গ্রাউন্ডেড উড়োজাহাজে বিপর্যস্ত বিমানের সময়সূচি, নিরাপত্তা-রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন

biman_bangladesh_airlines.jpg
ছবি: স্টার ফাইল ফটো

একের পর এক কারিগরি ত্রুটির কারণে জাতীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইনস বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত এক মাসে অন্তত ১০টি ঘটনায় বিমানের বোয়িং ও ডিএইচসি ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজ উড্ডয়নের আগে বা পরে কারিগরি সমস্যার মুখে পড়েছে।

বর্তমানে উড়োজাহাজ সংস্থাটির ১০টি বড় উড়োজাহাজের মধ্যে অন্তত চারটি গ্রাউন্ডেড অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি বোয়িং ৭৮৭ এবং একটি বোয়িং ৭৭৭।

বিমানের এক শীর্ষ কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিমানের ফ্লাইট সূচি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। যার কারণে একাধিক সেবায় প্রভাব পড়ছে এবং কার্যক্রম ও যাত্রীসেবার খরচ বাড়ছে।'

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের এক সিনিয়র পাইলট বলেন, 'বিমানের ফ্লাইট সূচি প্রায় ভেঙে পড়েছে। সেবায় বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। উড়োজাহাজ পাওয়া যাবে কি না, সেটা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় আমরা সঠিক ফ্লাইট সূচি তৈরি করতে পারছি না।'

বর্তমানে বিমানের বহরে রয়েছে ছয়টি বোয়িং ৭৮৭, চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ইআর, চারটি বোয়িং ৭৩৭ এবং পাঁচটি ড্যাশ-৮কিউ৪০০।

উড়োজাহাজ সংকটের কারণে ঢাকা–কুয়েত ও ঢাকা–চট্টগ্রাম–দুবাই রুটের ফ্লাইট গতকাল ২৪ ঘণ্টা পিছিয়ে দিতে হয়েছে বলে জানান বিমানের মুখপাত্র এবিএম রওশন কবির।

বিমানের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এয়ারলাইনসটি ২১টি আন্তর্জাতিক ও সাতটি অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।

বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো এয়ারলাইনসে কারিগরি সমস্যা স্বাভাবিক। কিন্তু, সমস্যার পুনরাবৃত্তির কারণে বিমানের নিরাপত্তা মান ও রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

বিমানের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ দিনে আবুধাবি, ব্যাংকক, দাম্মাম, সিঙ্গাপুর ও কুয়ালালামপুরগামী একাধিক আন্তর্জাতিক ফ্লাইট মাঝ আকাশে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। একটি উড়োজাহাজের শৌচাগারে ত্রুটির কারণে ফিরে আসতে বাধ্য হয়।

অভিযোগ উঠেছে, বিমানে কর্মরত প্রকৌশলীরা ঠিকভাবে তাদের কাজ করছেন না। একাধিক সূত্র এই সংকটের জন্য নির্ধারিত 'চেক' ও 'সার্ভিসিং' ঠিকভাবে সম্পন্ন না করা, অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর অভাব এবং যন্ত্রাংশের সংকটকে দায়ী করেছে।

তবে বিমানের এক কর্মকর্তা জানান, জনবল সংকটের কারণে প্রকৌশল ও রক্ষণাবেক্ষণ শাখার কর্মীরা অতিরিক্ত চাপে ক্লান্ত। এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ চলতি মাসের ঘটনাগুলো নিয়ে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কোনো উড়োজাহাজ উড্ডয়নের আগে প্রযুক্তিগত পরিদর্শন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

গত ১০ আগস্ট ফ্ল্যাপের ত্রুটির কারণে একটি বোয়িং ৭৮৭ রোমের লিওনার্দো দা ভিঞ্চি বিমানবন্দরে গ্রাউন্ডেড হয়। বিকল্প কোনো ফ্লাইট না থাকায় ২৬২ জন যাত্রীকে বিমানের খরচে হোটেলে রাখা হয়।

পরদিন ১১ আগস্ট চট্টগ্রামগামী এক ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজে কেবিনের তাপমাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় উড্ডয়নের ২০ মিনিট পর ঢাকায় ফিরে আসে। পরে যাত্রীদের আরেকটি উড়োজাহাজে চট্টগ্রামে পাঠানো হয়।

গত ৬ আগস্ট ব্যাংককগামী একটি বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজের একটি ইঞ্জিনে অতিরিক্ত কম্পন শনাক্ত হওয়ায় মিয়ানমারের আকাশসীমা থেকে ফিরে আসে।

৭ আগস্ট তিনটি শৌচাগারের ত্রুটির কারণে আবুধাবিগামী একটি বোয়িং উড়োজাহাজ এক ঘণ্টা পর ঢাকায় ফিরে আসে।

৯ আগস্ট সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর একটি বোয়িং উড়োজাহাজ কারিগরি সমস্যার মুখে পড়ে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের এক সিনিয়র পাইলট জানান, ২০১০ সালে ভাড়ায় আনা দুটি বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ সম্প্রতি বিমানের হ্যাঙ্গারে 'ডি-চেক' সম্পন্ন হওয়ার পরও প্রায়ই কারিগরি সমস্যায় পড়ছে।

তিনি বলেন, 'দায়িত্বপ্রাপ্ত পাইলটরা এই দুটি উড়োজাহাজের ১৩ থেকে ১৪টি সমস্যা প্রকৌশল বিভাগে জানিয়েছেন। কর্মকর্তারা সমস্যাগুলো সমাধানের কথা বললেও মেরামতের পরদিনই দুটি ফ্লাইট ইঞ্জিনের অতিরিক্ত কম্পনের কারণে ঢাকায় ফিরতে বাধ্য হয়েছে।'

বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ ও বিমানের সাবেক বোর্ড সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম সতর্ক করে বলেন, 'এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে বিপর্যয়ের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।'

তিনি আরও বলেন, 'যে সময়ে বিমানের সুনাম ফেরানো দরকার, তখন উল্টো এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে যাত্রীদের আস্থা নষ্ট হচ্ছে।'

বিমানের তথ্যমতে, ১৬ জুলাই একটি বোয়িং ৭৮৭-৯ চাকার ত্রুটির কারণে দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রাউন্ডেড হয়। সেটি দেশে ফেরে ৩০ ঘণ্টা দেরিতে। ৩০ জুলাই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে একটি বোয়িং ৭৩৭ শারজাহ বিমানবন্দরে ছয় ঘণ্টা আটকে থাকে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের এক সিনিয়র পাইলট বলেন, 'এটা মূল্যায়ন করার এখনই সময় যে, বিমান বোয়িং কম্পোনেন্ট সার্ভিসেস প্রোগ্রামের ওপর এতটা নির্ভর করবে, নাকি শক্তিশালী প্রকৌশল ও আর্থিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে নিজস্ব খুচরা যন্ত্রাংশ ব্যবস্থাপনা কৌশল তৈরি করবে।'

বিমান মুখপাত্র রওশন কবির স্বীকার করেন, সাম্প্রতিক সমস্যাগুলো খুবই অল্প সময়ের মধ্যে হওয়ায় এটা বেশ উদ্বেগজনক। কিন্তু, যাত্রী নিরাপত্তা কখনোই বিঘ্নিত হয়নি।

তিনি বলেন, 'সামান্যতম ত্রুটি ধরা পড়লেও সমস্যা পুরোপুরি সমাধান না হওয়া পর্যন্ত উড়োজাহাজ উড়বে না। আমাদের দক্ষ প্রকৌশলীরা প্রতিটি ঘটনায় সঠিকভাবে তদন্ত করছেন এবং মেরামত করছেন।'

তবে তিনি বলেন, প্রতিটি কারিগরি ত্রুটি আলাদা। যার ফলে সমস্যার কারণ নির্ধারণ একটু কঠিন হয়ে ওঠে।

Comments

The Daily Star  | English

‘Use firearms in self-defence’

After a police officer was attacked during a raid in the port city, Chattogram police chief Hasib Aziz told officers to be ready to use arms for self-defence.

5h ago