শেখ হাসিনার পতনের শেষ দিনগুলো

ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা এবং দেয়ালের লিখন পড়তে না পারাই ছিল শেখ হাসিনার ১৫ বছরের লৌহকঠিন শাসনের পতনের মূল কারণ।

ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, অবিরাম প্রচারণা কিংবা দমন-পীড়নের কোনো কিছুই শেখ হাসিনার পতন ঠেকাতে পারেনি। এই পতন তার কয়েক দশকের পুরোনো রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যৎকে যেমন ঝুঁকিতে ফেলেছে, তেমনি লাখ লাখ কর্মীকে ঠেলে দিয়েছে অনিশ্চয়তার মুখে। এক বছর আগের এই দিনে বিক্ষুব্ধ জনতার ঢলে ভেসে গিয়েছিল তার ক্ষমতার দুর্গ, আর তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন ভারতে।

দ্য ডেইলি স্টার আওয়ামী লীগের সাতজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং ২০২৪ সালের উত্তাল দিনগুলোতে দায়িত্বে থাকা জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছে। গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনের সঙ্গে এই ব্যক্তিগত বিবরণগুলো মিলিয়ে দেখলে, ক্ষমতার শেষ দিনগুলোতে গণভবনের ভেতরে আসলে কী ঘটেছিল, তার একটি স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়।

পতনের ক্ষণগণনা

৫ আগস্ট, ২০২৪। চূড়ান্ত দিনটি শুরু হয়েছিল তীব্র নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রমতে, সকাল ৯টার দিকে হাসিনা গণভবনের নিচতলায় নেমে আসেন। তার প্রস্তুতি ছিল বঙ্গভবনে গিয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণার অনুরোধ জানানোর।

প্রায় একই সময়ে, স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) বেতারবার্তায় পুলিশের কাছে ছাড়পত্র চেয়ে বলে: 'ভিক্টর-২, ভিক্টর-১-এর সঙ্গে দেখা করতে বঙ্গভবন যাবেন'। পুলিশের কোড অনুযায়ী, ভিক্টর-১ ও ভিক্টর-২ বলতে যথাক্রমে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে বোঝানো হয়।

পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে হাসিনার যাওয়ার পথ পরিষ্কার করে দেয়। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে, পুলিশের ছাড়পত্র পাওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যেই একজন ভিভিআইপির যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে ৪০ মিনিট পেরিয়ে গেলেও তেমন কোনো নড়াচড়া দেখা যায়নি।

এরপর পুলিশের ওয়্যারলেসে একটি বার্তা আসে, 'ভিক্টর-২ এখন যাবেন না। পরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে জানানো হবে।'

সূত্রমতে, ওই ৪০ মিনিটে গণভবনের নিচতলায় অবস্থানরত নিরাপত্তা বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা শেখ হাসিনাকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণার কোনো প্রয়োজন নেই। তাদের আশ্বাসে হাসিনা গণভবনের দোতলায় ফিরে যান।

এদিকে, জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার জন্য তখন গণভবনে প্রস্তুতি চলছিল। একটি স্ক্রিপ্ট তৈরি করার কথা থাকলেও পরে তিনি উপস্থিত বক্তৃতার সিদ্ধান্ত নেন। বিটিভির একটি রেকর্ডিং ইউনিটকেও ডাকা হয়েছিল।

সূত্র অনুযায়ী, হাসিনার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত কর্মীকে সেদিন গণভবনে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। তাদের গণভবনের মূল সভাকক্ষের পাশের 'কল-অন' রুমে অপেক্ষা করতে বলা হয়।

অন্যদিকে, উত্তরা থেকে 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচির একটি বিশাল মিছিল কোনো বাধা ছাড়াই শহরে প্রবেশ করে। এই খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে রাস্তায় জনতার ঢল নামে।

৫ আগস্টের 'মার্চ টু ঢাকা' ঠেকাতে ৪ আগস্ট রাত থেকেই রাজধানীজুড়ে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের মোতায়েন করা হয়। কিন্তু জনস্রোতের মুখে তাদের অধিকাংশই পিছু হটে।

সকাল ১১টার দিকে পুলিশ শেষবারের মতো 'মার্চ টু ঢাকা' ব্যর্থ করার চেষ্টা করে। প্রায় দুইশ সশস্ত্র পুলিশের একটি দল কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সাবেক প্রধান মো. আসাদুজ্জামান এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদের নেতৃত্বে কাকলী মোড়ে পৌঁছায়।

মোড়ে পৌঁছে হারুন ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার রিফাত রহমান শামীমের কাছে আরও পুলিশ চেয়ে ওয়্যারলেসে অনুরোধ করেন, কিন্তু কোনো সাড়া পাননি। বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশ সদর দপ্তরে পিছু হটতে বাধ্য হয়।

ততক্ষণে অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকেই ওয়্যারলেসে পাওয়া যাচ্ছিল না। পুলিশ সদর দপ্তরে অবস্থানরত শীর্ষ কর্মকর্তারা বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে ছিলেন অন্ধকারে।

এক পর্যায়ে, শীর্ষ কর্মকর্তাদের সদর দপ্তরের ছাদের হেলিপ্যাড থেকে দুটি হেলিকপ্টারে করে সেনানিবাসে সরিয়ে নেওয়া হয়।

প্রথম হেলিকপ্টারে ছিলেন তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) প্রধান মনিরুল ইসলাম, অতিরিক্ত আইজি লুৎফুল কবির, উপমহাপরিদর্শক (প্রশাসন) আমিনুল ইসলাম এবং ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ অন্যরা। দ্বিতীয় হেলিকপ্টারে ছিলেন অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (পুলিশ সদর দপ্তর) প্রলয় জোয়ারদার, সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান এবং উপমহাপরিদর্শক আমেনা বেগম।

সূত্রানুযায়ী, সকাল ১১টার দিকে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা হাসিনাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে এবং তাকে অবিলম্বে গণভবন ত্যাগ করতে হবে। নিরাপত্তা বাহিনীর নেতারা তাকে এও জানান যে, তারা বিক্ষোভকারীদের তার বাসভবনে পৌঁছানো থেকে আটকাতে পারবেন না।

তবে সূত্র জানায়, হাসিনা তাদের পরামর্শ মানতে অস্বীকৃতি জানান এবং শেষ মুহূর্তে তিনি তার পৈতৃক বাড়ি টুঙ্গিপাড়ায় যাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু নিরাপত্তার কথা বলে কর্মকর্তারা তাকে সেনানিবাসে স্থানান্তরের জন্য জোর দেন।

জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের দলও একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে, যিনি ৫ আগস্ট ব্যক্তিগতভাবে হাসিনাকে ফোন করে জানিয়েছিলেন যে পরিস্থিতি পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোচ্ছে না।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সকালের দিকে সেনাপ্রধান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে জানান যে, সেনাবাহিনী বিক্ষোভকারীদের তার বাসভবনে পৌঁছানো থেকে আটকাতে পারবে না।

দুপুর দেড়টার দিকে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে বহনকারী গাড়িগুলো গণভবনের লেক রোড গেট দিয়ে বেরিয়ে পুরোনো বাণিজ্য মেলার মাঠের দিকে যায়। সেখান থেকে তারা হেলিকপ্টারে করে কুর্মিটোলার বিমানবাহিনী ঘাঁটিতে যান। এরপর তারা যশোর সীমান্তের ওপর দিয়ে কলকাতা হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন এবং স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ৩৬ মিনিটে নয়াদিল্লির কাছে গাজিয়াবাদের হিন্দন বিমান ঘাঁটিতে অবতরণ করেন।

গণভবন ছাড়ার সময় সেখানে উপস্থিত দলীয় সদস্য ও ব্যক্তিগত কর্মীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। শেখ হাসিনা তাদের শান্ত থাকতে এবং নিরাপদে আশ্রয় নিতে বলেন বলে জানা যায়।

পতনের প্রেক্ষাপট

১৪ জুলাই সন্ধ্যায় গণভবনে চীন সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন শেখ হাসিনা।

একপর্যায়ে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা না পেলে, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে? আমার প্রশ্ন দেশবাসীর কাছে। রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে, মুক্তিযোদ্ধারা পাবে না? অপরাধটা কী?'

তার বক্তব্যের এই অংশটুকু ক্ষুব্ধ করে তোলে আন্দোলনকারী, তথা সাধারণ শিক্ষার্থীদের।

১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় ফুঁসে ছিল সাধারণ মানুষ। চব্বিশের ১৬ জুলাই মঙ্গলবার সেই ক্ষোভের প্রতিফলন দেখা যায় রাজপথে।

এদিন রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের বুলেটে নিহত শিক্ষার্থী আবু সাঈদের দুই হাত প্রসারিত সেই ছবি ছড়িয়ে পড়লে মানুষ দলে দলে রাস্তায় নেমে আসতে থাকে। আন্দোলন হয়ে ওঠে সর্বব্যাপী।

সেই ঘটনা এমন এক প্লাবন তৈরি করে, যা মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

১৮ জুলাই

১৮ জুলাই রক্তপাত তীব্রতর হয়। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনজুড়ে মাঠে থাকা একজন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ১৮ জুলাই সকাল ৮টার দিকে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের কাছ থেকে মাঠপর্যায়ের পুলিশের কাছে একটি নির্দেশনা আসে, যেখানে বলা হয়, 'নিজেদের জীবন বাঁচাতে যা ব্যবহার করা দরকার, তা-ই ব্যবহার করুন'।

শেখ হাসিনা ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর মধ্যে হওয়া একটি ফোনালাপের রেকর্ড তদন্ত সংস্থাগুলোর কাছে রয়েছে।

দ্য ডেইলি স্টার সম্পূর্ণ রেকর্ডিংটি শুনলেও ফরেনসিকভাবে এর সত্যতা যাচাই করতে পারেনি।

অভিযোগ অনুযায়ী, ফোন কলটি ইনু করেছিলেন এবং অপর প্রান্তে ছিলেন শেখ হাসিনা। কলার প্রথমে বিক্ষোভ মোকাবেলায় সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করেন এবং এরপর যাত্রাবাড়ী ও শনির আখড়ার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

অপর প্রান্ত থেকে বলা হয় হেলিকপ্টারে করে অতিরিক্ত বাহিনী পাঠাচ্ছেন এবং তারা 'হেলিকপ্টার থেকে ওই এলাকায় বোমা ফেলবে'।

কলার আরও বলেন যে বিক্ষোভকারীরা পরিচিত রাজনৈতিক কর্মী এবং বলেন, 'আমি আমার এলাকার বিরোধীদলীয় কর্মীদের তালিকা করে ফেলেছি। আমি কুষ্টিয়ার সব পুরুষকে তুলে আনতে বলেছি'।

অপর প্রান্ত থেকে তাকে অভিনন্দন জানানো হয় এবং বলা হয়, আওয়ামী লীগের কর্মীরা নিজ নিজ এলাকায় বিরোধী কর্মীদের খুঁজে বের করবে।

কলার এতে সম্মত হন এবং বলেন যে সকল বিএনপি ও জামায়াত কর্মীকে চিহ্নিত করে আটক করা উচিত।

১৮ জুলাই সন্ধ্যায় হাসিনা ও তৎকালীন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের মধ্যে একটি ফোনালাপ হয়। দ্য ডেইলি স্টার আগের প্রতিবেদনে সেই ফোনালাপের বিষয়বস্তু প্রকাশ করে এবং ফরেনসিকভাবে এর সত্যতা যাচাই করে।

এই ঘটনার মাত্র নয়দিন আগে—২০২৪ সালের ১৮ জুলাই রাতে—প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে একটি ফোনকল আসে। রিসিভ করেন হাসিনা। অপর প্রান্তে ছিলেন তৎকালীন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। সেই আলাপন ছিল এক ভয়ানক পরিকল্পনার ইঙ্গিত।

ভাতিজা তাপসকে হাসিনা বলেন, 'এখন তো আমরা অন্যভাবে করছি। ড্রোন দিয়ে ছবি নিচ্ছি, হেলিকপ্টার কয়েক জায়গায়…।'

তাপস বারবার গণগ্রেপ্তারের ওপর জোর দিতে থাকলে হাসিনা বলেন, 'সবগুলোকে অ্যারেস্ট করতে বলেছি রাত্রে। ওটা বলা হয়ে গেছে।'

১৮ জুলাই রাত থেকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসভবনে প্রতিদিন রাতে একটি 'কোর কমিটি'র বৈঠক হতো। তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার (ডিএমপি) হারুন, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, এডিসি (তেজগাঁও বিভাগ) হাফিজ আল ফারুক, অতিরিক্ত এসপি (ঢাকা জেলা) আবদুল্লাহ হেল কাফি, সৈয়দ নুরুল ইসলাম (ডিআইজি) (ঢাকা রেঞ্জ) সহ আরও অনেকে কামালের বাসভবনে প্রতি রাতে ওই অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে যোগ দিতেন এবং সেই বৈঠকগুলোতেই পরের দিনের করণীয় ঠিক করা হতো।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে একজন অংশগ্রহণকারীর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিজিবি কমান্ডারকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

১৯ জুলাই

সেদিন হাসিনা ১৪ দলীয় জোটের বৈঠক ডাকেন। তাদের অপেক্ষায় রেখে তিনি প্রথমে পাশের একটি কক্ষে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন।

কারফিউ জারি এবং বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেই বৈঠকে হাসিনা নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বিক্ষোভকারীদের হত্যা করে অস্থিরতা দমনের নির্দেশ দেন এবং নির্দিষ্টভাবে দাবি করেন তারা যেন 'বিক্ষোভের হোতাদের গ্রেপ্তার করে, হত্যা করে এবং তাদের লাশ গুম করে ফেলে'।

এরপর তিনি ১৪ দলীয় জোটকে তার কঠোর সিদ্ধান্তের কথা জানান।

বৈঠকের পর, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে 'দেখামাত্র গুলি' করার আদেশ দেওয়া হয়েছে।

২০-২১ জুলাই

শেখ হাসিনার শাসনামলের শেষ দিনগুলোতে গণভবনে অবস্থানকরা একজন আওয়ামী লীগ নেতা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ২০ জুলাই কারফিউ জারি এবং সেনাবাহিনী মোতায়েনের পর দলের কার্যক্রম ধীরে ধীরে কমে আসে এবং শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ দুর্বল হতে শুরু করে।

এই সংবাদপত্রের হাতে আসা গণভবনের নথি অনুযায়ী, হাসিনা তখন সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব কষছিলেন।

২৭ জুলাই

হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও হাসিনা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি ছিলেন না।

সূত্র অনুযায়ী, জ্যেষ্ঠ গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং কিছু দলীয় নেতা তাকে পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংলাপ শুরু করার জন্য অনুরোধ করেন।

কিন্তু হাসিনা সেই পরামর্শ নাকচ করে দেন বলে জানা যায়। তিনি নিরাপত্তা বাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

২৯ জুলাই

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য ২৯ জুলাই হাসিনা তার ১৪ দলীয় মিত্রদের সঙ্গে একটি বৈঠক ডাকেন।

বৈঠকে জোটের নেতারা ওবায়দুল কাদেরকে 'দেখামাত্র গুলি'র আদেশ দেওয়ার জন্য তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেন। তারা দাবি করেন, ১৯ জুলাইয়ের একটি বৈঠক থেকে বেরিয়ে কাদের এই ঘোষণা দেন, যদিও এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

তারা তৎকালীন ডিবি প্রধান হারুনকেও ছাত্র সমন্বয়কদের আটক করা এবং তার পরবর্তী ঘটনাক্রমের জন্য সমালোচনা করেন।

১৪ দলের নেতারা অভিযোগ করেন যে কাদেরের নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পুলিশ বেপরোয়াভাবে গুলি চালাতে শুরু করেছে।

হাসিনা হস্তক্ষেপ করে দাবি করেন, এই বিক্ষোভ সাধারণ শিক্ষার্থীদের নয়, বরং জামায়াতে ইসলামী ও শিবিরের।

তার এই মন্তব্যের পর, একজন জোট নেতা বলে ওঠেন, 'তাহলে আপনি জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করছেন না কেন?' অন্য নেতারাও তার দাবির প্রতি সমর্থন জানান।

বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়।

এর পর, কাদের ১ আগস্ট প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে 'দেখামাত্র গুলি'র কোনো আদেশ ছিল না। আটক ছয়জন সমন্বয়ককে মুক্তি দেওয়া হয় এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয়।

২ আগস্ট

গভীর রাতে হাসিনা পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য একদল জ্যেষ্ঠ নেতাকে গণভবনে ডাকেন। ওই বৈঠকে থাকা একজন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, সেদিন নেতারা একমত হন যে এই অস্থিরতা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন এবং এটি সামাল দেওয়া সহজ হবে না।

ওবায়দুল কাদেরের ওপর তিনি অসন্তুষ্ট ছিলেন বলে জানা যায়। সেদিন হাসিনা কাদেরকে দলের ধানমন্ডি ৩ নম্বর রোডের কার্যালয়ে যেতে নিষেধ করেন এবং তাকে দলের মুখপাত্রের পদ থেকে সরিয়ে দেন। তার পরিবর্তে তিনি প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানককে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার দায়িত্ব দেন।

৩ আগস্ট

হাসিনা বুঝতে পারেন যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

সারা দেশে বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর প্রথমবারের মতো নমনীয় হয়ে হাসিনা শিক্ষার্থীদের তার সরকারি বাসভবনে বৈঠকের জন্য আমন্ত্রণ জানান।

তাকে বলতে শোনা যায়, 'গণভবনের দরজা তোমাদের জন্য খোলা। আমি আন্দোলনকারীদের কথা শুনতে চাই। আমি সংঘাত চাই না।' টিভি ক্যামেরার সামনে তিনি তখন পর্যন্ত নিহতদের জন্য ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি দেন।

ছাত্রনেতা নাহিদ ইসলাম শেখ হাসিনার এই আহ্বানের জবাবে ফেসবুকে লেখেন, খুনি সরকারের কাছে আর ন্যায়বিচার চাওয়ার কোনো মানে হয় না, এবং আলোচনায় বসারও কোনো বিকল্প নেই। ক্ষমা চাওয়ার সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে।

সেই দিনই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ঐতিহাসিক সমাবেশ থেকে হাসিনার পদত্যাগের একদফা ঘোষণা করা হয়।

পরে সেদিন সন্ধ্যায়, হাসিনা সাবেক তথ্যমন্ত্রী এম এ আরাফাত এবং সালমান এফ রহমানের সঙ্গে প্রতিটি জেলায় সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণা শুরু করার বিষয়ে আলোচনা করার জন্য রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। তার পরিকল্পনা ছিল সারা দেশে সাইবার স্পেসে আওয়ামী লীগের প্রচারণা চালানো এবং সরকারের জন্য ডিজিটাল সমর্থন জোগাড় করা।

৪ আগস্ট

সূত্রমতে, হাসিনা দিনটি বিক্ষোভকারীদের ওপর আরও কঠোর হওয়ার বিভিন্ন উপায় খুঁজে বের করতে এবং সম্মানজনক প্রস্থানের পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করে কাটিয়েছেন।

তদন্ত সংস্থাগুলোর কাছে হাসিনা এবং এখনো পরিচয় নিশ্চিত না হওয়া আরেকজন আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তার মধ্যে হওয়া একটি ফোনালাপের রেকর্ড রয়েছে।

কথোপকথনে, হাসিনা এই বলে অভিযোগ করেন যে ঢাকার উত্তরায়, মিরপুর ১০-এ এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে।

তবে করণীয় নিয়ে তিনি স্পষ্টভাবে কিছু বলেননি।

অপর প্রান্ত থেকে উত্তর আসে যে তিনি বুঝতে পেরেছেন।

কলার বলতে থাকেন, 'যখন তাদের তাড়া করা হবে, তারা অলিগলিতে লুকানোর চেষ্টা করবে। তাদের খুঁজে বের করুন, এবং এইবার আপনারা কোনো দয়া দেখাবেন না (এইবার আর কোনো কথা নাই)। সরাসরি…'।

এবারও কলার স্পষ্টভাবে তিনি কী করতে চান তা বলেননি, কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে ইতিবাচক উত্তর আসে।

জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন এবং দ্য ডেইলি স্টারের নিজস্ব সূত্রমতে, ৪ আগস্ট সকালে হাসিনা একটি উচ্চ পর্যায়ের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন, যেখানে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, ডিজিএফআই, এনএসআই প্রধানদের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র ও শিক্ষামন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন।

'ঢাকা চলো' কর্মসূচি ঠেকাতে কারফিউ জোরদার করা হবে কিনা সেটাই ছিল বৈঠকের মূল বিষয়।

বৈঠক সম্পর্কে অবগত একটি সূত্র দাবি করেছে, ৪ আগস্ট রাতে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা হাসিনাকে পদত্যাগ করার জন্য বোঝানোর চেষ্টা করেন। তিনি তাদের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন এবং ৫ আগস্ট সকাল থেকে আরও কঠোর কারফিউ জারির নির্দেশ দেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) অনুসন্ধানেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। প্রসিকিউটরদের পক্ষ থেকে আইসিটিতে জমা দেওয়া হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগের একটি নথিতে বলা হয়েছে, তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন। জবাবে তিনি ক্ষুব্ধ হন এবং বলেন যে তিনি কোনো অবস্থাতেই পদত্যাগ করবেন না।

তবে, বৈঠকে উপস্থিত সাবেক পুলিশ আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আইসিটিতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দাবি করেন যে পদত্যাগ নিয়ে কোনো কথা হয়নি।

মামুন বলেন, আমরা সরকারকে সঠিক তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু তারা তাদের দুর্বলতার কথা শুনতে প্রস্তুত ছিল না।

গণভবনের ভেতরে আরেকটি বৈঠকে, হাসিনার বড় ভাই শেখ কামালের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সারা দেশ থেকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ঢাকায় আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

১ আগস্টের জন্যেও একই ধরনের একটি সমাবেশের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, কিন্তু দলীয় নেতা ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের পরামর্শে তা স্থগিত করা হয়। তারা বলেছিলেন এ ধরনের সমাবেশ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে।

পরিস্থিতি অনুকূলে আনার চেষ্টায়, ৪ আগস্টের বৈঠকেও একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পেছনে জনসমর্থন দেখাতে সারা দেশ থেকে দলীয় কর্মীদের ঢাকায় আনার কথা আলোচনা হয় সেদিন।

কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনী আবারও সেই পরিকল্পনার বিরোধিতা করে জানায়, কারফিউকে সম্মান করা উচিত এবং ক্যাডারদের কাজে লাগালে আরও রক্তপাত হবে। পরে দলের পক্ষ থেকে স্থানীয় নেতাদেরকে নিজ নিজ এলাকায় থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয় বলে সূত্র জানায়।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন এবং দ্য ডেইলি স্টারের নিজস্ব সূত্র অনুসারে, সেদিন সন্ধ্যায় গণভবনে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের পাশাপাশি পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে একটি ফলো-আপ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

সাবেক আইজিপি মামুন তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, হাসিনার বোন শেখ রেহানা, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালও সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং বৈঠকটি ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট স্থায়ী হয়েছিল।

বৈঠকে উপস্থিত দ্য ডেইলি স্টারের সূত্র জানায়, নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতিনিধিরা বলেন যে তারা যে কোনো মূল্যে 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি ঠেকানো নিশ্চিত করবেন।

সন্ধ্যায় প্রাথমিক বৈঠকের পর, কর্মকর্তারা গণভবন ত্যাগ করে সেনাবাহিনীর কন্ট্রোল রুমে চলে যান।

আমাদের সূত্র এবং সাবেক আইজিপি মামুনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি অনুযায়ী, কন্ট্রোল রুমের ভেতরে মামুন, স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুজিবুর রহমান, র‍্যাব, ডিবি, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রধান এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হাবিবুর রহমান আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মোতায়েনের খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা করেন।

একটি সূত্র জানায়, যেহেতু নিরাপত্তা বাহিনী দায়িত্ব নিয়েছিল, ডিএমপি কমিশনার পুলিশ মোতায়েন নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় সীমাবদ্ধ রাখার এবং ৫ আগস্টের জন্য একটি রোস্টার-ভিত্তিক পদ্ধতিতে যাওয়ার আদেশ দেন। এরপর আর কোনো কেন্দ্রীয় নির্দেশনা জারি করা হয়নি।

বৈঠক মধ্যরাতের পর শেষ হয়। এর ১২ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটে এবং শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।

Comments

The Daily Star  | English

July Declaration grants constitutional recognition to 2024 Mass Uprising

Declaration will be incorporated into the preamble of the Constitution and appended to the schedule of the nation's supreme law

24m ago