যে ব্রিটিশ নারীর অন্তরে বাংলাদেশ

মানবতার সেবা করবেন বলে নিজের জন্মভূমি ব্রিটেন ছেড়ে প্রায় আট হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল্ট। উচ্চ শিক্ষা শেষ করে ক্যাথলিক সিস্টার হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। উদ্দেশ্য ওই একটাই, অসহায় মানুষের সেবা করা। যুদ্ধ-মৃত্যু-বিভীষিকা পার হয়ে এই ব্রিটিশ নারী এখনো রয়ে গেছেন বাংলাদেশের মানুষের পাশে।
briton bangladeshi heart

মানবতার সেবা করবেন বলে নিজের জন্মভূমি ব্রিটেন ছেড়ে প্রায় আট হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল্ট। উচ্চ শিক্ষা শেষ করে ক্যাথলিক সিস্টার হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। উদ্দেশ্য ওই একটাই, অসহায় মানুষের সেবা করা। যুদ্ধ-মৃত্যু-বিভীষিকা পার হয়ে এই ব্রিটিশ নারী এখনো রয়ে গেছেন বাংলাদেশের মানুষের পাশে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোরে ফাতেমা হাসপাতালে আর্দালি হিসেবে কাজ করতেন লুসি। সেইসব দিনের স্মৃতি এখনও যেন তার চোখের সামনে ভাসে। বলেন, “ডাক্তার না হয়েও অনেক মানুষকে সেসময় চিকিৎসা দিয়েছিলাম। তখন একে তো ছিল ডাক্তারের স্বল্পতা। তার ওপর ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠায় আগের ডাক্তাররাও আগের মত হাসপাতালে আসতে ভয় পেতেন। আর মাত্র কয়েকজন ডাক্তারের পক্ষে সবার দেখভাল করাও সম্ভব ছিল না।” চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তো চোখের সামনে মানুষকে মরতে দেওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়েই তখন ডাক্তারের ভূমিকায় নামতে হয়েছিল তাকে।

তার মনে আছে, মুক্তিযোদ্ধাই হোক আর সাধারণ জনগণ, সবাইকেই সাধ্যমত সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। এমনও সময় গেছে যখন বুলেটের ক্ষতের চিকিৎসাও তাকেই করতে হয়েছে। লুসির ভাষায়, “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখতে পারা আমার বিশাল সৌভাগ্য।”

মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিক থেকেই ব্রিটেনে বন্ধুদের কাছে চিঠি লিখতেন লুসি। ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গুণমুগ্ধ। সেসব চিঠিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতেন। সেই সাথে থাকত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রশংসা। বন্ধুদের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সাড়াও পেয়েছেন তখন।

লুসি বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে আমি এতটাই শ্রদ্ধা করতাম যে ১৯৭২ সালে আমি নিজ হাতে একটি রুমাল তৈরি করে তার স্ত্রীর জন্য পাঠিয়েছিলাম।” বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা মায়ের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে প্রত্যুত্তরে তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বরই লুসির জন্মদিন। এ বছর যখন বাংলাদেশ ৪৬তম বিজয় দিবস উদযাপন করেছে ঠিক সেদিনই সিস্টার লুসি পালন করেছেন ৮৭ তম জন্মদিন। তাই কাকতালীয় হলেও মনে হতে পারে বাংলাদেশের সাথে লুসির সম্পর্ক বুঝি পূর্ব নির্ধারিত।

লুসির জন্য এ বছর আরেকটি আনন্দের কারণ ছিল। এ বছরই প্রথমবারের মত তিনি মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের স্বীকৃতি পেয়েছেন। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ তাকে পুরস্কৃত করেছে। পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে কিছুটা অপরাধ স্বীকার করার সুরেই জানিয়েছেন, এক পর্যায়ে তিনি ভেবেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অবদানের কোনো স্বীকৃতি আর হয়ত কোনোদিন পাবেন না। এ কারণেই পুরস্কারটি তার জন্য বিশেষ আনন্দদায়ক।

তাকে মনে রাখায় পুলিশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার জীবনের এটাই সেরা পুরস্কার।”

কখনো বাংলাদেশ ছেড়ে যাননি কেন, প্রশ্ন করতেই তিনি জানালেন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তার সীমাহীন ভালোবাসার কথা। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে তাকে বাংলাদেশ ছেড়ে যেতেও বলা হয়েছিল। কিন্তু শুধুমাত্র “মুক্তিকামী মানুষের পাশে” থাকার আকাঙ্ক্ষা তাকে বাংলাদেশ ছাড়তে দেয়নি।

জীবন সায়াহ্নে এসেও সামাজিক কাজে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন সিস্টার লুসি। বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনারি প্রাইমারি স্কুলে এখন অবৈতনিকভাবে ইংরেজি শেখাচ্ছেন তিনি। স্কুল কর্তৃপক্ষ যতদিন চাইবে ততদিন তিনি এই কাজ চালিয়ে যেতে চান। তার ভাষায়, “পরীক্ষায় ভালো ফল করার লক্ষ্য সামনে রেখে আমি ইংরেজি শিখাই না। শিক্ষার্থীদের সার্বিক কল্যাণের কথা মাথায় রেখেই আমি পড়াই। বাচ্চাদের কিভাবে যত্ন নিতে হয় মায়েদের সে শিক্ষা দেওয়ারও ইচ্ছা রয়েছে।”

সিস্টার লুসির জীবনের এখন শেষ ইচ্ছা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়া। স্বাধীনতা থেকে যে দেশের মানুষের জন্য সারা জীবন উৎসর্গ করেছেন এখন সেই দেশের মাটিতেই চিরনিদ্রায় শায়িত হতে চান লুসি। বাংলাদেশের ভিসা নবায়ন করতে এখন তাকে প্রতি বছর প্রায় ৩৫ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। বিশেষ কোনো আয় না থাকায় এই টাকা জোগাড় করাই তার জন্য কষ্টকর।

লুসির শেষ ইচ্ছা পূরণের উদ্যোগ নিয়েছেন বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার এসএম রুহুল আমিন। জানান, “লুসির দ্বৈত নাগরিকত্বের জন্য আমি ঢাকায় ইমিগ্রেশন পুলিশের সাথে কথা বলেছি। তাকে দ্বৈত নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে বলেছি।”

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

5h ago