১৫৬তম জন্মজয়ন্তীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

নাগর কূলে রবি ঠাকুরের স্মৃতিগাঁথা

“আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।” রবি ঠাকুরের ‘আমাদের ছোটো নদী’ খ্যাত নাগর ও নওগাঁর পতিসরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাস্কর্য।

“বোট ভাসিয়ে চলে যেতুম পদ্মা থেকে কোলের ইছামতিতে, ইছামতি থেকে বড়ালে, হুড়ো সাগরে, চলনবিলে, আত্রাইয়ে, নাগর নদীতে, যমুনা পেরিয়ে সাজাদপুরের খাল বেয়ে সাজাদপুরে।”  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিন্নপত্রাবলীর চিঠিপত্রে শিলাইদহ থেকে শাহজাদপুর ও পতিসরে যাওয়ার এই বর্ণনা মেলে। ১৮৯১ থেকে ১৯০১ -প্রায় একনাগাড়ে থেকেছেন এই বাংলায়। এরপর ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত জমিদারি দেখতে মাঝে মধ্যেই নওগাঁর পতিসর আসতেন। তাঁর পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এ জমিদারি কিনেছিলেন ১৮৩০ সালে। সেই জমিদারি দেখাশোনার জন্যেই ১৮৯১ সালে কবিগুরুর প্রথম আসেন পতিসরে।

চারপাশে ফসলের বিস্তীর্ণ মাঠ। সবুজ প্রকৃতির একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে পতিসর কাছারিবাড়ি। সামনে খোলা মাঠ। বিকালে মানুষের আনাগোনা দেখা যায় সেই মাঠে। আশেপাশে অল্পকিছু বসতি। সপ্তাহের একদিন হাট বসে লোকালয়ের পাশে। পতিসরের রূপ-বৈচিত্র্য বদলে দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের কবি মন। তাঁর অনেক সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি এই পতিসরে। পতিসরের সাধারণ মানুষের জীবনের কঠিন বাস্তবতাকে কবি উপলব্ধি করেছেন তাঁর দর্শনে ও সাহিত্যকর্মে।

রবীন্দ্রনাথ অবহেলিত পতিসর এলাকার মানুষের জন্যে দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠাসহ অনেক জনহিতকর কাজ করেছিলেন। এখানকার কৃষকদের কল্যাণে তাঁর নোবেল পুরস্কারের এক লাখ আট হাজার টাকা দিয়ে এখানে একটি কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। কৃষিক্ষেত্রে উন্নতির জন্য তিনি পতিসরের মাঠে কলের লাঙ্গলের প্রচলন ঘটিয়েছিলেন। গঠন করেছিলেন কৃষি, তাঁত ও মৃৎশিল্পের সমবায় সংগঠন। এলাকাবাসীদের শিক্ষিত করার লক্ষ্যে ছেলের নামানুসারে পতিসরে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশন’। শেষবারের মতো তিনি ১৯৩৭ সালের ২৭ জুলাই স্মৃতি বিজড়িত পতিসরে এসেছিলেন।

জলপথে তাঁর সঙ্গী ছিল প্রিয় বোট ‘পদ্মা’। আরও একটি ছোট নৌকা ছিল। নৌকায় বসেই নাগরের আশেপাশের সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে তিনি রচনা করেছেন অনেক বিখ্যাত লেখা। নাগর নদীতে প্রিয় ‘পদ্মা বোট’-এ বসে তিনি রচনা করেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে’ কবিতার সেই তালগাছটি আজ আর নেই। তবে তাঁর স্মৃতিঘেরা নাগর নদী আজো প্রবাহমান। পতিসরের তাঁর কাছারিবাড়ির কোল ঘেঁষেই আঁকাবাঁকা বয়ে গেছে নাগর। পতিসরে আসা-যাওয়া করতেন এই নদী দিয়ে। স্থানীয়রা নাগরকে ডাকে ‘ছোট নদী’। পতিসরে বসে এই নাগর নিয়েই তিনি লিখেছেন তাঁর সেই কবিতা ‘আমাদের ছোটো নদী’।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা অভিষেচনপত্র, যা তিনি লিখেছিলেন দুপচাঁচিয়া হাইস্কুলকে আশীর্বাদ জ্ঞাপন করে।

গ্রীষ্মকালে রবীন্দ্রনাথের দেয়া নাগর নদীর সেই বর্ণনা আজও অটুট আছে। নাগরে এখনও বৈশাখে হাঁটু জল থাকে। নদী হয়ে যায় মৃত খালের মতো। এখন হারিয়ে গেছে তার সেই উদ্যমী স্রোতধারা। তবে বর্ষাকালে এখনও সে হয় কানায় কানায় পূর্ণ। শরতে নদীর তীর জুড়ে ফোটে কাশফুল। যেন সাদা মেঘের সাথে খেলা করে শরতের কাশফুল! চারপাশের সবুজ ঘনছায়াকে সঙ্গী করে বয়ে চলেছে নাগর। মানুষের দখলে ক্রমেই সরু হয়ে গেছে এই নদী। কবিগুরুর সেই স্মৃতিবিজড়িত নাগর নদীটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে শ্রীহীন হয়ে পড়েছে এখন। রবীন্দ্রস্মৃতি রক্ষার্থে অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে, বালু উত্তোলন বন্ধ করে এই নদীর সংস্কারে নজর দেওয়া উচিত স্থানীয় প্রশাসনের। এটি নওগাঁ জেলা থেকে বগুড়ার দুপচাঁচিয়া হয়ে নাটোরের সিংড়ার চলনবিলে গিয়ে পড়েছে।

পদ্মা বোটে চড়ে রবি ঠাকুরের পরিকল্পনা ছিল দুপচাঁচিয়ায় আসার। নাগর পারেই দুপচাঁচিয়া মডেল উচ্চ বিদ্যালয়। দেড় হাজার বছর পূর্বের পুণ্ড্রবর্ধনখ্যাত বগুড়া শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে  দুপচাঁচিয়া মডেল হাই স্কুল। গড়ে ওঠে উনিশ শতকের শেষের দিকে। এলাকার কিছু বিদ্যানুরাগী প্রথমে এটি একটি সংস্কৃত টোল আকারে চালু করেন। ১৯২০ সালে এটিই ইংরেজি স্কুলে পরিণত হয়। তখন এর নাম হয় মিডল ইংলিশ (এম.ই) স্কুল। ১৯২৩ সালে নামকরণ করা হয় দুপচাঁচিয়া হাই স্কুল। এই স্কুলের ছাত্র ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সংগ্রামী অনন্ত মোহন কুণ্ডু কবির সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। ১৯৩৭ সালের ২৭ জুলাই পতিসরে ‘পূণাহ্য’ অনুষ্ঠান শেষে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এখানে আসার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তবে সেদিন আকস্মিকভাবে তিনি শারীরিক অসুস্থতার কারণে আসতে পারেননি। সেদিনই ছিল এ বাংলায় তাঁর শেষদিন। তবে একটি চিঠিতে পাঠিয়েছিলেন আশীর্বাদবাণী“দেশে জ্ঞানের অভিষেচনকার্য্যে দুবচাঁচিয়া হাই স্কুল অন্যতম কেন্দ্ররূপে যে সাধনায় প্রবৃত্ত তাহাতে তাহার সফলতা আমি কামনা করি।

এই স্কুলের অনেক কৃতী ছাত্রও ছিলেন। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে রমেন্দ্র কুমার পোদ্দার জুন ২০, ১৯৭৯ ডিসেম্বর ৩০, ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন।

পতিসরে রবীন্দ্রনাথের লেখা

রবি ঠাকুর পতিসরে কাটিয়েছেন দীর্ঘ সময়। কবির সাহিত্য সৃষ্টির একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে পতিসর। লিখেছেন ‘বিদায় অভিশাপ’, কাব্যগ্রন্থ চিত্রা, উপন্যাস গোরাঘরে বাইরে-এর অনেকাংশ। ছোটগল্প প্রতিহিংসাঠাকুরদা। প্রবন্ধ ইংরেজ ভারতবাসী। গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার নিভৃত সাধনা, বধূ মিছে রাগ করো না, তুমি নবরূপে এসো প্রাণে ইত্যাদি। এই পতিসরে বসেই চৈতালী কাব্যের ৫৪টি কবিতা লিখেছেন। লিখেছেন সন্ধ্যা, দুই বিঘা জমি -এর মতো অনেক বিখ্যাত কবিতা।

 

আমাদের ছোটো নদী

আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে

বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।

পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,

দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।

 

চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা,

একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।

কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,

রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।

 

আর-পারে আমবন তালবন চলে,

গাঁয়ের বামুন পাড়া তারি ছায়াতলে।

তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাইবার কালে

গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে।

 

সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে

আঁচলে ছাঁকিয়া তারা ছোটো মাছ ধরে।

বালি দিয়ে মাজে থালা, ঘটিগুলি মাজে,

বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে।

 

আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর

মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর।

মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে,

ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে।

দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া,

বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।

 

ছবি: সিরাতুল জান্নাত ও মিতালী রায়

Comments

The Daily Star  | English

Election in first half of April 2026

In his address to the nation, CA says EC will later provide detailed roadmap

37m ago