লালব্রিজ গণহত্যা: মুক্তিযুদ্ধের অজানা অধ্যায়

১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনী বাংলাদেশে অসংখ্য নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে তুলেছিল। সেখানে হাজার হাজার মা-বোন, যুবা-বৃদ্ধা, শিশু-কিশোরদের দিনের পর দিন নির্যাতন চালিয়ে অবশেষে তাদের হত্যা করে কবরের নামে যততত্র মাটিচাপা দিয়ে রেখেছিল। একাত্তরের ঘাতকদের জল্লাদখানা ও বধ্যভূমি আবিষ্কারের চাঞ্চল্যকর সংবাদ বিভিন্ন অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে। তবে এগুলো গত ৪৫ বছরে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি। তাই বলা যায় এগুলো মুক্তিযুদ্ধের এক অজানা অধ্যায়।
Lalbridge-massacre-book-cover

১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনী বাংলাদেশে অসংখ্য নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে তুলেছিল। সেখানে হাজার হাজার মা-বোন, যুবা-বৃদ্ধা, শিশু-কিশোরদের দিনের পর দিন নির্যাতন চালিয়ে অবশেষে তাদের হত্যা করে কবরের নামে যততত্র মাটিচাপা দিয়ে রেখেছিল। একাত্তরের ঘাতকদের জল্লাদখানা ও বধ্যভূমি আবিষ্কারের চাঞ্চল্যকর সংবাদ বিভিন্ন অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে। তবে এগুলো গত ৪৫ বছরে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি। তাই বলা যায় এগুলো মুক্তিযুদ্ধের এক অজানা অধ্যায়।

চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা থানার লালব্রিজ হিসেবে পরিচিত রেল ব্রিজের কাছে যুদ্ধ চলাকালে পাক ঘাতকরা ট্রেন থামিয়ে স্বাধীনতাকামী প্রায় দুই হাজার নারী-পুরুষকে হত্যা করে ব্রিজের পাশে ওয়াপদা ভবনের সীমানার মধ্যে ও পার্শ্ববর্তী দুটি বধ্যভূমিতে পুঁতে রাখে। চাঞ্চল্যকর এই তথ্য ও বধ্যভূমির স্থান চিহ্নিত করেছেন আলমডাঙ্গা শহরের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সবেদ আলী এবং গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী বধ্যভূমির পার্শ্ববর্তী কামালপুরের সত্তরোর্ধ কৃষক আবুল হোসেন।

লেখককে আবুল হোসেন জানান, সে সময়ে তার জমিতেই প্রায় এক হাজার নারী-পুরুষকে খানসেনারা হত্যা করে পুঁতে রাখে। এছাড়াও, সবেদ আলী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর পাক হানাদারদের নৃশংসতা খুঁজতে গিয়ে ১৯৭২ এর জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে লালব্রিজের কাছের ওই বধ্যভূমি খনন করে চারশো মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড়ের ছবি তুলে রাখা হয়েছিল। তবে ওখানে আরও প্রায় এক-দেড় হাজার দেহাবশেষ রয়েছে তিনি উল্লেখ করেন।

পাকিস্তানি হানাদারদের জল্লাদখানা মিরপুরের বধ্যভূমি থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদদের মাথার খুলি ও হাড়গোড় তুলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে আলমডাঙ্গায় পাক হানাদারদের জল্লাদখানা এবং এর পাশের বধ্যভূমি খনন করলে স্বাধীনতাকামী প্রায় দুই হাজার শহীদের কঙ্কাল উদ্ধার করা যাবে। এতে ঐতিহাসিক গণকবরের সন্ধান মিলবে এবং বর্বরতার প্রমাণ পাওয়া যাবে।

বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আলমডাঙ্গা লালব্রিজের পাশের মাছ হাটের কাছে পাক হানাদাররা ডাউন ট্রেন থামিয়ে স্বাধীনতাকামী মানুষদের ট্রেন থেকে নামিয়ে পাশেই ওয়াপদার শেডের মধ্যে আটক রেখে নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাত। পরে তাদের হত্যা করে বধ্যভূমিতে পুঁতে রাখত। ট্রেন থেকে নামানো পুরুষদেরকে দিয়ে বধ্যভূমির গর্ত খোঁড়ানো হতো এবং শেষে তাদের হত্যা করে গর্তের মধ্যে ফেলে দিতো।

এই গণহত্যার প্রধান হোতা ছিল সালেহ জয়েন (লেফটেনেন্ট, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী), মেজর রানা, আব্দুল গফুর (কর্নেল, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, পিএসএস নং: ৯৩৮৭, পিওডব্লিউ: ১২৫৫), ক্যাপ্টেন মোজাফফর হোসাইন নাকভি (পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, পিএ নং: ২২০০, পিওডব্লিউ: ৫৮) এবং হাবিলদার এনায়েত খান।

কৃষক আবুল হোসেন জানান, বাঁশের মাথা সূচালো করে মানুষকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করত হাবিলদার এনায়েত। আবুল হোসেনের সামনেই প্রায় ২০ জনকে হত্যা করা হয়েছিলো। এই ব্রিজের উত্তর পাশে একটি বাগানেও রয়েছে আরও একটি বধ্যভূমি, যেখানে আরও কয়েক শত মানুষকে হত্যা করে পুঁতে রাখা হয়েছে। সম্প্রতি, বধ্যভূমি খনন এবং সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফলে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের অজানা অধ্যায় আলমডাঙ্গায় বর্বরতার আরেকটি প্রমাণ।

অজ্ঞাতনামা হাজারো শহীদ: লালব্রিজের উপর ট্রেন থামিয়ে নিয়মিত নারী, শিশু, যুবক, যুবতীদের নির্যাতন করে বিভিন্নভাবে হত্যা করে শেডের আশেপাশে গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দিতো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এভাবে জুন থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার মানুষকে হত্যা করে সেখানে মাটি চাপা দেওয়া হয়। তবে কারো পরিচয় সনাক্ত করতে পারেননি স্থানীয়রা। পরে স্বজনরা এসেও হতাশ হয়ে ফিরে যান। কারণ ট্রেনে উঠা মানেই নিরাপদে পৌঁছাবে, এমনটিই ভেবে নিয়েছিলেন স্বজনরা। অথচ হায়েনারা যে এমন তাণ্ডব চালাবে তা হয়তো কল্পনাও করেননি অনেকে। এছাড়াও, বিকল্প উপায় ছিল না কারো কারো। বেঁচে থাকা বা নিরাপদে যাওয়ার জন্য উন্মুখ এসব মানুষদের যাত্রাপথে আলমডাঙ্গা ওয়াপদা ডিভিশনে নামাত। পরে শিক্ষিত তরুণীদের বাংলোতে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানি অফিসাররা নির্যাতন করতো রাতভর। বেঁচে থাকার আকুতি হায়েনাদের কানে পৌঁছাতো না। এই অমানুষরা ২-৩ দিন পর সেসব নারীদের পুনরায় ফেরত পাঠাতো লালব্রিজের ক্যাম্পের হত্যা ও নির্যাতন সেলে। সাধারণ সৈনিকরা নির্যাতন করার পর তাদের হত্যা করে গর্তে মাটি চাপা দিত।

গণহত্যা-নির্যাতনের বিবরণ: আলমডাঙ্গা রেলস্টেশন থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার পূর্ব দিকে ব্রিজটির পশ্চিম প্রান্তে ছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সেচ গেট কিপারশেড ছিল নারী নির্যাতনের স্থান। ব্রিজটির উপর গাড়ি থামিয়ে নিয়মিত নারী, শিশু, যুবক-যুবতীদের নির্যাতন ও হত্যা করে শেডের আশেপাশে বড় গর্ত করে মাটি চাপা দেওয়া হতো। এভাবে জুন থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার মানুষকে হত্যা করে সেখানে চাপা দেওয়া হয়।

জানা যায়, ওয়াপদা ডিভিশনের বাংলোতে শিক্ষিতা নারীদের ট্রেন থেকে নামিয়ে ঐ ক্যাম্পে পাঠানো হতো। সেখানে পাকিস্তানি অফিসারদের নির্যাতন চলতো রাতের পর রাত। দুই বা তিন দিন পর সেই নারীদের পুনরায় ফেরত পাঠানো হতো লালব্রিজ ক্যাম্পের হত্যা ও নির্যাতন সেলে। সাধারণ সৈনিকরা নির্যাতন করে ও পরে তাদের হত্যা করে মাটি চাপা দিত। কত চিৎকার, কত রোদন-- তা দেখার বা শোনার কেউ ছিল না।

একাত্তরের জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই হত্যাযজ্ঞ ও পাশবিক নির্যাতন চলে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আলমডাঙ্গার নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ মাটিচাপা দেওয়া অসংখ্য নারী-পুরুষের মৃতদেহ চাক্ষুষ করেন।

মুক্তিযোদ্ধা এম সবেদ আলী বলেন, সেখানে ধানী জমিতে চাষ দিতে গেলে এখনো উঠে আসে মানুষের হাড়গোড়। মাটি খুঁড়লে মেলে মাথার খুলি। শুধু হাড়গোড় নয়, সোনার আংটি কিংবা কানের দুলও পাওয়া যায় মাটির নিচে। মৃত মানুষের শেষ চিহ্ন এখনো আলমডাঙ্গার মাটিতে মিশে যায়নি। গণহত্যার সাক্ষ্য বহন করে চলছে আলমডাঙ্গার মাটি।

যুদ্ধের পর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের নেতাদের সমন্বয়ে স্থানটি সনাক্ত করে মাটি খুঁড়ে অগণিত নারী-পুরুষের কঙ্কাল পাওয়া যায়। সে সময়ে দুর্গন্ধযুক্ত পচা-গলা লাশ সেখানেই আবার মাটি চাপা দেওয়া হয়। উক্ত স্থানে নারী-পুরুষ-শিশুসহ প্রায় দুই হাজারের বেশি মানুষকে হত্যার নিদর্শন রয়েছে। এখনও যদি ঐ স্থানে খনন করা হয় তবে সে সমস্ত লাশের নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়। (এম এ মামুন: চুয়াডাঙ্গায় একাত্তরের গণকবরের সন্ধান, ২ হাজার লোক হত্যা করে পুঁতে রেখেছে হানাদার বাহিনী, দৈনিক জনকণ্ঠ, ১ ডিসেম্বর ১৯৯৯)।

Lalbridge massacre
গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী বধ্যভূমির পার্শ্ববর্তী কামালপুরের সত্তরোর্ধ কৃষক আবুল হোসেনের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

নির্যাতিতদের মৌখিকভাষ্য

আবুল হোসেন: কি বলবো আর, সে সময়ের কথা মনে হলে কোনো কথা বের হয় না। কে যেন মুখ ধরে রাখে। গুনু মিয়ার বাপ বলে জানতাম যাকে, সে হয়ে গেল পিস কমিটির চেয়ারম্যান। আরেকজন হলেন সেক্রেটারি। মুগু, হারেছ কাজ করতো। কাজ মানে, পাকিস্তানি ক্যাম্পে ভাত রান্না করা। আমি সবার ছোট ছিলাম বলে পূর্ণ কাজ সম্ভব হতো না। তাই যোগালি (সহযোগিতা করা) দিতাম। বিনিময়ে প্রতিদিন দুই টাকা আর ভাতের মাড় খেতে পারতাম। এর মধ্যে আমাদের পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে প্রতিদিনের সংবাদ তথা কোথায় কী হচ্ছে তা যতটুকু সম্ভব পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টায় থাকতাম।

একদিন আমাদের বলে আজ (ব্রিজ সংলগ্ন বধ্যভূমিতে) ওইখানে গর্ত খুঁড়তে হবে। আমরা তো ভয়ে পাথর, কোনো কথা বলতে পারছি না। পিস কমিটির চেয়ারম্যান ইউসুপ মিয়া, সদস্য আহমেদ বুকড়া বাধ্য করেছে সেখানে যেতে। তাদের এতো প্রভাব ছিল যে কেউ তাদের কথা অমান্য করার সাহস করতো না। সকাল থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত তাদের এই কাজ (গর্ত খোঁড়া) করতে হতো। চারটার পর আমাদের কাউকে থাকতে দিতো না। তবে যে দৃশ্য দেখার সুযোগ হয়েছে তা মনে করলে বেহুঁশ হয়ে যাই। চারদিকে মানুষের মুখ থেকে শুনা যেত--  ও আল্লাহ গো, ও আল্লাহ গো, ও মা গো, ও মা গো। এমন আর্তনাদ-আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে যেতো।

দ্বিতীয় দিন যখন আমাকে নেওয়া হয়, সেদিন মনে হয় আমার জীবন যেন এখানে শেষ হয়ে যাবে। প্রথমে গিয়ে দুটি গর্ত খুঁড়ি। তাদের একজন অস্ত্র হাতে এসে বললো-- এই লোকটিকে ফেলে দে, এখনি ফেলে দে। আমি যেন জল্লাদ, গর্তের মধ্যে ফেলে দিলাম লোকটিকে। তখন আমার মাথা ঘুরছিল। একজন মানুষের মৃত্যু আমার হাতে! এও কী করে সম্ভব!

বর্তমান অবস্থা: স্থানীয়দের চেষ্টায় আলমডাঙ্গার বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়ে বর্তমান সরকার স্মৃতিফলক নির্মাণের কাজ শেষ করেছে। সেই সঙ্গে ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে সেখানে পরিকল্পিতভাবে ফুলের বাগান করা হয়েছে। বধ্যভূমির চারপাশে জনসাধারণের বসার জন্য কয়েকটি কংক্রিটের বেঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। সীমানা নির্ধারণের পর বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের কাজ চলছে। মুক্তিযুদ্ধ ও এই বধ্যভূমির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসংবলিত একটি বোর্ড লাগানো হয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এটি দেখতে আসেন। বর্তমানে চমৎকার পরিবেশ বধ্যভূমি প্রাঙ্গণে।

 

ইমরান মাহফুজ: কবি, গবেষক ও সম্পাদক কালের ধ্বনি, সমন্বয়কারী ডেইলি স্টার বুকস।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

9h ago