তেঁতুলিয়া: কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে নদী, নদী থেকে চা বাগান – সবই মিলবে যেখানে

Tetulia
তেঁতুলিয়া থেকে তোলা কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য; ছবি: সায়েম ইউ চৌধুরী

বহুদিন ধরে আপনার ইচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘাটা দেখার। নানা জটিলতার কারণে পাশের দেশে গিয়ে প্রকৃতির অপূর্ব এই সৃষ্টিটি আর দেখা হয়ে উঠছে না। কিন্তু, আপনি কি জানেন যে নিজের দেশে বসেই দিব্বি গা এলিয়ে দিয়ে দেখে নিতে পারেন কাঞ্চনজঙ্ঘার আলোর নাচন! ঠিক যেমনটি দেখেছিল কাঁকন ও তার বন্ধুরা।

কাঁকন জানায়, “আমি স্বপ্নেও ভাবিনি নিজের দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে দেখে ফেলবো বিস্ময়কর আলোতে ভরা ঐ পর্বতশৃঙ্গ। অথচ, শুধু শোনা কথার উপর ভিত্তি করে চলে গিয়েছিলাম তেঁতুলিয়ায়। ব্যস, একবারেই সফল। ঘুম থেকে উঠে সকালে চোখ মেলতেই দেখলাম কাঞ্চনজঙ্ঘা। প্রথমে তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারিনি।” এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাবার কারণ হলো ভারতের ‘হিমালয় কন্যা’ দার্জিলিং এর অবস্থান তেঁতুলিয়ার ঠিক পাশেই।

কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য সারা বিশ্ব থেকে অগণিত মানুষ ভারতের দার্জিলিংয়ে যায়, অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত। অথচ আমরা অনেকেই জানি না যে বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের উপজেলা তেঁতুলিয়া থেকে হেমন্ত ও শীতকালে মানে অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আকাশ পরিস্কার থাকলে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য। এই সময়টাতে শীত থাকে হালকা, আকাশে মেঘ থাকে কম এবং কুয়াশাও সেভাবে পড়তে শুরু করে না। শুধু প্রকৃতি আপনার পক্ষে থাকলে, আপনি তেঁতুলিয়া থেকে দেখতে পারবেন কাঞ্চনজঙ্ঘা। তবে প্রকৃতির এই পক্ষে থাকার বিষয়টা কিন্তু খোদ দার্জিলিংয়ে বসে থাকলেও সত্য হতে পারে। টাইগার হিলে বসে সূর্যোদয় দেখবে বলে আমাদের পরিচিত এক ইউরোপীয় পর্যটক টানা ১০ দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে টাইগার হিলে গেছে। কিন্তু কপাল মন্দ, তাই দেখা হয়নি কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয়।

পঞ্চগড় জেলার সবচেয়ে আকর্ষনীয় উপজেলা হচ্ছে এই তেঁতুলিয়া। আপনি ভাবতেই পারেন শুধু কি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্যই তেঁতুলিয়া যাবেন? না, তা নয়। এখানে দেখার মত অনেককিছু আছে। এখানে বয়ে চলেছে চারটি নদী – করতোয়া, গোবরা, ডাহুক ও মহানন্দা। বছরের একেকটি সময় এই নদীগুলোতে পানির ধারা থাকে একেক রকম। এই নদীগুলো পাহাড় ঘেঁষা বলে পাহাড় থেকে ভেসে আসে বড় বড় পাথরের চাঁই। পানি ঝকঝকে, স্বচ্ছ ও মিষ্টি। গরমকালে গেলে খুব মজা করে এইসব নদীর শীতল পানিতে গা ভিজিয়ে নিতে পারেন। শীতে পানি কম থাকে বলে সৃষ্টি হয় বিস্তীর্ণ বালুচর। এই চরে ঘোরাঘুরি করা যায়, নৌকা নিয়ে বেড়িয়ে আসা যায় সীমান্ত পর্যন্ত। আর বর্ষা মৌসুমে যদি ভাল বৃষ্টিপাত হয় তাহলে এসব নদীর কুলকুল ধারা বয়ে যেতে থাকে সমতলের চা বাগানের মাঝ দিয়ে।

Tetulia-2
তেঁতুলিয়ার চা বাগান; ছবি: শাহানা হুদা

সিলেটের পাহাড়ি এলাকা ছাড়াও এখন সমতলে ব্যাপকহারে যে চা চাষ হচ্ছে, তা হচ্ছে এই পঞ্চগড়েই। প্রধান সড়ক ধরে যেতে যেতে দু’পাশে তাকালে চোখে পড়বে দিগন্ত প্রসারিত চা বাগান। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ, মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে আছে বাগানকে ছায়াদানকারী বড় বড় বৃক্ষ।

তেঁতুলিয়া নামটিও যে তেঁতুল গাছ থেকে এসেছে, তা আমারা ধারণা করেছিলাম। পরে জেনেছি, এই এলাকায় একসময় অনেক তেঁতুল গাছ ছিল। তবে জানা যায়নি, ঐসব তেঁতুল গাছে ভূত ছিল কিনা। তেঁতুল গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিতো পথিকেরা। কথিত আছে, একসময় এখানে বাস করতো একজন ইংরেজ বণিক, যার বাসা ছিল একটি উঁচু টিলার উপর এবং সেখানেও ছিল একটি বড় ধরণের তেঁতুল গাছ। তাঁর বাবার নাম ছিল টেটু। সেই বণিকের বাবার নাম ‘টেটু’ আর তেঁতুলতলা থেকে ‘লিয়া’ নিয়ে নাকি এলাকার নাম হয়েছে তেঁতুলিয়া। এখনও এই তেঁতুলিয়া জুড়ে ‘বাড়াবাড়ি’ রকমের সবুজের ছড়াছড়ি। চা বাগান, আনারস, কাঁঠাল, তরমুজ, পেঁপে, কমলার বাগান, আম গাছের সারি, ধান, গম, কাউন আর রশুনের ক্ষেত। রয়েছে প্রাচীন গাছের সারি। কেমন যেন পুরো এলাকাটাই ছায়া ঢাকা, সবুজে ঘেরা।

দেশের সবচেয়ে পুরোনো থানাগুলোর মধ্যে তেঁতুলিয়া একটি। ব্রিটিশ আমলে ১৮৬৯ সাল পর্যন্ত তেঁতুলিয়া ছিল রংপুর জেলার একটি মহকুমা শহর। সে সময়ে শিল্প, বাণিজ্য ও নৌবন্দর হিসেবে তেঁতুলিয়া ছিল খুবই বিখ্যাত। মাড়োয়ারিদেরও প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র ছিল এটি। কারণ মহানন্দা নদী দিয়ে আসা-যাওয়া করতো মহাজনী নৌকা। একটা সময় এখানে বাণিজ্যমেলা বসতো। দূর-দূরান্ত থেকে পণ্য নিয়ে ব্যবসায়ীরা আসতেন তেঁতুলিয়ায়। সে সময়ই তৈরি হয়েছিল পাকা ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, মন্দির ও ঘোড়দৌড়ের মাঠ। কিন্তু হঠাৎ ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বর হয়ে সব ওলট-পালট হয়ে গেল। বন্দর-শহরটি হয়ে গেল জনশূন্য। ১৮৭০ সালে এটি চলে যায় ভারতের জলপাইগুঁড়ির অধীনে। ভারত ভাগের সময় এটি আবার চলে আসে বাংলাদেশের হাতে। এই উপজেলার তিনদিকেই ভারত।

তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোটি খুব পুরাতন কিন্তু চমৎকার। নদী সমতল থেকে ১৫/২০ মিটার উঁচুতে এটির অবস্থান। এর সামনে দাঁড়ালেই চোখে পড়বে নদী। আর ডাকবাংলোটির ডিজাইনের মধ্যে রয়েছে ব্রিটিশ স্থাপত্যের ছাপ। আশেপাশে অসংখ্য প্রাচীন ও বড়বড় গাছের সারি। শোনা যায়, ডাকবাংলোটি তৈরি করেছিলেন কোচবিহারের মহারাজ। এখন এটি জেলা পরিষদের হাতে। এর পাশেই বিশাল করে তৈরি করা হয়েছে আমাদের বিজয় স্তম্ভ।

তেঁতুলিয়ার রাস্তাঘাট এতটাই প্রশস্ত ও সুন্দর যে যাতায়াতটাও খুব আরামের। খুব সহজেই চারদিকটা দেখে নেয়া যায়। আর তাইতো এখানে একবার এলে বসে না থেকে চলে যেতে হবে ভজনপুর ও তেঁতুলিয়ার মাঝামাঝি বুড়াবুড়ি নামের একটি জায়গায়। সেখানে আছে একটি পুরোনো দূর্গের ভগ্নাবশেষ, ভদ্রেশ্বর মন্দির, শিবমন্দির এবং গ্রীক ভাস্কর্য রীতিতে তৈরি দুটি সমাধিস্তম্ভ।

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ জ্বালানি তেলের খনির অবস্থান এই তেঁতুলিয়ার শালবাহান গ্রামে। আর আছে স্থলবন্দর বাংলাবান্ধা। এখানে-ওখানে যাওয়ার সময় রাস্তায় থেমে অনায়াসেই খেয়ে নেয়া যায় গরম গরম সিঙ্গারা, দারুণ লোভনীয় জিলাপি, গুড়ের মিষ্টি, সন্দেশ, কচুরি, মহিষের দুধের চা আর সুন্দর সুবাস ছড়ানো লিকার চা। সেই সঙ্গে রয়েছে অনেক ভাতের হোটেল। ঘনবসতি না হওয়ায় এলাকাটা দারুণ নিরিবিলি। এর তিনদিকেই যেহেতু প্রায় ২৮৮ কিলোমিটার সীমানা প্রাচীর, তাই রাতের বেলাতেও আলোর অভাব থাকে না – জ্বলতে থাকে অসংখ্য সার্চ লাইট। এই আলোয় চা বাগান ও নদীগুলো দেখতে খুব চমৎকার লাগে।

Tetulia-3
তেঁতুলিয়ার গ্রামীণ জনজীবন। ছবি: শাহানা হুদা

সবচেয়ে ভালো লাগবে এখনকার মানুষের প্রগতিশীল আচার-আচরণ। নারীরা অবাধ ও স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করছে। পর্দা প্রথার বাড়াবাড়ি নেই। এই যে আমরা এতোগুলো মানুষ যেভাবে খুশি আনন্দ করেছি, ঘুরেছি, থেকেছি, পথে-ঘাটে খেয়েছি, গল্প-গুজব, হাসি-ঠাট্টা করেছি কিন্তু কেউ কোন আপত্তিও করেননি, এমনকি, কেউ ফিরেও তাকাননি।

ঢাকা থেকে পঞ্চগড় ও তেঁতুলিয়া যাওয়ার নন-এসি বাস আছে। যাঁরা এসি বাসে যেতে চান, তাঁদের রংপুর-দিনাজপুর হয়ে যেতে হবে। তবে এখন নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপে সোজা নীলফামারী জেলার ডোমারে নামলে, পাশেই পঞ্চগড়। এরপর গাড়ি, টেম্পু, স্কুটার নিয়ে চলে যাওয়া যাবে। তেঁতুলিয়াতে ঘোরাঘুরি করার জন্য স্কুটার, টেম্পু, গাড়ি, মাইক্রোবাস সবই পাওয়া যাবে নাগালের মধ্যে। পঞ্চগড় থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সারাদিন বাস চলে। পঞ্চগড়ে সাধারণ ও মোটামুটি মানের ভালো হোটেল রয়েছে। তবে অনুমতি নিয়ে থাকা যায় মহানন্দা নদীর তীরে ডাকবাংলোতে এবং বাংলাবান্ধা বন্দর ও বনবিভাগের গেষ্টহাউসে। আর চা বাগানেও থাকার খুব ভালো জায়গা রয়েছে। পরিচিত কেউ থাকলে সে ব্যবস্থা করা যায়।

আমাদের মনে হয়েছে দেশের একদম উত্তরের এই জনপদটি খুবই চমৎকার একটি বেড়ানোর জায়গা। এটা ঠিক যে, আমরা সময়মত যায়নি বলে কাঞ্চনজঙ্ঘাটা দেখতে পারিনি। কিন্তু এরপরও যা দেখেছি, তাতেই পরাণটা ভরে গেছে। তাই এখনই বেড়িয়ে পড়ুন – টেকনাফ নয়, তেঁতুলিয়ার দিকে।

Comments

The Daily Star  | English

Wasa water stinks

However, the state-run agency claims the water is of standard quality when it leaves their facilities

12h ago