

বৃহস্পতিবার সকালে মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী সোহেল রানা ও ক্রোকারিজ দোকানের কর্মচারী ইমন তালুকদারকে পৌর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে, জানান তারা।

পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সদস্যরাও এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জীবিতেষ বিশ্বাস বলেন, 'চারজনের মরদেহ হাসপাতালে এসেছিল। তাদের ময়নাতদন্ত হয়নি।'

ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিকও সাংবাদিকদের এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

গোপালগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর মো. সাজেদুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হামলাকারীদের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়েছেন এবং ময়নাতদন্ত ছাড়াই তিন জনের দাফন ও একজনের সৎকার হয়েছে।'

জেলা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, নিহতদের সুরতহাল করা হয়নি এবং হাসপাতাল থেকে তাদের মৃত্যুসনদও দেওয়া হয়নি।

গোপালগঞ্জ জেলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে পুলিশের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'আনুমানিক সাড়ে ৭টার সময় উচ্ছৃঙ্খল জনতা নিহত চারজনের মরদেহ পোস্টমর্টেম (ময়নাতদন্ত) করতে না দিয়ে জেলা হাসপাতাল থেকে জোরপূর্বক নিয়ে যায়।' প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে গণমাধ্যমকে এ প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।

বিকেল সাড়ে ৬টায় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, 'গতকাল এনসিপির পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। আমরা সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছি।'

তিনি বলেন, 'চলমান কাউফিউ বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা আগামীকাল দুপুর ২টা পর্যন্ত থাকবে। তারপর তা আবার রিভিউ করা হবে।'

এটি পরিকল্পিত হামলা ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এই হামলা পরিকল্পিত ছিল না, তারপরও আমাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিল।'

'তবে আমাদের কাছে তথ্য আছে, বাইরে থেকে কিছু দুষ্কৃতকারী গোপালগঞ্জে অবস্থান করছেন। তাদের আইডেন্টিফাই করার চেষ্টা করছি। পরিস্থিতি ওয়াচ করছি,' যোগ করেন তিনি।

রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, 'যেসব দুষ্কৃতিকারী বাইরে আছে তাদের আইনের আওতায় আনবো।'

তিনি জানান, গতকালের সংঘর্ষে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্তত ১০ জন সদস্য আহত হয়েছেন।

গতকালকে হামলার ঘটনায় পুলিশ প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে কি না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'ব্যর্থ হয়েছে তা বলা যাবে না, কিন্তু কারও গাফিলতি থাকলে সেটা আমরা তদন্ত করে দেখব।'

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh Police: Designed to inflict high casualties

A closer look at police’s arms procurement records reveals the brutal truth behind the July killings; the force bought 7 times more lethal weapons than non-lethal ones in 2021-23

2h ago