ফরেনসিক অডিটে উঠে এল ৬ ইসলামি ব্যাংকের লুকানো মন্দ ঋণের তথ্য

বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণ

আন্তর্জাতিক অডিট প্রতিষ্ঠান কেপিএমজি এবং আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং পরিচালিত অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ বা সম্পদমান পর্যালোচনায় দেখা গেছে বাংলাদেশের ছয়টি শরিয়াহ-ভিত্তিক ব্যাংক চরম আর্থিক সংকটে রয়েছে। তাদের অনাদায়ী ঋণ (এনপিএল) আগের ঘোষিত তথ্যের চেয়ে চারগুণ বেশি।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় গত জানুয়ারিতে শুরু হওয়া এই পর্যালোচনায় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংকের দীর্ঘদিনের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে আসছে।

ফরেনসিক অডিটে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে যে চিত্র পাওয়া গেছে, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের সরকারি রেকর্ডের তুলনায় একেবারেই ভিন্ন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ছয়টি ব্যাংকের সম্মিলিত অনাদায়ি ঋণ (এনপিএল) ৩৫ হাজার ৪৪ কোটি টাকা বলা হলেও, আন্তর্জাতিক অডিটরদের মূল্যায়নে সেই অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকায়।

এই ব্যবধান তিনটি ব্যাংকের ক্ষেত্রে আরও স্পষ্ট। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের অনাদায়ি ঋণের হার তাদের ঘোষিত ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশের বদলে ৯৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ পাওয়া গেছে। ইউনিয়ন ব্যাংকের হার ৪৪ শতাংশের স্থলে ৯৭ দশমিক ৮০ শতাংশ, আর গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের হার ২৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯৫ শতাংশে পৌঁছেছে।

ফরেনসিক পর্যালোচনায় মূলধন ঘাটতির গুরুতর চিত্রও উঠে এসেছে। অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ (একিউআর) অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয়টি ব্যাংকের সম্মিলিত প্রভিশন (সঞ্চিতি) ঘাটতি পৌঁছেছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা।

এমন উদ্বেগজনক তথ্য প্রকাশের পর বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। গত বছরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রণীত 'ব্যাংক রেজ্যুলুশন অর্ডিন্যান্স ২০২৫'-এর অধীনে, সমস্যাগ্রস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন বা অবসায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা সম্প্রসারিত হয়েছে। এই আইনের আওতায় ছয়টির মধ্যে পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত (মার্জার) করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

তবে বিদেশি বিনিয়োগ থাকার কারণে আইসিবি ইসলামী ব্যাংককে মার্জারের পরিকল্পনার বাইরে রাখা হয়েছে।

একিউআর প্রতিবেদন অনুসারে, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয়টি ব্যাংক আমানত ১ লাখ ৬০ হাজার ৩০ কোটি টাকার বিপরীতে ১ লাখ ৯৩ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকার বিনিয়োগ বা ঋণ রেখেছিল। এই পরিসংখ্যান ব্যাংকগুলোর ব্যালান্স শিটে গুরুতর চাপের ইঙ্গিত দেয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, 'আগের সরকার আমলে এসব ব্যাংক বছরের পর বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ভুয়া ও মনগড়া তথ্য দিয়েছে।'

ইসলামী ব্যাংকগুলোর প্রকৃত আর্থিক অবস্থা প্রকাশে একিউআর ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ—মন্তব্য করেন ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী। তিনি বলেন, 'এতে বোঝা যাবে ব্যাংকগুলো স্বাধীনভাবে টিকে থাকতে পারবে কি না, নাকি সরকারকে পুঁজি সহায়তা দিয়ে সাময়িকভাবে দায়িত্ব নিয়ে পরে সেগুলোকে বেসরকারি মালিকানা বা অন্য বিনিয়োগকারীদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।'

তিনি ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের কাছ থেকে কঠোরভাবে ঋণ আদায় এবং ভবিষ্যৎ সংকট ঠেকাতে আরও শক্তিশালী তদারকি ব্যবস্থার ওপর জোর দেন। 'এ ধরনের অনিয়ম ভবিষ্যতে রোধে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন,' বলেন তিনি।

একিউআরের আওতায় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংক অডিট করে কেপিএমজি এবং এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ও আইসিবি ইসলামী ব্যাংক অডিট করে আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়াং। অডিট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অডিটের পরে তাদের প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেয়। দ্য ডেইলি স্টার সেই প্রতিবেদনগুলোর অনুলিপি পর্যালোচনা করেছে।

একীভূতকরণে শ্লথগতি

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূতকরণের লক্ষ্যে তালিকাভুক্ত পাঁচটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে। এর চারটি—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক—পূর্বতন ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলমের অধীনে ছিল।

ব্যাংক রেজ্যুলুশন অর্ডিন্যান্স ২০২৫ অনুসারে চলতি মাসে আনুষ্ঠানিক একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শুরু হলেও এক্সিম ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংককে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে মতপার্থক্যের কারণে গতি কমে গেছে।

দুটি ব্যাংকই আপত্তি তুলেছে। এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম স্বপন জানান, তাদের আর্থিক ভিত্তি অন্য চার ব্যাংকের তুলনায় বেশি শক্তিশালী, আর মার্জার ঘোষণার পর নতুন করে আমানত প্রত্যাহারের চাপ তৈরি হয়েছে।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক ও সাবেক চেয়ারম্যান মো. রেজাউল হকও একই উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ব্যাংকটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম; তাই তাদের একীভূতকরণ পরিকল্পনা থেকে বাদ দেওয়া উচিত।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সদ্য গঠিত ব্যাংক রিস্ট্রাকচারিং অ্যান্ড রেজোলিউশন ইউনিট মার্জার বাস্তবায়নে কাজ চালাচ্ছে। তবে ইউনিটের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এত বড় পরিসরের পুনর্গঠন নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রক্রিয়াটি ধীরগতিতে এগোচ্ছে।'

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মান্নান উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, 'নিয়ন্ত্রকের সিদ্ধান্ত ভালো, তবে প্রক্রিয়াটি আরও দ্রুত সম্পন্ন হওয়া দরকার।'

Comments

The Daily Star  | English
5G network services in Bangladesh

Bangladesh enters 5G era with limited rollout

Bangladesh has finally entered the 5G era, as the country’s top two mobile operators yesterday announced the limited launch of the technology, aiming to provide ultra-fast internet, low latency, improved connectivity, and support for smart services and digital innovation..Unlike previous g

1h ago