‘অভিনব কৌশলে অসহায় আমলা’
আমাদের মাঠ প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা কি হঠাৎই ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েছেন? এতই ক্ষমতাহীন যে বাল্যবিবাহের খবর পেলেও তারা তা থামাতে অক্ষম? ব্যপারটা আমলারা এভাবেই তুলে ধরতে চান।
অন্তত দ্য ডেইলি স্টারে আজ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে তাই প্রকাশ পায়। সংবাদে বলা হয়েছে, দিনাজপুরের চিরিরবন্দর, নাটোরের গুরুদাসপুর এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় গত এক সপ্তাহে অনেকগুলো বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় লোকজন বিয়ে বন্ধ করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন তথা উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন।
কিন্তু কর্তাব্যক্তিরা সহযোগিতা করেননি; নাবালক কন্যা শিশুদের বিয়ে বন্ধ হয়নি। সহযোগিতা না করার কারণ হিসেবে ওই তিন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা তাদের ক্ষমতাহীনতার কথা বলেছেন। নাটোরে এবং দিনাজপুরের জেলা প্রশাসকরা বাল্যবিবাহের খবর জানতেন। কিন্তু তারাও তাদের ক্ষমতাহীনতার কথা বলেছেন।
ক্ষমতাহীনতার কারণ হিসাবে তারা বলছেন, হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী তাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে আর মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে পারবেন না। এর অর্থ দাঁড়ায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিচারিক ক্ষমতা না থাকলে তাদের পক্ষে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব নয়। তাদের এই যুক্তি কতটা গ্রহণযোগ্য?
মাত্র কয়েক মাস আগে প্রণীত বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন কিন্তু তাদের যুক্তিকে নাকচ করে দেয়। বাল্যবিবাহ আইনের ৪ নং ধারা অনুসারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা, উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা, উপজেলা প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি কোনো ব্যক্তির লিখিত বা মৌখিক আবেদন বা অন্যকোনো মাধ্যমে বাল্যবিবাহের সংবাদ পেলে তিনি ওই বিয়ে বন্ধ করবেন।
আইনের ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে বাল্যবিবাহ বন্ধ করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা অন্য কোনো কর্মকর্তার বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগের প্রয়োজন নেই। উল্লিখিত যে কেউ প্রশাসনিক পদক্ষেপের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে পারেন।
মাঠ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা সবাই বাল্যবিবাহ বন্ধে বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগের অক্ষমতার কথা বলেছেন। চলুন দেখি কোন পর্যায়ে বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করা দরকার। বাল্যবিবাহ আইনের ৫ নং ধারায় বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগের প্রসঙ্গ আছে। ওই ধারায় বলা হয়েছে, “আদালত, স্ব-উদ্যোগে বা কোনো ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে বা অন্য কোনো মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে, যদি এই মর্মে নিশ্চিত হন যে, কোন বাল্যবিবাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইয়াছে অথবা বাল্যবিবাহ অত্যাসন্ন তাহা হইলে আদালত উক্ত বিবাহের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করিতে পারিবে।”
কোনো ব্যক্তি নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করলে তিনি অনধিক ছয় মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অর্থ অনাদায়ে এক মাস করাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, ধারা ৪ অনুযায়ী নির্বাহী বা প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ অথবা ধারা ৫ অনুযায়ী বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ-- দুভাবেই বাল্যবিবাহ বন্ধ করা যায়।
অর্থাৎ দিনাজপুরের চিরিরবন্দর, নাটোরের গুরুদাসপুর এবং নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তারা তাদের প্রশাসনিক বা নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করেই বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে পারতেন। আইন অনুযায়ী তাদের দায়িত্ব ছিলো প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কিন্তু তারা তা করেননি। নির্বাহী বিভাগের কর্মচারী হয়ে তারা বিচার বিভাগের ক্ষমতা প্রয়োগের প্রতি বেশি আগ্রহী।
নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা তাদের আইনগত দায়িত্ব ছিলো। তা না করে তারা কি তাদের দায়িত্বের প্রতি অবহেলা করেননি?
অবহেলা জনিত কিছু ঘটলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না কারণ তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ জেলা প্রশাসকরা তাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
তিন উপজেলার ঘটনা আমরা জানি। আর কোন কোন উপজেলায় গত এক সপ্তাহে বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে তা আমরা সঠিক জানি না।
অন্য কোথাও বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটলে সেখানকার স্থানীয় প্রশাসন কী পদক্ষেপ নিচ্ছে তা আমরা নিশ্চিত করে জানি না। তবে অনুমান করা যায় যে অন্য জেলাগুলোতেও প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা একই রকম অবস্থান নিয়েছেন। কেননা এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
গত ১১ মে তারিখে হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন—নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা, যারা প্রশাসনিক কর্মকর্তাও বটে, বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে পারবেন না। প্রশাসনের কর্মকর্তারা আদালতের রায়কে মেনে নিতে পারছেন না। নির্বাহী ক্ষমতার পাশাপাশি তারা বিচারিক ক্ষমতাও প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে চান। কয়েকজন জেলা প্রশাসক মন্ত্রিপরিষদে চিঠি দিয়ে তাদের অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন।
তারা আশঙ্কা করছেন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে না পারলে বাল্যবিবাহের ঘটনা বেড়ে যাবে, খাদ্যে ভেজালের প্রবণতা বাড়বে, ইভ টিজিং বাড়বে, আরও অন্যান্য অপরাধ বেড়ে যাবে।
প্রশাসনের আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করতে এবং তাদের যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় বিচারিক ক্ষমতা দরকার সেটার যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা কি তাহলে ইচ্ছাকৃতভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বেন? বাল্যবিবাহ বন্ধে পদক্ষেপ না নেওয়া কি সেটার আগাম আভাস দেয়?
মাঠ প্রশাসন যদি ইচ্ছাকৃতভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে তাহলে জনজীবনে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির আশঙ্কা করা যায়। সামনেই রমজান মাস। অসাধু ব্যবসায়ীরা এমনিতেই অপেক্ষা করছে ব্যবসায় কারসাজি করতে। আর যদি প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা টের পায় তাহলে তাদের পোয়া বারো। আরও অনেক রকম অপরাধ বেড়ে যেতে পারে এমন পরিস্থিতিতে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো জেলা প্রশাসকদের চিঠিতেও এমন আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বিচারিক ক্ষমতা ফিরে পেতে নিজেদেরকে ক্ষমতাহীন দেখানোর এই অভিনব কৌশল গ্রহণ করেছেন মাঠ পর্যায়ের আমলারা। এমন পরিস্থিতিতে জনদুর্ভোগ বাড়বে; সরকারের উপর চাপ বাড়বে।
উদ্ভূত পরিস্থিতি কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে—তাহলে কি মাঠ পর্যায়ের আমলারা বিচারিক ক্ষমতা ছাড়া আসলেই ক্ষমতাহীন? সুষ্ঠুভাবে প্রশাসন পরিচালনা করতে নির্বাহী বিভাগের যত ক্ষমতা আছে সেগুলো কি যথেষ্ট নয়? দুনিয়ার আর কোন গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাহী বিভাগের ব্যক্তিরা নির্বাহী ক্ষমতার পাশাপাশি বিচারিক ক্ষমতাও প্রয়োগ করেন? এমন কোনো উদাহরণ কেউ দিতে পারবেন?
সরকার ইতোমধ্যে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিপক্ষে আপিল করেছে। সরকার আর কী কী পদক্ষেপ নিতে পারে? সরকারের বিচক্ষণ পদক্ষেপ পারে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে।
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে আইন বিচার ও মানবাধিকারের সর্বোৎকৃষ্ট সময় ছিলো সম্রাট অশোকের শাসনামল। যুদ্ধবিরোধী অবস্থান নেওয়ার পর থেকেই তিনি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গড়ে তোলেন। তিনি হয়ে উঠেন প্রজা অন্তঃপ্রাণ; জনগণের জন্য নিজেকে অবারিত করে তোলেন। সরকারি ঘোষণা জারি করেন যে, “যেখানেই আমি থাকিনা কেন, ভোজনে, মহিলা মহলে, শয়ন ঘরে, নির্জনতায়, রথে বা বাগানে, সর্বত্রই যখনই প্রয়োজন রাজ কর্মচারীদেরকে জনগণের প্রয়োজনের কথা জানাতে হবে।”
রাজ কর্মচারীরা ও সম্রাটের আদেশ মোতাবেক নিজেদেরকে তৈরি করেন; জনগণকে সেবা দেওয়ার জন্য। ইতিহাসে সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে অসংখ্য জনকল্যাণমূলক কাজের উদাহরণ পাওয়া যায়। সে সব যদিও ২২০০ বছরেরও বেশি সময় আগের কথা; তবে এ থেকে এটুকু প্রমাণিত হয় যে, রাজা যেমন হবেন রাজকর্মচারীরাও তেমন হবেন। রাজা যদি প্রজা বান্ধব হন, কর্মচারীরাও তাই হবেন।
বাংলাদেশ থেকে এ পর্যন্ত অশোকের কোনো প্রস্তরলিপি আবিষ্কার না হওযায় গবেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশ পর্যন্ত অশোকের শাসন বিস্তৃত হয়নি। এটা আমাদের সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যেটাই বলি না কেন—আমাদের শাসন ব্যবস্থার ইতিহাসে উপমহাদেশের সবচেয়ে ভালো শাসনের সাথে সংযোগ নেই।
তবে এখন রাজা নেই, রাজত্ব নেই। আছে প্রজাতন্ত্র; যেখানে প্রজারাই মনিব। আর সেই রাজ কর্মচারীরা এখন প্রজাদের সেবক।
Comments