ভরা মৌসুমেও ইলিশ আহরণ এত কমছে কেন

স্টার ফাইল ছবি

ইলিশ মৌসুম সাধারণত জেলে আর ক্রেতাদের জন্য আনন্দের সময়। এ মৌসুমে প্রিয় এ মাছের অপেক্ষায় থাকে পুরো দেশ। কিন্তু এ বছর ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে মৌসুম শুরু হলেও জেলেদের মুখে আনন্দ নেই। দেশের দক্ষিণ উপকূলের জেলেরা সাগরে গিয়ে ফিরে আসছেন সামান্য কিছু ইলিশ আর বড় আকারের আর্থিক ক্ষতি ও হতাশা নিয়ে।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার এফবি মায়ের দোয়া ট্রলারের মালিক শামসু বেপারী নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর পাঁচবার সাগরে গেছেন। শেষ সাগর থেকে মহীপুর মৎস্য ঘাটে ফিরেছেন মাত্র ২২ কেজি ইলিশ আর ৩০ কেজি অন্যান্য মাছ নিয়ে, যার মূল্য মাত্র ৪০ হাজার টাকা। অথচ তার খরচ হয়েছে প্রায় পৌনে দুই লাখ টাকা।

'আমার প্রায় আট লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে,' দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন শামসু।

ট্রলারের মাঝি মোহাম্মদ ইউনূস জানান, তারা সাগরের ৬০০-৭০০ কিলোমিটার গভীর পর্যন্ত যান। প্রতি ২০ কিলোমিটারে এক লিটার জ্বালানি তেল খরচ হয়।

তিনি বলেন, 'ঝড়ো হাওয়া আর সাগর উত্তাল থাকায় আগে আগে ফিরতে হচ্ছে। প্রতিবারই ক্ষতির মুখে পড়ছি। তারপরও জাল, জ্বালানি আর বরফ নিয়ে আবার প্রস্তুতি নিচ্ছি—হয়তো এবার ভাগ্য খুললেও খুলতে পারে।'

ভোলার নাসির মাঝি জেলেপাড়ার বাসিন্দা হোসেন মাঝি গত সপ্তাহে মেঘনায় গিয়ে মাত্র ১৫ কেজি ইলিশ ধরেছেন। নয়জন জেলে আর ৪০ লিটার জ্বালানি খরচ করে এ যাত্রায় তার খরচ হয়েছে ১০-১৫ হাজার টাকা। হাসান মাঝি হাজীপুর-শহীদপুর এলাকায় পেয়েছেন মাত্র ছয় কেজি ইলিশ। সেখানে নদীর গভীরতা নেমে এসেছে সাড়ে সাত ফুটে।

একই গ্রামের এরশাদ ডেইলি স্টারকে জানান, গত ৬ জুলাই তিনি আরও সাতজনকে নিয়ে সাগরের ৩০ কিলোমিটার গভীরে গিয়ে ফিরে এসেছেন মাত্র তিনটি ইলিশ নিয়ে।

'মনপুরার গজারিয়া চরের চারপাশে বিশাল চর দেখেছি,' বলেন তিনি।

চাঁদপুর থেকে মনপুরা পর্যন্ত বিভিন্ন চ্যানেলে এখন চর পড়েছে, নাব্যতা কমে ট্রলার চলার পথ সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে বলে জেলেরা জানিয়েছেন।

এ বছর ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা ছিল ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত। মহীপুরের জেলে কালু মিয়া বলেন, 'নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর থেকে কোনো জেলেই যথেষ্ট মাছ নিয়ে ফিরতে পারেনি।'

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পটুয়াখালীর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে জেলেরা দীর্ঘ সময় সাগরে থাকতে পারবেন। তখন হয়তো জালে বেশি ইলিশ ধরা পড়বে। গত বছরও মৌসুমের শেষের দিকে (জুন-নভেম্বর) জেলেরা যথেষ্ট ইলিশ পেয়েছিলেন।'

তবে, ইলিশের ঘাটতি নিয়ে মতভেদ আছে বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তাদের মধ্যে বক্তব্যে। কেউ মনে করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অস্বাভাবিক আবহাওয়ার কারণে জেলেদের সাগরে যেতে সমস্যা হচ্ছে।

চাঁদপুরে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আবু কাওসার দিদার বলেন, 'জেলেরা সাগরে স্বাভাবিকভাবে যেতে পারলে এবং দীর্ঘ সময় থাকতে পারলে অবশ্যই বেশি ইলিশ ধরা পড়ত।'

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জুলাই মাস স্বাভাবিক গড়ের চেয়ে ২৩ দশমিক পাঁচ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। ৭, ১৪ ও ২৪ জুলাই তিনটি নিম্নচাপের কারণে ভারী বৃষ্টি হয়েছে। বরিশাল বিভাগে রেকর্ড করা হয়েছে ৮৭৮ মিলিমিটার বৃষ্টি। সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর কারণে জেলেরা সমুদ্রে যেতে পারেননি।

কিন্তু, ইলিশ কম আহরণের পেছনে শুধু আবহাওয়াই দায়ী নয়। নাব্যতা সংকট, দূষণ ও নদীর পরিবেশও অন্যতম কারণ।

ইলিশ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্লাহ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নদীতে ইলিশ আসার জন্য কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়—মিষ্টি পানি, স্রোত, অন্তত ১০ মিটার গভীরতা আর কমপক্ষে ৫০০ মিটার প্রস্থ। এমন পরিবেশ না পেলে ইলিশ মাছ অন্যত্র চলে যায়। দেশের সীমানা পেরিয়ে মিয়ানমার কিংবা ভারতেও চলে যায়।'

বরিশাল মৎস্য কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মেঘনা, পায়রা, বলেশ্বর, বিষখালী, আন্দারমানিক, তেতুলিয়া, সুগন্ধা ও গজারিয়া নদীর অন্তত ২০টি স্থানে ইলিশের চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

মৎস্য বিভাগের উপপরিচালক মো. আলফাজ উদ্দিন শেখ জানান, নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে খননের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২-২৫ সালের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বরে প্ল্যাংকটনের পরিমাণ ২০২০ সালের তুলনায় কমেছে অন্তত ৩০ শতাংশ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চর পড়ে যাওয়ায় অনেক স্থানে নদীর গভীরতা কমে গেছে। এ কারণে ইলিশের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।'

'আবার উপকূলের কাছেই গভীর সমুদ্রগামী ট্রলার অবৈধভাবে মাছ ধরছে। এতেও ইলিশের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। কিছু এলাকায় নদীর গভীরতা এত কমে এসেছে যে, ইলিশের প্রজননের জন্য প্রয়োজনীয় গভীরতাই নেই,' বলেন এই গবেষক।

ইলিশ রক্ষায় মৎস্য অধিদপ্তর নিষেধাজ্ঞা ছাড়াও কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কি না জানতে চাইলে ইলিশ উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক জানান, নতুন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

'তবে, আমরা একটি নতুন প্রকল্পের পরিকল্পনা করছি, যে প্রকল্পে ইলিশের প্রজননের উপযোগী পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। আমরা দেখেছি চাঁদপুরে নদী দূষণের কারণে মেঘনায় মাছ মারা যাচ্ছে। এভাবে দূষণ বাড়তে থাকলে তা প্রভাব ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্রে পৌঁছে যাবে,' বলেন তিনি।

দেশে ২০০৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ইলিশের উৎপাদন বেড়েছিল। কিন্তু ২০২৪ সালে তা কমেছে প্রায় ৪২ হাজার টন।

বরিশাল বিভাগ দেশের সবচেয়ে বড় ইলিশ আহরণের কেন্দ্র। এ বিভাগে চলতি বছরের জুনে উৎপাদন ২১ হাজার ৮১৭ থেকে নেমে এসেছে ১৪ হাজার ৪৯৬ টনে। জুলাইয়ে উৎপাদন হয়েছে ১০ হাজার ৮৭৬ টন, যা গত বছরের ১৫ হাজার ৪৭০ টনের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ কম।

২৫ জুলাইয়ের ইলিশ নামানো হয় মাত্র ২৯০ টন, আগের বছরগুলোতে একইসময় ইলিশ পাওয়া যেতে ৫০০ টন।

এদিকে, ইলিশের সরবরাহ কমায় দাম বাড়ছে হু হু করে। ঢাকার বাজারে ছোট ইলিশ এখন কেজি এক হাজার ৪৫০-৬০০ টাকা, মাঝারিগুলো এক হাজার ৮৫০ থেকে দুই হাজার টাকা আর বড় ইলিশ দুই হাজার ৬০০ থেকে তিন হাজার ২০০ টাকা।

গত বছর ইলিশের দাম ছিল ৬৫০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের তুলনায় এ বছর ইলিশের দাম বেড়েছে প্রায় ৩৩ শতাংশ।

পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের বরাতে কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, ২০১০ সালে ইলিশের কেজি ছিল ৪১৭ টাকা, ২০১৯ সালে ছিল ৭৮৯ টাকা আর ২০২৫ সালে ইলিশের কেজি পৌঁছেছে সাড়ে তিন হাজার টাকায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিগগির যদি নদীতে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা না যায়, তবে ইলিশ বাংলাদেশের জলসীমা ছেড়ে চলে যেতে পারে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে জীবিকা, আর এর প্রভাব পড়বে ইলিশের মতো জাতীয় পরিচয়ের ওপরও।

Comments

The Daily Star  | English
National election

Political parties must support the election drive

The election in February 2026 is among the most important challenges that we are going to face.

7h ago