ষোড়শ সংশোধনী বাতিল, নতুন অধ্যায়ের প্রত্যাশা

দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ঘটল। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ কোর্ট দেশের পার্লামেন্টে পাশ হওয়া সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় বহাল রেখেছেন। এর আগে হাইকোর্ট বিভাগের দ্বৈত বেঞ্চ এই সংশোধনী বাতিল করেছিলেন। ইতিপূর্বে প্রকাশিত হাইকোর্ট বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কিছু উল্লেখযোগ্য দিক ছিল আপিল বিভাগের রায়ে সেই দিকগুলি কিভাবে আলোচিত হবে তাই দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পর্যন্ত।
সুপ্রিম কোর্ট

দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ঘটল। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ কোর্ট দেশের পার্লামেন্টে পাশ হওয়া সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় বহাল রেখেছেন। এর আগে হাইকোর্ট বিভাগের দ্বৈত বেঞ্চ এই সংশোধনী বাতিল করেছিলেন। ইতিপূর্বে প্রকাশিত হাইকোর্ট বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কিছু উল্লেখযোগ্য দিক ছিল আপিল বিভাগের রায়ে সেই দিকগুলি কিভাবে আলোচিত হবে তাই দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পর্যন্ত।

হাইকোর্টের রায়ে সংবিধানের ৭০(খ) অনুচ্ছেদ আলোচিত হয়েছে। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোন সাংসদ দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দিলে সংসদ সদস্য পদ হারাবেন।

আমাদের এখানে যে সংসদীয় ব্যবস্থা চালু হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলিতে তা এসেছে মূলত ব্রিটেনের সংসদীয় ব্যবস্থার ওয়েস্ট মিনিস্টার পদ্ধতির মাধ্যমে। অথচ সেই ব্রিটেনের সংসদীয় ব্যবস্থায় আমাদের মত ৭০(খ) এর মত কোন অনুচ্ছেদ নেই। ভারতীয় সংবিধান রচনাকারীরা ১৯৫০ সালে গৃহীত সংবিধানে ‘দলের বাইরে ভোট দেওয়া যাবে না’ এমন অনুচ্ছেদ গ্রহণ করে সংসদ সদস্যদের অধিকার হরণ করেনি। অথচ আমাদের সংবিধান রচনাকারীরা এমন একটা অনুচ্ছেদ গ্রহণ করেছিলেন। যুক্তি ছিল, না হলে সরকার পরিবর্তনে টাকার কিংবা মন্ত্রিত্বের লোভ কাজ করবে। দলীয় সাংসদরা প্রলোভিত হয়ে নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটাবে। কেবল মাত্র এই একটা কারণে সংসদ সদস্য হিসেবে তাদের মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। অথচ ১৯৭২ সালে আমাদের যে সংবিধান রচনা করা হয়েছিল সেখানে সংসদের নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার পরও এই অনুচ্ছেদ কেন গ্রহণ করা হয়েছিল তা আজও বোধগম্য নয়।

আপিল বিভাগের এই মামলার শুনানির সময় দেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা এটর্নি জেনারেল ও তার সহকর্মীরা একটা ভুল তথ্য তুলে ধরেছেন। ১৯৭২ সালে যখন সংবিধান গ্রহণ করা হয়েছিল তখন বিচারক অপসারণের আইন সংসদের উপর ন্যস্ত ছিল অথচ এই সংবিধানের আওতায় ১৯৭৩ নির্বাচিত সংসদ ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু করে, তখন বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির কাছে অর্পণ করা হয়েছিল। তাদের বক্তব্যে ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনীর অংশটুকু বাদ দেওয়া হয়েছে।

১৯৭৮ সালের সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমানের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির সেই ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে অর্পণ করেছিল রাষ্ট্রপতির একক ক্ষমতা বাতিল করে।

যদিও বিচারক নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি কিন্তু সংবিধানের ৪৮ ও ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর ও প্রধান বিচারপতির সুপারিশ ছাড়া বিচারক নিয়োগ করতে পারেন না।

বিচারক হওয়ার যোগ্যতা উল্লেখ করা হয়েছে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে।

ক) আইনজীবী হিসেবে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা

খ) জেলা জজ হিসাবে তিন বছরের অভিজ্ঞতা

বিচারিক আদালতসমূহে বিচারকদের পদোন্নতি মূলত নির্বাহী বিভাগের প্রস্তাবে সুপ্রিম কোর্ট অনুমোদন করেন। বর্তমানে এই বিধান ১৯৯৯ বহুল আলোচিত ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলার রায়ের মাধ্যমে হয়েছে। তার আগে নির্বাহী বিভাগ একক কর্তৃত্বে এই কাজ সম্পাদন করত।

ভারতের ২৯টি রাজ্য ও সাতটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্য মোট ২৪টি হাইকোর্ট। প্রতিটি রাজ্য হাইকোর্ট এককভাবে বিচারিক আদালতসমূহের বিচারকদের পদোন্নতি ও বদলি পরিচালনা করেন। রাজ্য সরকারের তথা রাজ্য নির্বাহী বিভাগের এতে কোনো হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। যুগ্ম কিংবা অতিরিক্ত ও জেলা জজ পদের প্রতিটি স্তরের পদোন্নতি লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে করা হয়।

ভারতের এই বিধানের কারণে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জি সরকারের প্রথম সারির কয়েকজন সাংসদ ও মন্ত্রী সারদা কেলেঙ্কারির জন্য দীর্ঘদিন কারাগারে অন্তরীণ। মমতা ব্যানার্জি প্রকাশ্যে তাদের পক্ষ নেওয়ার পরও তাদের কারামুক্ত করতে পারেননি।

ভারতীয় রাজ্যগুলোতে বিচারকদের বদলি বছরের শেষে ডিসেম্বরে একবার ও যাদের কর্মকাল তিনবছর অথবা এর আশপাশের সময়কাল শেষ হয়েছে তার ভিত্তি করা হয়। অথচ আমাদের দেশে বছরের প্রতি কর্মদিবসে বিচারকদের বদলী করা হয়। যদিও মাসদার হেসেন মামলার পরে সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদনের ভিত্তিতে করা হয় তথাপি বছরের যে কোন সময় এই ধরনের বদলীর কারণে বিচারকদের এক ধরনের চাপের মধ্য থাকতে হয়।

সম্প্রতি বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সংবিধানের ৯৯তম সংশোধনী আনয়ন করে যার মাধ্যমে ভারতের উচ্চ আদালতসমূহের বিচারক নিয়োগের প্রচলিত কলেজিয়াম ব্যবস্থা পাল্টে নির্বাহী বিভাগের সমন্বয়ে নতুন আইন প্রণয়ন করে। কিন্তু ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের এই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন।

ভারতীয় সংবিধান সংশোধনের জন্য তাদের দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। ৯৯তম সংশোধনী যখন পাশ করা হয় তখন উচ্চ কক্ষ তথা রাজ্যসভায় বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। এই কারণে রাজ্য সভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বিজেপি কংগ্রেসকে সাথে নিয়ে এই সংশোধনী পাশ করেছিল। ভরতের দুই সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল ও আঞ্চলিক দলসমূহ মিলিতভাবে হাইকোর্টগুলোর বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য এই সংশোধনী এনেছিল।

ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট তা অনুধাবন করতে পেরে সরাসরি ভারতীয় সংবিধানের ৯৯তম সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছেন।

শুধু বাতিল করেই ক্ষান্ত হয়নি, নতুন গাইড লাইন তৈরি করে দিয়েছেন যাতে নির্বাহী বিভাগের কাছে বিচারক নিয়োগের জন্য তালিকা করার দায়িত্ব দিলেও সেই তালিকা থেকে বাছাই করার ক্ষমতা ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট নিজ অধিকারে রেখেছে।

পার্শ্ববর্তী দেশের উদাহরণ থেকে অনেক কিছু শিখে আমরাও বিচার বিভাগে নতুন অধ্যায় শুরু করতে পারি।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

8h ago