সরকারি শিশু পরিবারে বেড়ে উঠা অনাথ মেয়ের নতুন জীবন শুরু

মেয়েকে স্বর্ণালংকার অর্থাৎ গলার হার, কানের দুল ও হাতের চুড়ি দেবেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। আবাসনের নিশ্চয়তা দিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদরের সংসদ সদস্য উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। বরের জামা-কাপড়, কনের স্বর্ণের চেইন ও টেলিভিশন দেবেন জেলা প্রশাসক।
Habiba
১৪ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরকারি শিশু পরিবারে অনুষ্ঠিত হয় হাবিবা আক্তারের বিয়ে। ছবি: স্টার

মেয়েকে স্বর্ণালংকার অর্থাৎ গলার হার, কানের দুল ও হাতের চুড়ি দেবেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। আবাসনের নিশ্চয়তা দিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদরের সংসদ সদস্য উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। বরের জামা-কাপড়, কনের স্বর্ণের চেইন ও টেলিভিশন দেবেন জেলা প্রশাসক।

পুলিশ কনস্টেবল পদে পাত্রের চাকরির ব্যবস্থা করলেন, সামগ্রিক সাজসজ্জা, অতিথিদের খাবার, কনের দুই পর্বের বিদায়ের আয়োজন করেছেন পুলিশ সুপার। কনে সাজানোর দায়িত্ব নিলেন পুলিশ সুপারের স্ত্রী। এভাবেই সম্পন্ন হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি শিশু পরিবারে বেড়ে উঠা পিতা-মাতাহীন মেয়ে হাবিবা আক্তারের বিয়ে।

শুক্রবার (১৪ জুলাই) দুপুর আড়াইটার দিকে হাবিবার বাবার ভূমিকায় থাকা জেলা পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমানের উপস্থিতে কাজী আবু জামাল হাবিবা আক্তার-জাকারিয়ার বিয়ে পড়ান। বিয়ের দেনমোহর নির্ধারণ করা হয় ২ লাখ ১ হাজার টাকা। এছাড়াও, বিয়েতে উকিল বাবা করা হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারকে।

হাবিবা-জাকারিয়ার আলোচিত এ বিয়েতে জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে বরযাত্রী নিয়ে শিশু পরিবারে হাজির হন বর জাকারিয়া আলম। এসময় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার, সদর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান তাসলিমা সুলতানা খানম নিশাত ও শিশু পরিবারের উপ-তত্ত্বাবধায়ক রওশন আরা বেগম বরকে বরণ করে নেন।

সরকারি শিশু পরিবারে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় (১৩ জুলাই) আয়োজন করা হয় গায়ে হলুদ। একই স্থানে শুক্রবার দুপুরে হয় বিয়ের অনুষ্ঠান। আর সন্ধ্যায় পুলিশ সুপারের বাসভবন থেকে বর-কনেকে বিদায় দেয়া হবে।

জন্মের আগেই হাবিবার বাবা নুরু মিয়া মারা যান। চার বছর বয়সে মা খোদেজা বেগমও পরপারে চলে যান। ছয় বছর বয়সে মামা মোশারফ হোসেন ও মামি লুৎফা বেগম তাকে সরকারি শিশু পরিবারে দিয়ে যান। মা-বাবার আদর-স্নেহ ছাড়াই সরকারি শিশু পরিবারে ১২ বছর কাটিয়ে বড় হয়েছে এতিম হাবিবা। হাবিবা সেলাই, বুটিক ও কম্পিউটারের উপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

শুক্রবার শিশু পরিবার থেকে হাবিবার আনুষ্ঠানিক বিদায় হবে। শিশু পরিবারের সর্বত্রই এখন উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।

সরকারি শিশু পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের শেষের দিকে হাবিবার বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয়। নীতিমালা অনুসারে কারো বয়স আঠারো হলে তাঁকে শিশু পরিবার ছাড়তে হয়। ফলে, ডাকা হয় হাবিবার মামা-মামিকে। বিদায় বেলায় শিশু পরিবারের উপ-তত্ত্বাবধায়ক রওশন আরার ওড়না ধরে টানতে শুরু করে হাবিবা। দৃশ্যটি ভালোভাবেই স্পর্শ করে রওশান আরার মনকে। হাবিবাকে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নেন রওশন আরা। পরিচালনা কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে দুই মাস পরে মামা-মামির কাছ থেকে হাবিবাকে শিশু পরিবারে নিয়ে আসেন রওশন আরা।

পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের ভাবনা থেকে হাবিবার বিয়ে দেয়ার চিন্তায় পৌঁছেন রওশন আরা। বিষয়টি নিয়ে পুলিশ সুপার মিজানুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন। যদি কোনো ভালো ছেলের খোঁজ পাওয়া যায় তাহলে সেই ছেলেরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান সম্মত হন।

জানা গেছে, কসবা উপজেলার খাড়েরা ইউনিয়নের সোনারগাঁও গ্রামের ফরিদ মিয়ার ছেলে জাকারিয়া আলম। হাবিবার মামা-মামির সঙ্গে কথা বলে বিয়ের বিষয়টি পাকাপোক্ত করা হয়। ২০১৬ সালে পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। কনস্টেবল নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলে চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন বলে পুলিশ সুপার আশ্বস্ত করেন।

রওশন আরার স্বামী ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের টি এ রোড শাখার ব্যবস্থাপক মাজহারুল ইসলাম জাকারিয়াকে প্রস্তুত করার দায়িত্ব নিলেন। গত ১০ বছরের কনস্টেবল পদে নিয়োগের প্রশ্নপত্র বের করে ৮/১০দিন পড়িয়ে জাকরিয়াকে প্রস্তুত করেন। ছয় মাসের ট্রেনিং শেষে জাকারিয়া এখন কুলিল্লায় কর্মরত আছেন।

পরবর্তীতে পুলিশ সুপার বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব নেন। এসময় এগিয়ে আসেন শিশু ও প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকার।

হাবিবার বিয়ে নিয়ে তাঁরা কথা বলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সংসদ সদস্য উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে। তাঁরা হাবিবার জন্য ভালোবাসার উপহার নিয়ে উপস্থিত থাকার আশ্বাস দেন। বিয়ের কাজে যুক্ত হন সমাজ সেবা অধিদপ্তর ও সরকারি শিশু পরিবার সংশ্লিষ্টরা।

সরকারি শিশু পরিবারের উপ-তত্ত্বাবধায়ক রওশন আরা জানান, হাবিবা তার মামা-মামির সঙ্গে যেতে চাচ্ছিলো না। আমার উড়না ধরে হাতে পেঁচাতে শুরু করে। এটি দেখেই তাঁকে শিশু পরিবারে রেখে কোনো কাজ দেওয়া বা পুনর্বাসন করা যায় কি না এসব চিন্তা থেকেই বিয়ের পর্যন্ত চলে আসা। মেয়েটির জন্য কিছু করতে পারায় আমি মানসিক তৃপ্তি পাচ্ছি।

পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, এই জেলার জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সুশীল শ্রেণির  সবাই বিয়েতে হাবিবার পাশে দাঁড়িয়েছে। আর শিশু পরিবারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি জেলা পুলিশ সবসময় দিয়ে এসেছে।

তিনি আরও বলেন, বদলে যাচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। হাবিবা আমাদের জন্য একটি উদাহরণ। আমরা চাইলেই একটি সাধারণ বিষয়কে অসাধারণে রূপ দিতে পারি। শুধু আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। তাহলেই সবার পাশে আমরা দাঁড়াতে পারব।

Comments

The Daily Star  | English

Taka to trade more freely by next month

Bangladesh will introduce a crawling peg system by next month to make the exchange rate more flexible and improve the foreign currency reserves, a key prescription from the International Monetary Fund.

5h ago