সু চি'র ভাষণ রোহিঙ্গাদের জন্য নয়

Suu Kyi
মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দুই দশকের বেশি সময় শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছেন তিনি। শান্তিতে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতায় আসার দেড় বছরের মধ্যেই তার রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব প্রকাশ পেয়েছে। ফাইল ফটো

রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নিধনের চলমান সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নিন্দা এবং সমালোচনার ঝড়ের মুখে অং সান সু চি অবশেষে নীরবতা ভাংছেন। আগামী কাল (সেপ্টেম্বর ১৯) মিয়ানমারের  জনগণের উদ্দেশে ভাষণ দিবেন; রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কথা বলবেন। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার রক্ষায় আন্দোলনের স্বীকৃতি হিসাবে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সু চি বক্তব্য দিয়ে  কি বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন? নাকি রোহিঙ্গা নিধনে নেতৃত্বদানকারী সামরিক বাহিনীকে খুশি করতে তিনি তার সরকারের বিদ্যমান নীতিকেই অনুসরণ করবেন?

বর্তমানে সু চি'র সরকার রোহিঙ্গাদের দমন, নিপীড়ন, নির্যাতন এবং নিধনের সকল প্রমাণ এবং অভিযোগ অস্বীকার করে চলেছে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে এক দফা রোহিঙ্গা নিধন সম্পন্ন করার পর থেকে মিয়ানমার সরকার এই নীতি অবলম্বন করেছে। যার ফলে, রোহিঙ্গা বিরোধী সামরিক বাহিনী এবং চরমপন্থী বৌদ্ধদের সন্তুষ্ট রাখতে পেরেছে।

কয়েকটা উদাহরণ দিলেই সু চি'র সরকারের রোহিঙ্গা নিধন পরিষ্কার হবে:

গত বছর অক্টোবরে রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা, নির্যাতন এবং ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত হয় সে দেশের সামরিক বাহিনী। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের এই বছর ফেব্রুয়ারীতে দেয়া এক প্রতিবেদনেও এমন অভিযোগ করা হয়েছে, এবং এসব কে মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ সব অভিযোগের তদন্ত করতে এই বছর মে মাসে জাতিসংঘ একটা তদন্ত কমিশন গঠন করে। কিন্তু সু চি'র সরকার কমিশনকে মিয়ানমারে প্রবেশ করতে দেয়নি।

আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনার মুখে তারা নিজেরাই অভিযোগের তদন্ত করতে উপরাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে  একটা কমিটি করে। সে কমিটি যে প্রতিবেদন দেয় তাতে সু চি'র সরকারের নীতিরই প্রতিফলন ঘটে। প্রতিবেদনে বলা হয় যে,  হত্যা, নির্যাতন এবং ধর্ষণের অভিযোগের কোন সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় নি। কমিটির প্রধানের মতে, সকল অভিযোগ ছিল মিয়ানমারের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক মহলের অপপ্রচার। তদন্ত শুরু হবার আগেই সু চি তার দেশে রোহিঙ্গা জাতিগত নিধনের অভিযোগ অস্বীকার করেন।

সু চি'র মানসিকতায় পরিবর্তন আসেনি।গত ২৫শে আগস্ট থেকে আবার রোহিঙ্গা নিধন শুরু হলেও তিনি এ মানবতাবিরোধী অপরাধের নিন্দা জানান নি। বরং সামরিক বাহিনীর চলমান অভিযানের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন; বলেছেন, জঙ্গি দমনের অভিযান চলছে। ভুল তথ্যের ভিত্তিতে নাকি অভিযানের সমালোচনা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সমালোচনা করে তার সরকারের পক্ষ থেকে পাল্টা প্রচারণা শুরু করা হয়েছে। 

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বর্বরোচিত অভিযানের মুখে প্রাণ বাঁচাতে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা ইতিমধ্যে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে|এই নিপীড়ন অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। গত কয়েক দশকের পরিকল্পিত রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়া মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এখন গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। সারা বিশ্বজুড়ে নিন্দা-সমালোচনার ঝড় বইছে। অন্যদিকে, রোহিঙ্গা নিধন বন্ধে  উদ্যোগ নেয়া তো দুরের কথা, তিনি এই বিষয়ে নীরব ভূমিকা পালন করে আসছেন। এই নীরবতার কারনে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সু চি'র বিশ্বজুড়ে তীব্র সমালোচনা চলছে। বিশ্বনেতাদের প্রশ্নের তোপের মুখে না পড়ার জন্য, জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদান থেকে বিরত রয়েছেন। অবশেষে নীরবতা ভেঙ্গে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছেন।

তবে সু চি'র ভাষণের দুই দিন আগে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক, যিনি সেনবাহিনীরও প্রধান, রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হবার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আহবান জানিয়েছেন। রোহিঙ্গারা কোনদিন মিয়ানমারের নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠী ছিল না বলেও তিনি দাবি করেন।

মিয়ানমারের সরকার, সামরিক বাহিনী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনগণকে ইতিমধ্যে ঐক্যবদ্ধ করেছে রোহিঙ্গা বিদ্বেষ। সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়কের আহবান বিদ্যমান রোহিঙ্গা বিদ্বেষকে আরও জোরালো করবে।

এই দফা সহিংসতা শুরু হবার আগের দিন জমা দেয়া জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের প্রতিবেদনে অনেকগুলো সুপারিশের মধ্যে অন্যতম ছিল রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধান।মিয়ানমারের জান্তা সরকার ১৯৮২ সালে এক কালা-কানুন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব হরণ করেছে। সেই থেকে তারা মানব জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ধরনের মৌলিক চাহিদা প্রাপ্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত। কফি আনান কমিশন প্রতিবেদন জমা দেয়ার পরদিনেই নিরাপত্তা বাহিনীর উপর জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে এবং সামরিক বাহিনী জঙ্গি দমনে অভিযান শুরু করে। যার ফলে, সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে রাখাইন রাজ্যে। কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন না করতে সহিংসতার জন্ম দেয়ার পেছনে সামরিক বাহিনীর কোন ইন্ধন ছিল কি না সেটাও ভেবে দেখা দরকার।     

জাতিসংঘ মহাসচিবের সতর্কবার্তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।মিয়ানমারের জনগণের উদ্দেশ্যে দেয়া সু চি'র ভাষণকে তিনি সু চি'র শেষ সুযোগ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। এখন যদি সু চি সহিংসতা বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে না  পারেন তাহলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। 

এমন পরিস্থিতিতে সু চি তার ভাষণে যদি সামরিক বাহিনীকে খুশি করেন এবং তার সরকারের বর্তমান নীতির পুনর্ব্যক্ত করেন তাহলে অবাক হবার কিছু নেই। কেননা সামরিক বাহিনীকে চটিয়ে ক্ষমতায় থাকা কঠিন হবে সেটা সু চি ভাল করেই জানেন।

দুই দশকের বেশি সময় ধরে গণতন্ত্র অর্জনে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়ে, ক্ষমতায় আসার দেড় বছরের মধ্যেই তার নেতৃত্বের দেউলিয়াত্ব প্রকাশ পেয়েছে | তার নীরবতা কি প্রমান করে না যে শুধু ক্ষমতার লোভেই তিনি সামরিক বাহিনীর সকল মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে সায় দিয়ে যাচ্ছেন?

তিনি নিজেও এক সেনা জেনারেলের কন্যা। তার বাবাও ক্ষুদ্র নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠীর অধিকারের পক্ষে ছিলেন না। সেই বাবার সন্তান হয়ে সু চি কী করে রোহিঙ্গাদের পক্ষে কথা বলবেন? জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে সু চি সহিংসতার লাগাম টেনে ধরার কথা বলবেন নাকি সহিংসতাকে আরও উস্কে দেবেন যাতে রোহিঙ্গা নিধনের অসমাপ্ত কাজ দ্রুত শেষ করা যায়?

তবে এ কথা ঠিক যে, তিনি ভাষণ দেবেন মিয়ানমারের জনগণের উদ্দেশ্যে । রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং সু চি'র সরকার সে দেশের জনগণ হিসাবে স্বীকার করে না। তাই বলা যায় তার ভাষণ রোহিঙ্গাদের জন্য নয়।

Comments

The Daily Star  | English

Gunfight on Meghna: ‘Robbers’ attack new police camp in Munshiganj

Police suspect arms used in attack were stolen from other police stations last year

1h ago