৫টি ইসলামি ব্যাংককে যে কারণে একীভূত করা উচিত না

বাংলাদেশের পাঁচটি ইসলামি ব্যাংককে একীভূত করে 'নতুন ব্যাংক' গঠনের সম্ভাবনা নিয়ে জনমনে যে সাধারণ প্রশ্নটির উদ্রেক করেছে, তা হলো—এটাই কি সবচেয়ে কার্যকর সমাধান? আমাদের ব্যাংকিং ইতিহাসে একীভূত করার উদাহরণ আছে। তবে, আমার মূল যুক্তি হলো—প্রতিটি ব্যাংককে আলাদাভাবে পুনর্গঠন করাই টেকসই ও যুক্তিযুক্ত পথ।

যতদূর মনে করতে পারি, মুক্তিযুদ্ধের পর তিনটি পাকিস্তানি ব্যাংককে একীভূত করে ১৯৭২ সালে রূপালী ব্যাংক গঠন করা হয়। সেইসময়ে আমি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কার্যালয়ে মধ্যম সারির একজন কর্মকর্তা। সেই একীভূতকরণ প্রক্রিয়া ছিল বিশৃঙ্খল, তড়িঘড়ি করে করা এবং এর জন্য কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল না।

প্রতি মার্কিন ডলার ৪ টাকা ৭৬ পয়সা হিসাবে তখন ব্যাংকের ঋণ পোর্টফোলিও ছিল প্রায় ৮০ কোটি টাকা। মোট ১৫৯টি শাখার কর্মী ছিল প্রায় দুই হাজার।

তিনটি ব্যাংকের সম্পদের কোনো কাঠামোগত মূল্যায়ন ছাড়াই একীভূত করা হয়, যার ফলে ঋণ পোর্টফোলিও অস্থির হয়ে যায়। ব্যাংক তিনটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সার্বিক মূল্যায়ন না করেই একটি কাঠামোর আওতায় নিয়ে আসা হয়। তাদের অনেকের মধ্যেই সমন্বিতভাবে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় বোঝাপড়া বা মানসিকতা ছিল না।

তিনটি ব্যাংকের কার্যপ্রণালিতে কোনো মিল ছিল না। তাদের ভিন্ন ভিন্ন কর্মনীতি ও সাংগঠনিক সংস্কৃতির কারণে একের পর এক দুর্বল সিদ্ধান্ত আসতে থাকে। যা শুরুর দিকেই রূপালী ব্যাংককে টেকসই প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

সেই স্মৃতি সামনে রেখে নতুন আরেকটি বড় একীভূতকরণের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে কিছু ভাবনা তুলে ধরতে পারি। যদি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক একীভূত হয়—তাহলে তাদের সম্মিলিত আমানতের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় এক লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা এবং বিনিয়োগ এক লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ৪৬ থেকে ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত—যার ওয়েটেড এভারেজ ৭৩ শতাংশ। এই পাঁচটি ব্যাংকের মোট এক হাজার ৪৬৫টি শাখা-উপশাখা ও ৫০০টি এজেন্ট আউটলেটে প্রায় ১৮ হাজার ৫০০ কর্মী কাজ করেন।

বর্তমানে ব্যাংকগুলো তিনটি ভিন্ন কোর ব্যাংকিং সিস্টেমে পরিচালিত হয় এবং প্রত্যেকের নিজস্ব কার্যপ্রণালী, সেবা নীতিমালা ও আর্থিক পণ্য রয়েছে। প্রতিটি ব্যাংকই শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকিং অনুসরণ করলেও তাদের ব্যাখ্যা ও কার্যপ্রণালিতে পার্থক্য রয়েছে।

দুর্বল পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করলেই একটি শক্তিশালী ব্যাংক হবে—এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। বরং এর ফলে পদ্ধতিগত ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর আরও বড় ও দুর্বল একটি প্রতিষ্ঠানে সহায়তা দেওয়ার চাপ সৃষ্টি হতে পারে।

এ ধরনের একীভূতকরণে নৈতিক ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে। নতুন ব্যাংকটি সম্পূর্ণ নতুন আইনি সত্তা হবে এবং এতে করে আগের অনিয়মের ইতিহাস মুছে যেতে পারে। এর ফলে  এক বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপন হতে পারে যে, প্রতারণা করেও কোনো ধরনের শাস্তি ছাড়াই বড় ব্যবস্থার অংশে পরিণত হওয়া যায়।

এমনকি নতুন ব্যাংকে সুশাসন ও জবাবদিহিতাও বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। এই পাঁচটি ব্যাংকেই মালিকপক্ষ অনিয়ম করেছে। প্রতারণামূলক ঋণ বিতরণ, স্বজনপ্রীতি, অসত্য প্রতিবেদন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিধি লঙ্ঘন এবং পরিচালনা পর্ষদের যোগসাজশের মাধ্যমে জালিয়াতি হয়েছে। এসব অনিয়ম প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে হয়েছে।

কাজেই একীভূতকরণের চেয়ে কার্যকর সমাধান হবে প্রতিটি ব্যাংককে কৌশলগতভাবে ও পর্যায়ক্রমে পুনর্গঠন করা। এটা শুরু করা যেতে পারে প্রতিটি ব্যাংকে 'টার্নঅ্যারাউন্ড ম্যানেজমেন্ট টিম' গঠন করে, যারা বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে কাজ করবে।

পরবর্তী ধাপে শরিয়া বোর্ড সংস্কার জরুরি। কারণ, ব্যাংকিং ও আর্থিকখাতে অভিজ্ঞতাহীন এই বোর্ডের সদস্যরা ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন নাও থাকতে পারেন।

একই সঙ্গে ফরেনসিক নিরীক্ষকদের সহযোগিতা নিয়ে আগের সব অনিয়মের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনা উচিত।

উপসংহারে বলা যায়, বড় আকারে ব্যাংক একীভূত করলে স্বল্পমেয়াদে রাজনৈতিক সুবিধা বা মুখরক্ষা হতে পারে। কিন্তু এর মাধ্যমে বাজারে অস্থিরতা, পদ্ধতিগত ব্যর্থতা ও আস্থার সংকট তৈরি হবে। তার চেয়ে বিচক্ষণ উপায় হলো, প্রতিটি ব্যাংককে স্বাধীনভাবে পুনর্গঠন করা, যেখানে তাদের বোর্ড ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সক্রিয় ভূমিকা রাখবে এবং নিজেদের কার্যক্রমের জন্য জবাবদিহি করবে।


ডিএইচ চৌধুরী, সাবেক ব্যাংকার

Comments

The Daily Star  | English

Hasina’s final days before the fall

A desire to cling to power, intolerance for dissent and failure to see the writing on the wall were what eventually unravel Sheikh Hasina’s iron-fisted rule of 15 years.

5h ago