দক্ষিণ ভারতে মোদির নতুন ‘মাথাব্যথা’ থালাপতি বিজয়

‘মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে এসেছেন?’—মোদিকে প্রশ্ন থালাপতির
উচ্ছ্বসিত ভক্তদের হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন থালাপতি বিজয়। ছবি: টিভিকে প্রকাশিত ভিডিও থেকে

কোনো নায়কোচিত বেশভূষা নেই—ফুলহাতা সাদা শার্ট, ক্রিম গ্যাভার্ডিং প্যান্ট ও পায়ে স্যান্ডেল। প্রায় ৩০০ ফুট লম্বা র‌্যাম্প ধরে কনসার্টের গায়কদের মতো হেঁটে যান দুই পাশের উচ্ছ্বসিত ভক্তদের মধ্য দিয়ে। তাদের ছুড়ে দেওয়া উত্তরীয় গলায় জড়াচ্ছেন ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে। হাত নেড়ে জানাচ্ছেন শুভেচ্ছা। উজ্জীবিত করছেন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বাণী দিয়ে। একবার হাত মেলানোর আশায় ভক্তরা ছুটে যাচ্ছেন সেই উঁচু র‌্যাম্পের দিকে। তাদের আকুলতা বলে দিচ্ছে—তিনিই সত্যিকারের নেতা, তাদের সেনাপতি।

এই সেনাপতি হলেন অভিনেতা থেকে পুরাদস্তুর নেতা বনে যাওয়া দক্ষিণী সুপারস্টার থালাপতি বিজয়। সম্প্রতি তার দলীয় জনসভা জনসমুদ্রে রূপ নেওয়ায় ও সেই জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে তামিলনাড়ু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিন পর্যন্ত সবাইকে 'একহাত' নিয়ে আলোচনার তুঙ্গে এখন থালাপতি।

'থালাপতি' তার নাম নয়, ভক্তদের ভালোবেসে দেওয়া উপাধি। এর অর্থ সেনাপতি। গত বৃহস্পতিবার তামিলনাড়ুর দক্ষিণে মাদুরাই জেলায় বিশাল জনসভায় জ্বালাময়ী বক্তৃতায়ও সেই উপাধির প্রতি সুবিচার করেছেন তিনি। বিরোধী কাউকে একবিন্দু ছাড় দেননি।

পাখির চোখে তামিলাগা ভেট্রি কাড়াগম দলের সমাবেশ। ছবি: টিভিকে প্রকাশিত ভিডিও থেকে

গণমাধ্যম দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনে বলা হয়, থালাপতির জনসভায় বসার ব্যবস্থা ছিল অন্তত দেড় লাখ মানুষের। তা ভড়ে যায় সকালেই। অথচ, জনসভা শুরুর সময় ছিল বিকেল ৪টা। পুলিশের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমটি জানায়, অন্তত ১ লাখ ৩০ হাজার গাড়ি জনসভা অভিমুখে গিয়েছে। এসব গাড়ি রাখতে ৫০০ একর জায়গা বরাদ্দ ছিল।

রূপালি পর্দায় মৃদুভাষী, ঠান্ডা মেজাজের অ্যাকশন হিরোর এমন আক্রমণাত্মক ভাষণ সবাইকে যেমন স্তম্ভিত করেছে, তেমনি তার সমর্থকদের মনোবল করেছে আকাশ ছোঁয়া চাঙ্গা।

শুরুতেই নিজেকে বনের রাজা সিংহের সঙ্গে তুলনা করে বিজয় বলেন, 'সিংহ সব সময়ই সিংহ। জঙ্গলে অনেক শিয়ালসহ অন্যান্য প্রাণীও থাকে, কিন্তু সিংহ থাকে মাত্র একটি। সিংহই জঙ্গলের রাজা। সিংহ জানে কী করে টিকে থাকতে হয়।'

বিজয় তার ভাষণে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশে বলেন, ভারতের শাসনক্ষমতায় থাকা বিজেপি-নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) সরকার 'তামিলনাড়ুর জন্য একেবারে কিছুই করেনি'।

তার ভাষ্য—জেলেদের সমস্যা হোক, অথবা এনইইটি সমস্যা, কিংবা তামিলনাড়ুর কেন্দ্রীয় তহবিল—এনডিএ সরকারের কাছ থেকে তারা কিছুই পায়নি।

নিজের ভাষণে থালাপতি তার 'রাজনৈতিক শত্রু' ডিএমকে দলের প্রধান ও তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিনের উদ্দেশে বলেন, 'গত চার বছরের জননীতি নির্ধারণ ও দুঃশাসন সম্পর্কে আমরা যখন প্রশ্ন করি, তখন কোনো জবাব থাকে না। যদি বিন্দুমাত্র বিবেক থাকে, আমাদের প্রশ্নের জবাব দিন। আপনি যে শাসন ব্যবস্থা চালাচ্ছেন, সেখানে কি সততা আছে? ন্যায়বিচার আছে? দুর্নীতি কি নেই? নারীদের নিরাপত্তা আছে? জনসাধারণের নিরাপত্তা আছে?'

পাখির চোখে তামিলাগা ভেট্রি কাড়াগম দলের সমাবেশ। মাঝের র‌্যাম্প ধরে হেঁটে ভক্তদের মাঝে গিয়েছিলেন থালাপতি বিজয়। ছবি: টিভিকে প্রকাশিত ভিডিও থেকে

বিজেপিকে একমাত্র 'আদর্শিক শত্রু' ও ডিএমকে-কে 'রাজনৈতিক শত্রু' হিসেবে উল্লেখ করে থালাপতি বলেন, 'আমাদের টিভিকে (তামিলাগা ভেট্রি কাড়াগম) এমন দল না, যারা কাউকে ভয় পায়। নারীশক্তি আমাদের সঙ্গে, যুবশক্তি আমাদের সঙ্গে—পুরো তামিলনাড়ুর শক্তি আমাদের সঙ্গে আছে।'

নিজের বক্তব্যে বিজেপিকে 'ফ্যাসিবাদী' ও ক্ষমতাসীন ডিএমকে-কে 'বিষাক্ত' বলে আখ্যা দেন থালাপতি।

মোদির প্রতি তার প্রশ্ন, 'আপনি কি সব মানুষের ভালোর জন্য ক্ষমতায় এসেছেন, নাকি আমাদের মুসলিম বন্ধুদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে এসেছেন?'

মোদির সমালোচনা করে থালাপতি আরও বলেন, কেন্দ্রে ২০২৯ সাল পর্যন্ত বিজেপি-নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের ক্ষমতায় থাকার পথ মসৃণ হবে না।

মোদির নাগরিকত্ব সংশোধন আইনেরও কট্টর বিরোধী থালাপতি বিজয়। তার মতে এই 'অগ্রহণযোগ্য' আইন জাতির সামাজিক ও ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করবে।

২০২৬ সালে তামিলনাড়ুর বিধানসভা নির্বাচনে টিভিকে কোনো জোটের সঙ্গে যাচ্ছেন না। একাই লড়বে। সেই লড়াইয়ের দামামা যেন থালাপতি বাজালেন মাদুরাইয়ের জনসভায়।

জনসভায় বক্তব্য রাখছেন থালাপতি বিজয়। ছবি: টিভিকে প্রকাশিত ভিডিও থেকে

জন্ম ও শিক্ষা

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা এস এ চন্দ্রশেখরের সন্তান বিজয়। ১৯৭৪ সালের ২২ জুন জন্ম নেওয়া বিজয়ের পুরো নাম জোসেফ বিজয় চন্দ্রশেখর। পরে ভক্তরা তাকে উপাধি দেন 'থালাপতি'।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য চেন্নাইয়ের লয়োলা কলেজে ভর্তি হন বিজয়। কিন্তু অভিনয়ে সময় দিতে গিয়ে ভিজ্যুয়াল কমিউনিকেশনের পাঠ আর শেষ করা হয়নি তার।

অভিনয়ের শুরু

৫১ বছর বয়সী থালাপতি বিজয় সিনেমায় পদচারণা শুরু করেন শিশুশিল্পী হিসেবে। প্রায় ৮০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করা এই সুপারস্টারের প্রথম সিনেমা তামিল ভাষার 'ভেট্রি' (১৯৮৪)। এটি পরিচালনা করেছিলেন তার বাবা এস এ চন্দ্রশেখর।

থালাপতি বিজয়কে তামিল সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির 'হিট মেশিন'ও বলা হয়। তার অভিনীত 'থেরী', 'মাস্টার', 'বিস্ট', 'লিও', 'ভারিসু' ভেঙেছে একের পর এক রেকর্ড। তিনি পারিশ্রমিকও নিয়েছিলেন রেকর্ড পরিমাণে।

হঠাৎ রাজনীতিতে?

রূপালি পর্দা থেকে রাজপথে আসা ভারতীয় অভিনয়শিল্পীর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। দক্ষিণ ভারতে এমন উদাহরণের মধ্যে আছেন জয়ললিতা, এম জি রামাচন্দ্রন, এনটি রামা রাও (এনটিআর), বিজয় কান্ত, চিরঞ্জীবী, বালাকৃষ্ণ, পাভন কল্যাণসহ আরও অনেকেই। তাদের অনেকে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। একই পথে এগিয়ে চলেছেন থালাপতি বিজয়।

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজনৈতিক দল তামিলাগা ভেট্রি কাড়াগম (টিভিকে) গড়ার ঘোষণা দেন থালাপতি বিজয়। দলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও তিনি। একইসঙ্গে ঘোষণা দেন অভিনয় ছাড়ার কথা।

একেবারে হঠাৎ করেই যে তিনি নির্বাচনে এলেন বা দল গঠন করে ফেললেন, ব্যাপারটা তেমন নয়। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি এর প্রস্তুতি নিয়েছেন।

ডেকান হেরাল্ড ও টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন বলছে—দলটির ভীত তৈরি শুরু হয় ২০০৯ সালে। সে বছর বিজয়ের ভক্তরা কল্যাণ সমিতি গড়ে সামাজিক কার্যক্রম শুরু করেন। ২০১১ সালে তামিলনাড়ুর বিধানসভা নির্বাচনে বিজয়ের এই ভক্তগোষ্ঠী সমর্থন দেয় জয়ললিতার এআইএডিএমকে-নেতৃত্বাধীন (অল ইন্ডিয়া আন্না দ্রাবিড় মুনেত্র কড়গম) জোটকে। সেবার জয়ললিতা মুখ্যমন্ত্রী হন।

হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এরপর বিজয়ের ভক্তদের এই সমিতি ২০২১ সালের অক্টোবরে তামিলনাড়ুর স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয়।

ওই প্রতিবেদনের শুরুটা ছিল এমন, 'তামিল অভিনেতা বিজয় এক দশক ধরে রাজনীতিতে প্রবেশের ইঙ্গিত দিয়ে আসছেন এবং সম্প্রতি শেষ হওয়া স্থানীয় নির্বাচনে তিনি নীরবে এক পরীক্ষা শেষ করেছেন। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ফলাফল বলছে, তার ফ্যান ক্লাবের সদস্যরা ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১১৫টিতে জয়লাভ করেছেন।'

তামিলনাড়ুর স্থানীয় সরকারে কয়েক হাজার পদের মধ্যে এই জয় অতি সামান্য হলেও তা বিজয়ের রাজনৈতিক পদচারণার জন্য ছিল বড় মাইলফলক। তিনি বুঝতে পারেন, তার প্রতি আস্থা তৈরি হয়েছে মানুষের মধ্যে।

সেই নির্বাচনের বছর তিনেকের মধ্যেই ঘোষণা দেন পুরাদস্তুর নতুন রাজনৈতিক দলের। তামিনলাড়ুজুড়ে থালাপতি বিজয়ের রেজিস্টার্ড এই সমিতির অন্তত ৮৫ হাজার ফ্যান ক্লাব আছে। প্রতিটি ক্লাবের সদস্য অন্তত ২৫ জন। তারাই এখন হয়ে উঠেছেন বিজয়ের নতুন দলের নেতাকর্মী, মাঠপর্যায়ের প্রাণ।

পাখির চোখে তামিলাগা ভেট্রি কাড়াগম দলের সমাবেশ। ছবি: টিভিকে প্রকাশিত ভিডিও থেকে

নির্বাচনে টিভিকে

ছোট পর্যায়ে ইতোমধ্যে মুনশিয়ানা দেখানোর পর টিভিকের নজর আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচনে। দলটি থেকে মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী হয়েছেন বিজয় নিজেই। তার দল রাজ্যটির ২৩৪টি বিধানসভা আসনের প্রতিটিতে প্রার্থী দেবে এবং প্রত্যেক প্রার্থীর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন বিজয়।

থালাপতি বিজয় নিজে প্রার্থী হচ্ছেন মাদুরাই থেকে। কিন্তু, গত বৃহস্পতিবার তিনি জনতাকে বলেন, 'আমি ২৩৪টি আসনের প্রতিটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি। আপনার এলাকার প্রার্থী কেবল আমি। প্রার্থী হিসেবে যিনি দাঁড়িয়েছেন, তিনি আর আমি একই। তাদের ভোট দেওয়া মানে আমাকে ভোট দেওয়া।'

পুরো ভাষণে প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি বিজয়ের সুর যেমন গরম ছিল, তেমনি জনগণের প্রতি তার সুর ছিল নরম। শেষ দিকে তিনি জনমানুষের কাছে নিজেকে তুলে ধরে বলেন, 'আমি তোমাদের বিজয়, তোমাদের জন্য বিজয়, যে বিজয় কেবল তোমাদের জন্য।'

সবমিলিয়ে তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। সেটা হয়তো বড় দলগুলোর কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও গভীর করবে—বিশেষ করে বিজেপির। তবে শর্ত—থালাপতি বিজয়ের এই হুংকার আর জনসমুদ্রের স্রোতে কোনো ভাটা পড়া যাবে না এবং ব্যালটেও থাকতে হবে অনুরূপ ছাপ!

Comments

The Daily Star  | English

Tariffs, weak confidence heighten risks for Islamic banks

The global ratings agency said weak solvency of the banks, compounded by poor governance, is eroding depositor confidence, and this, in turn, will limit their growth.

9h ago