খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে তল্লাশির ফলাফল কি আসলেই ‘শূন্য’?

গুলশানে খালেদা জিয়ার কার্যালয়। ছবি: মাসুম মোল্লা

কয়েক বছর আগে একটা বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের মেগা ধারাবাহিক নাটকের নাম ছিলো গুলশান এভিনিউ। নানা চমক ও নাটকীয়তায় ভরপুর ছিলো ধারাবাহিকটি। গত শনিবার গুলশানের ৮৬ নম্বর রোডের ৬ নম্বর বাড়িটিতে পুলিশের আকস্মিক তল্লাশিতেও চমক ও নাটকীয়তার কমতি ছিলো না। প্রায় দুই ঘণ্টা তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ কিছু না পেয়ে হতাশ হয়ে চলে গেছে। মালামাল জব্দ তালিকায় পুলিশ ‘শূন্য’ লিখলেও তল্লাশির ফলাফল কি আসলেই ‘শূন্য’?

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘটনাটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে; এর যথেষ্ট কারণও আছে। ওই বাড়িটি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়। তবে সেখানে আকস্মিক তল্লাশি কেন? যত দূর জানা যায় তা হলো, পুলিশ ভেবেছিলো ওই কার্যালয় থেকে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য নানা উস্কানিমূলক প্রচারপত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র জড়ো করা হচ্ছে। তাই শনিবার সকালে পুলিশ আটঘাট বেঁধে তল্লাশিতে নেমে পড়ে।

সাংবাদিকরা তল্লাশির কারণ খুঁজছেন। কোন মামলায়, কবে কোন আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত পুলিশকে তল্লাশির অনুমতি দিলো। কেউ কেউ ভাবলেন ২০১৫ সালে একবার আদালত গুলশান থানা পুলিশকে যে অনুমতি দিয়েছিলেন তবে কি এখন তাঁরা সেটাই বাস্তবায়ন করছে? ২০১৫ সালেও বলা হয়েছিল খালেদার গুলশান কার্যালয়ে একটি ফৌজদারি মামলার আসামিরা আত্মগোপন করে আছেন এবং সেখান থেকে তাঁরা প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশব্যাপী নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার নির্দেশনা দিচ্ছেন। সেসময় আসলে খালেদা জিয়া নিজেই ওই অফিসে অবস্থান করছিলেন। পুলিশ তাঁর অফিস ঘেরাও করে; তাঁকে ৫ জানুয়ারির ঘোষিত কর্মসূচিতে যোগ দিতে বাইরে বের হতে বাধা দেয়। প্রতিবাদে তিনি দেশব্যাপী লাগাতার অবরোধের ডাক দেন এবং কার্যালয়েই অবস্থান শুরু করেন। আদালত মার্চ মাসের ১ তারিখে পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে ওই অফিস তল্লাশির অনুমতি দেন। কিন্তু পুলিশ তখন তল্লাশি চালায়নি।

পরে জানা গেলো শনিবারের তল্লাশির সাথে ওই পুরনো ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এই তল্লাশির সূত্রপাত আসলেই চমক ও নাটকীয়তায় ভরা; রহস্যপূর্ণও বটে। কোন কোন পত্রিকায় খবর অনুযায়ী, বই আকারে বাঁধাই করা তিন বছরের পুরনো দৈনিক পত্রিকা কাভার্ড ভ্যানে করে গত বৃহস্পতিবার গুলশান কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হলে এটিকে ‘সন্দেহজনক ঘটনা’ হিসেবে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলে খবর যায়। বাঁধাই করা পত্রিকাগুলোকে কেউ কেউ সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের লিফলেট মনে করে এ খবর পুলিশের কাছে পৌঁছে দেয়। কাভার্ড ভ্যান নিয়ে গোপনীয়তার কারণেও পুলিশের মনে সন্দেহ জন্মায়। গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয় যাতে আশঙ্কা করা হয় জনগণকে উস্কানি দিয়ে দেশে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিঘ্ন ঘটানোর মতো জিনিসপত্র কার্যালয়টিতে মজুদ করা হচ্ছে।

তল্লাশি চালানোর প্রয়োজন অনুভব করে পুলিশ। আদালতকেও এমনটাই বলা হয়েছিল যে ওই কার্যালয়ে অনেক ‘ভয়ঙ্কর’ জিনিসপত্র জড়ো করা হয়েছে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য। পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত শুক্রবার খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয় তল্লাশির অনুমতি দেন। পুলিশ শনিবার তল্লাশি চালায় কিন্তু কোনো কিছুই খুঁজে পায়নি। পুলিশ কর্মকর্তারা বোকা বোনে যান। তবে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন না কে ওই জিডিটা করেছিলেন। যিনি এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা জিডি করলেন তিনি অজ্ঞাতনামা থেকে যাচ্ছেন।

তবে এই ঘটনায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। কোনো তথ্য পেয়ে তা যাচাই না করেই কি পুলিশ পদক্ষেপ নিয়েছে? বিএনপির মতো একটা রাজনৈতিক দলের প্রধানের কার্যালয় তল্লাশি চালানোর আগে পুলিশ কি সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের অনুমোদন নেয়নি? কিসের ভিত্তিতে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল পুলিশ বাহিনীকে এমন অনুমতি দিলো? এমন তল্লাশির মাধ্যমে বিনপিকে কি ভয় দেখানো হলো? তাতে সরকারের অর্জন কতখানি?

গুলশানের ঘটনায় আদালত প্রসঙ্গেও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন মনে জাগতে পারে। পুলিশ আবেদন করলেই কি তল্লাশির অনুমতি দিতে হবে? আবেদন কতটা যৌক্তিক সেটা কি ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয় খতিয়ে দেখবেন না? পুলিশ চাইলেই যদি অনুমতি দেওয়া হয় তাহলে আদালত রাষ্ট্রের অসীম ক্ষমতার অপপ্রয়োগ থেকে জনগণকে কিভাবে রক্ষা করবেন?

আড়াইশো বছর আগের একটা ঘটনা বলি, যার মাধ্যমে জনগণের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও স্বাধীনতার রক্ষার নতুন আইনি কাঠামোর সূত্রপাত হয়।

জন উইকস ছিলেন ইংল্যান্ডের একজন স্পষ্টভাষী রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তাঁর কণ্ঠ ছিলো সোচ্চার। রাজার হুংকারকে তিনি ভয় পেতেন না। এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। আবার রাজার কঠোর সমালোচনা করার দায়ে সংসদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। বঞ্চিত হয়েছেন সংসদে প্রবেশাধিকার থেকেও। রাজার শাসনের সমালোচনা করে তিনি একবার কিছু প্রচারপত্র লিখলেন। সেগুলো মুদ্রণ করার জন্য একজন মুদ্রাকরকেও দিলেন। কিন্তু অভিযোগ ছিলো রাজার বিরুদ্ধে জনগণকে খেপিয়ে দেওয়ার জন্য উইকস ওই সব প্রচারপত্র লিখেছেন। রাজার লোকেরা ওই মুদ্রণালয়ে তল্লাশি চালিয়ে প্রচারপত্রগুলো জব্দ করলো এবং মুদ্রাকরকে গ্রেফতার করলো। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হলো। সে সময় রাজার সমালোচনা করাও রাষ্ট্রদ্রোহিতা ছিলো। তবে মুদ্রাকর রাজার লোকজনের বিপক্ষে মামলা ঠুকলো এই বলে যে তাঁর গৃহে অনুপ্রবেশ হয়েছে; তাঁরা অবৈধভাবে তাঁর সম্পত্তিতে প্রবেশ করেছে। আদালত দেখলো যে, তল্লাশি সংক্রান্ত কোনো আইন নেই। সেজন্য সরকার নাগরিকের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে অনুপ্রবেশে অসীম ক্ষমতা ভোগ করে যাতে জনগণের অধিকার লঙ্ঘিত হয়। রাষ্ট্রের এই অপরিসীম ক্ষমতার একটা সীমা থাকা উচিত। তখন আদালত বললো যে কারো সম্পত্তিতে প্রবেশ বা তল্লাশি চালানোর জন্য যৌক্তিক কারণ থাকতে হবে এবং আদালত থেকে অনুমতি নিতে হবে। ১৭৬৫ সালের রায় জনগণের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে সরকারি বাহিনীর যথেচ্ছ অনুপ্রবেশ বন্ধে দুনিয়াজুড়ে অবদান রেখেছে।

বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থাতেও ওই রায়ের প্রভাব আছে। যেমন পুলিশ কারো বাসা বা অফিসে তল্লাশি করতে চাইলে আদালত থেকে অনুমতি নিয়ে তবেই সেটা করে। মাঝে মধ্যে যে অন্য রকম কিছু হয় না তা কিন্তু নয়। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঝে মধ্যেই আইনের ব্যত্যয় ঘটায়। আবার অনেক সময় অযৌক্তিকভাবেও অনুমতি পায় পুলিশ; যা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

খালেদা জিয়ার অফিস তল্লাশির ঘটনায় বিএনপি রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। দলের নেতারা অনেক দিন ধরে অভিযোগ করছেন যে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ অনুপস্থিত, খালেদার কার্যালয় তল্লাশির ঘটনা তাদের সেই অভিযোগকেই পোক্ত করে। দলটি যখন আন্দোলনে না গিয়ে আস্তে আস্তে নির্বাচনমুখী হচ্ছে সেই সময় এমন একটা ঘটনা ঘটলো যা নিয়ে আগামী কিছু দিন বিচার বিশ্লেষণ চলবে।

তল্লাশির ঘটনায় বেশিরভাগ মানুষ পুলিশের কাজের সমালোচনা করছেন। এই সমালোচনা সরকারের পক্ষে যাচ্ছে না। পুলিশের বেপরোয়া, খামখেয়ালি এবং উদ্ধত আচরণের খেসারত কিন্তু সরকারকেই দিতে হয়; আরো সুনির্দিষ্ট ভাবে বললে ক্ষমতাসীন দলকেই এর মূল্য দিতে হয়। সরকারের উচিত হবে পুলিশ বাহিনীর অতি উৎসাহী ব্যক্তিদের লাগাম টেনে রাখা।

Comments

The Daily Star  | English

Life insurers mired in irregularities

One-fourth of the life insurance firms in the country are plagued with financial irregularities and mismanagement that have put the entire industry in danger.

7h ago