বিশ্বনন্দিত মূকাভিনেতা পার্থ
ফ্রান্সের সর্বোচ্চ পুরস্কার অর্জনকারীর একজন। মাইম শিল্পের জন্য এই প্রথম কোনো বাঙালি এমন পুরস্কার পেলেন। পুরস্কারটি পাওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের মূকাভিনেতা পার্থ প্রতীম মজুমদারকে নিয়ে আগ্রহ আর কৌতূহল চারদিকে। এই সংবাদে, ফ্রান্সের প্রবাসীরা তো বটেই, পার্থ প্রতীম মজুমদারের সাফল্যে আনন্দিত হয়েছেন তামাম বিশ্বের বাঙালি। এরপর, বলিউডের বিগ বি-খ্যাত অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন এবং বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খান এ পদক লাভ করেন।
অন্য আট-দশজন ছেলে মেয়ের মতো পার্থর পরিবারও মধ্যবিত্ত। কিন্তু তাঁর বেড়ে উঠা একটু অন্যরকম। তাঁর জীবন চলা, স্বপ্নধারা, কাজের ধরন অনেকের কাছে গল্পের মতো। তবে সব কিছুতেই রয়েছে গভীর নিষ্ঠা ও দরদ। বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার মতো অর্থাৎ সময়কে মোকাবেলা করার মতো প্রচণ্ড কৌশলী পার্থ! বিষয়টি অনেককেই চমকে দিবে, ফেলে দিবে ভাবনায়। স্বপ্নগ্রস্ত মনে তৈরি করবে দেয়াল। কী করে তা সম্ভব? হ্যাঁ, স্বপ্নবাজরাই পারেন অসম্ভবকে সম্ভব করতে। তাঁর মুখেই শুনি তিনি কেমন করে সবার মনে স্থান করে নেন এবং গোটা বিশ্বে নিজের অবস্থান দখল করেন।
‘… বজলুল করীমের ড্রামা সার্কেল নামে নাট্যদলের সাথে কাজ করতাম তখন। বাংলাদেশে সে প্রাচীন নাট্যদলে অভিনয়সহ সকল কাজে অংশগ্রহণ ছিলো নিয়মিত। সেখানে আমার শৈল্পিক অভিনয়ে মুগ্ধ অনেকে। কাজও করতাম গভীর মনোযোগ দিয়ে। বিন্দু অবহেলা করতাম না এবং ‘শিক্ষাঙ্গণ’ করতে করতে পপুলার ছিলাম সবার কাছে, সমানভাবে। আর ‘শিক্ষাঙ্গণ’টা হচ্ছে তৎকালীন সময়ে বিটিভির একটি ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের নাম। যেটি বাংলাদেশের প্রায় সবাই দেখতো। ‘রংধনু’ হেদায়েত হোসেন মোর্শেদ করতেন আর ‘আপনপ্রিয়’ করতেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। অনুষ্ঠানে মাইমের পর্বটি বাচ্চাদের ভীষণ প্রিয় ছিলো। আমার নিঃশব্দ অঙ্গভঙ্গির মধ্যে এমন একটা বিষয় দেখা যেতো, যা অনেকটা কার্টুনের মতো; তা দেখে বাচ্চারা অনেক মজা পেতো। কথা হচ্ছে- কেউ যদি পরিবারের বাচ্চাদের খাবার খাওয়াতে পারে তা হলে সে পুরো পরিবারটিকে পেয়ে যায়। সেভাবে আমি জনপ্রিয় হই। এখনো অনেকে ফোন করে বলে- ‘আমার বাচ্চা যখন খাবার খেতে চাই তো না, তখন আপনার অনুষ্ঠানের অপেক্ষায় থাকতাম। বাচ্চারা অনুষ্ঠান দেখতো আর মজা করে খাবার খেতো।’ এভাবেই জয় করেন বাচ্চাদের মন।
একদিন শিল্পকলা একাডেমিতে ফরাসি রাষ্ট্রদূত আমাকে বললেন- তুমি তো অনেক ট্যালেন্টেট, তুমি কেন প্যারিসে ট্রাই করছো না। আমি বললাম যে, অনেক দিন বাইরে ছিলাম। এখন আর যাওয়ার ইচ্ছা নেই। কিছুদিন পরে তাঁর স্পেশাল সহযোগিতায় আট মাসের স্কলারশিপ পেয়ে যাই। এবং সে সময় মূকাভিনয়ের ভগবান মার্সেল মার্শোর ছবি দেখেছিলাম। যা আমাকে খুব অনুপ্রাণিত করেছিলো। তারপর ১৯৮১ সালে চলে যাই প্যারিসে। তখন এশিয়ায় প্রথম কেউ মাইমের উপর স্কলারশিপ পায়, মর্ডান মাইমের জন্মদাতার স্কুলে।
সেখান থেকে চলে আসার দুইমাস আগে আমার বন্ধু বললো- প্যারিসের বাইরে মাইমের একটি শো হচ্ছে। যেতে পারিস। ঐদিন যদি না যেতাম তাহলে আজকের আমি আমি হতাম না। অথচ তখন আমার প্রথম প্রশ্ন ছিলো টিকেটের দাম কতো? কারণ (বাংলাদেশে আমি ছিলাম প্রফেশনাল, আর ওখানে শিক্ষার্থী) আমার স্কলারশিপের টাকার পরিমাণ খুবই কম ছিলো। আর হয়তো আসতে পারবো না ভেবে- আমি আমার ওখানে থাকা বন্ধুসহ যাই। বিরাট একটি পার্কের মধ্যে তাঁবু টাঙিয়ে মাইমের শো হচ্ছে। সেটি দেখতে চললাম। বসলাম গিয়ে গ্যালারিতে। অসাধারণ শো ছিলো যা কখনো কল্পনাও করেনি। শো শেষ হওয়ার পর মার্শো আগ্রহীদের সাথে বিশেষ একটি জায়গায় দেখা করছেন। আমারও আগ্রহ হলো দেখা করার। সাথে থাকা বন্ধু চলে গেলো। কিন্তু আমি দেখা করবো, ভাবছি কিভাবে করবো? এই লাইনে দাঁড়ালে আমার আর ওইদিন বাসায় যাওয়া হবে না। তখন ছিলো শীতকাল। ট্রেনে না যেতে পারলে অন্য বাহনে যাওয়া সম্ভব না। তখন রাত প্রায় ১১টা। তাছাড়া বাড়তি টাকাও ছিলো না। তাই আমি বুদ্ধি করে চু মেরে ঢুকে যাই তাঁর কাছাকাছি। এবং হাত দুটো জোড় করে প্রার্থনার মতো দাঁড়ালে কাছে টেনে নেয় মার্শো। আমি কে জানতে চায়। আর এখানে যাঁরা তাঁর সাথে দেখা করতে লাইনে দাঁড়িয়েছে তাঁরা ভাবছে আমি এ কোম্পানির লোক। সেই সুযোগে আমি বিনয়ের সাথে একটি অটোগ্রাফ নিতে চাই। মার্সেল মার্শো জানতে চায়- ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?, আমি বললাম- ফ্রম বাংলাদেশ, সে আবার বললো- ব্যাংলাদ্যাশ? তখনো ওরা ইন্ডিয়া, নেপাল, বার্মা চিনে কিন্তু বাংলাদেশকে চিনে না। তারপরও চেনানোর চেষ্টা করলাম। যাই হোক চিনলেন না। আমাকে অটোগ্রাফ দেওয়া হলো। কিন্তু আমার এই অটোগ্রাফ নিয়ে হোস্টেলে যখনি ফেরত এলাম এবং এটি তাদের দেখালাম কেউ তা বিশ্বাস করেনি। কারণ, তখন সে পৃথিবীর বিখ্যাত লোক। আমার সাথে তাঁর দেখা হওয়াটা স্বাভাবিক ছিলো না। তাঁর সাথে দেখা হওয়ার আগে অনেকগুলো ভিডিও পৌঁছাতে হয়। যা আমি করিনি। এতে মনে হয় জগত জয় করে ফিরে আসলাম!
তিন/চার দিন পরে আমি তাঁর সাথে দেখা করতে যাই। পড়ার টেবিলে থাকা একটি ফুলের তোড়া নিয়ে। মার্শোর এলাকায় ঢোকার সাথে সাথে বাড়িতে থাকা কুকুরের মতো তেড়ে আসে লোকজন। আমি কে, কেন এসেছি? ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর আমি তাদেরকে মার্শোর সাথে দেখা করার কথা বললাম, হলো না। জানালো সে আমেরিকায়। ফিরে আসতেই বাংলাদেশকে প্রেজেন্ট করার উদ্দেশ্যে তাদের হাতে ফুল দিলাম। বললাম দুজনে হাফ হাফ ভাগ করে নাও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। তখন তারা একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে। আমি তা দিয়ে আবার ফিরে আসতেই, হাতে থাকা অটোগ্রাফটি দেখালাম। তখন তারা অবাক হলো এবং আমাকে ভিতরে নিয়ে গেলো। বসিয়ে বুঝিয়ে বললো- সে পৃথিবীর বিখ্যাত লোক। তাঁর সাথে দেখা করার জন্য সারা পৃথিবী থেকে শিক্ষার্থীরা আসেন লাখ লাখ টাকা খরচ করে। তাঁরাও সবাই দেখা করতে পারে না। ঠিক আছে তবু তুমি আগামী সোমবার এসো। দেখা হবে। তবে আমরা দুঃখিত মিথ্যা বলার জন্য।
যথারীতি সোমবারে গেলাম। অনেক পথ পার করে অবশেষে দেখা হলো পৃথিবী বিখ্যাত লোকটির সাথে। তাঁর অসাধারণ বিনয়ে মুগ্ধ হলাম। কত বড় লোক, আর কত সহজেই না একজন সাধারণ বাঙালিকে গ্রহণ করলো। আমাকে যেভাবে কাছে নিয়েছে, তা কোনোভাবেই ভোলার নয়। আমার কাছে থাকা ফুল দিলাম। সেও খুশিতে আত্মহারা ফুল পেয়ে। কুশল বিনিময় করে একে একে প্রতিষ্ঠানের সব বুঝিয়ে বললো। পরে ক্লাসরুম দেখিয়ে উপস্থিত থাকা ছাত্রদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। এক অভূতপূর্ব সন্ধিতে আমাকে সুযোগ দিলো, তার প্রতিষ্ঠানে তিন বছরের কোর্স করার জন্য। অথচ অনেকে আগ্রহ নিয়ে, সারা পৃথিবীর ছাত্ররা আসলেও সবাই সুযোগ পায় না। প্রতি ব্যাচে সুযোগ পায় মাত্র ৩০/৪০জন। তাঁদের মধ্যে আমি একজন সৌভাগ্যবান। আনন্দের শেষ নেই। আমাকে সে বাবার মতো আদর সোহাগে নিজের করে নিলো। দিনে দিনে ঘুরিয়েছে সারা পৃথিবী। আমার মনে হয়- একজন ভালো ছাত্র হওয়ার জন্য, ভালো শিক্ষক পাওয়া জরুরি, তা আমি পেয়েছি।
খ
আরেক একটু পিছনে ফেরা যাক। আমরা বাঙালি। আমাদের সবার জীবনের প্রথম দিকের সময় থাকে, যা দেখা বা অদেখার মতো। তবে কারো কারো জীবনকাল হয়ে যায় ইতিহাস। শুনতেই ভালোই লাগে। যদি হয়ে থাকে অদ্বিতীয়ের কথা! মিরাকলের মতো চেয়েই থাকে সময়। যা অনেক অনেক দিন আগেই কামনা করেছিলো- কবি জীবনানন্দ দাশের মা শ্রী কুসুমকুমারী দাশ- আমার দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না হয়ে কাজে বড় হবে। সত্যি এবার কথার চেয়ে বড় হয়েছে আমাদের মানু। যাঁকে আমরা এখন জানি- পার্থ প্রতীম মজুমদার নামে। যিনি গোটা বিশ্বে পরিচিত হয়েছেন নন্দিত মূকাভিনেতা হিসেবে। বাংলার মুখ উজ্জ্বল করেছেন বহির্বিশ্বের বুকে। আপনালোয় দেখিয়ে দিয়েছেন বিশ্বের মানচিত্রে মাতৃভূমির সবুজ পতাকা। ২৬ বছরের ফ্রান্স প্রবাসী এই মাইম শিল্পী মাইমের বিচারে বিশ্বে দ্বিতীয়। যেখানে যান উজ্জ্বল করে আসেন বাংলাদেশের মুখ। বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে মাইম প্রদর্শন করে প্রচুর সুনাম অর্জন করেন পদ্মাপারের এই ছেলে। মালয়েশিয়ার সাংবাদিকদের কাছ থেকে 'মাস্টার অব দ্য ওয়ার্ল্ড' উপাধি লাভ করা ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু আন্তর্জাতিক সম্মান ও পুরস্কার লাভ করেছেন। কেমন ছিলো নিঃশব্দের কবি পার্থর হেঁটে চলার সে সময়-
ভুবন বিখ্যাত মূকাভিনেতা পার্থ প্রতীম মজুমদার ১৯৫৪ সালে ১৮ জানুয়ারি পাবনা জেলার কালাচাঁদপাড়ায় পার্থ প্রতীম মজুমদার জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হিমাংশু কুমার বিশ্বাস। ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে মানুষ হয়েছেন। পার্থ প্রতীমের দাদা ছিলেন প্রতাপশালী জমিদার। জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হলে হিমাংশু মজুমদার পরিবার পরিজনসহ পাবনা শহরে এসে বসতি স্থাপন করেন। বাবা মায়ের তিনি দ্বিতীয় সন্তান। মা ছিলেন সুশ্রিকা বিশ্বাস। ভাই বোনের সংখ্যা ছিল চারজন। তিনি ছাড়া ছোটবড় আরও তিন ভাই আর চার ভাইয়ের একটিমাত্র বোন।
পার্থ প্রতীমের আসল নাম প্রেমাংসু কুমার বিশ্বাস। ডাক নাম মানু। সে সময় ১৯৭২ সাল। তখন পার্থ ভারতের চন্দননগর কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে আইএসসি পাশ করে বাড়িতে আসেন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। যুদ্ধের সময়টাতে শরণার্থী হয়ে ভারতে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশে ফেলে আসা বাড়িঘর দখল করে নিয়েছিলো এক পাকিস্তানি মেজর। সেই যুদ্ধ শেষ হল। মেজরদের দৌড়াত্ব আর দুরাত্মারা এদেশের মানুষের কাছ থেকে ক্ষমা ভিক্ষা নিয়ে নিজ দেশে চলে গেল। পার্থরা ফিরে আসেন রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার বাগডুলি গ্রামের বাড়িতে। সেই বাড়িতে আসতেন বারীণ মজুমদার। শাস্ত্রীয় সংগীতের মহাওস্তাদ তিনি। ঢাকায় সংগীত মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা বারীণ মজুমদার ছিলেন হিমাংশু কুমারের দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়। হিমাংশু কুমার তাঁকে মামা ডাকতেন। বারীণ মজুমদার প্রায়ই আসতেন পার্থদের বাড়িতে। যুদ্ধের পরেও সেই আসা থামেনি। ইতোমধ্যে তিনি তাঁর একমাত্র মেয়েকে হারিয়েছেন। সেও সেই স্বাধীনতা যুদ্ধে। তিনিই বললেন বাবাকে। ‘হিমাংশু, তোরতো চার ছেলেমেয়ে আর আমার আর তোর মামিমার তো বড় ছেলে ছাড়া কেউ নেই। তুই মেজ ছেলেটিকে আমাকে দে। ওর শিল্পী হওয়ার ইচ্ছা। আমার কাছ থেকে কিছু শিখুক। হিমাংশু রাজি হলেন। রাজি হলেন সুশ্রিকা বিশ্বাসও। ফলে ‘ভীম’-কে দত্তক নিতে বারীণ মজুমদারের কোন অসুবিধাই হলো না। পালক পুত্রকে নিয়ে তিনি ঢাকায় তাঁর বাসায় ফিরে আসেন। নাম পরিবর্তন করলেন। নিজের পরিবারের সাথে মিলিয়ে প্রেমাংশু কুমার বিশ্বাস থেকে বদলে দিলেন পার্থ প্রতীম মজুমদার নামে। তারপর তাঁকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় সংগীত মহাবিদ্যালয়ে।
সে প্রসঙ্গে পার্থ প্রতীম মজুমদার বলেন- সংগীতশিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করি পুরো ঢাকা শহরে। মিউজিক কলেজে দুপুরের পরে আর ক্লাস থাকতো না। আমি থাকতাম প্রিন্সিপাল স্যারের রুমের পাশে। ক্লাসের পরে ফাঁকা রুমে নিজে নিজে নিঃশব্দে অভিনয় করতাম। একদিন এক স্যার আমাকে দেখলেন। জিজ্ঞাস করলেন- কি করছিস রে মানু? আমি বললাম- কথা না বলেও অভিনয় করা যায়, একটা বিষয় সুন্দর করে বোঝনো যায়। বিষয়টা শুনে টিভিতে অভিনয় করার কথা বললেন। স্যার আমাকে কয়েকদিন পরে হেদায়েত হোসেন মোর্শেদের কাছে পাঠালেন। তিনি তখন বিটিভিতে একটি নিয়মিত অনুষ্ঠান করতেন। বিভিন্ন ধরনের নতুন বিষয় নিয়ে। যা সচরাচর দেখা যেতো না। তো আমাকে সে অনুষ্ঠানে তিন মিনিটের সুযোগ দেওয়া হয়। সেটাই হলো আমার প্রথম টিভি শো।
গ
ইতিহাস পড়লে দেখি যাঁরাই বড় হয়েছেন তাঁদের প্রত্যেকের পরিবারের একটা আলাদা আবহ থাকে। যা তাঁকে সাধারণ থেকে অসাধারণ করে তোলতে সাহায্য করে। তাতে সে হয়ে উঠে অনেকের প্রিয়ভাজন। পার্থও সেরকম একজন। শুনি তার মুখেই পরিবারসহ মাইমে আসার অনুপ্রেরণার প্রথম পর্ব-
‘আমার বাবা ছিলেন পাবনার বিখ্যাত ফটোগ্রাফার। ছিলো খুব সুন্দর একটি স্টুডিও। স্লাইডে চলতো ছবির ভিডিও। হলেও চলতো ভিডিওটি। ওখানে আমি ও আমার ছোট ভাইয়ের ছবি দেওয়া ছিলো। আমার ছবিটি পেন্ট পরা হামাগুড়ি অবস্থায়, ছোট ভাই নেংটো হয়ে। এভাবে আমাদের দুই ভাইয়ের ছবি ছিলো। তার নিচে লেখা ছিলো- মধুর স্মৃতি ধরে রাখুন। রূপসা স্টুডিও, পাবনা। আমাদের ভিডিওটি দেখে আনন্দ পেতাম নিজে নিজে।
শরীরের দিক থেকে আমি ছিলাম হাল্কা গঠনের। ওভাবে কোনো কাজ করতে পারতাম না। তবে যে কোনো বিষয়ের দিকে খেয়াল করলে তা নকল করতে পারতাম বডি ল্যাংগুয়েজের মাধ্যমে। বাড়িতে ফকির আসলে কিভাবে ভঙ্গি করতো, তা আমি দেখাতাম। নিজে নিজে কথা না বলে অভিনয় করতাম ছোটবেলা থেকে। ফরিদপুরে মামা বাড়ির পাশে বছরে দুবার নাটক হতো। আমরা তা দেখে ভীষণ অনুপ্রাণিত হতাম। অবচেতন মনে তা করতাম। একদিন আমরা যেখানে থাকতাম তার পাশের ফ্ল্যাটে একটা লোক এ রকম অঙ্গভঙ্গি করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে হাত-পা নাচাচ্ছে। আমি প্রথম প্রথম পাগল ভাবতাম। পরে একদিন কাছে গেলাম। মজা পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। মনে মনে ভাবলাম আমিও তো করতে পারি বিষয়টা। তারপর উনার কাছে শিখতে চাইলাম, তিনি প্রথমে রাজি হননি। পরে লেগেই আছি দেখে, দেখিয়ে দিলেন একদিন। সেটাই আমার প্রথম বেইস। তারপর তো ঢাকা, কলকাতা, পরবর্তীতে ফ্রান্সেই মূকাভিনয় জীবন। তবে একই জিনিস কখনো বারবার করেনি। পরিবর্তনে বিশ্বাসী।
আমি মনে করি- পৃথিবীতে নীরবতার যে একটি সংগীত আছে, তা ফুটিয়ে তোলে মাইম। তা মানুষকে সুন্দর ও সুস্থ রাখে। তাই আমার কাছে মাইম বিশ্বমানের একটি শিল্প। এটি একটি শক্তিশালী মাধ্যমও বটে। আমরা দেখি-স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয়েছে অথবা স্বামী বাইরে থেকে বাসায় দেরি করে ফিরছে। দেখবেন স্ত্রী কথা বলছে না, নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কোনো দিকে। এই যে নীরবতা, নিঃশব্দতা তা কতোখানি কঠোর আর শক্তিশালী তা ভাবলে বুঝা যায়। মাইম বা মূকাভিনয় এমনই। যা অনেক কিছুকে সম্ভব করতে পারে।
পৃথিবীর আদিতে কোনো ভাষা ছিলো না। ভঙ্গি করে কোনো বিষয় বোঝানো হতো। চাহিদাও হাত-পা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিতো। ক্রমে সব পরিবর্তন হয়েছে।তবুও তার আবেদন আছে। আর শিল্পীর দায়িত্ব নিত্য-নৈমিত্তিক ধারাকে পরিবর্তন করা। শিল্প সর্বদা পরিবর্তনশীল। আমিও নতুন নতুন কিছু দেখিয়ে চলছি আপনাদের সামনে।’
ঘ
পার্থ-প্রতিম মজুমদারের জন্ম বাংলাদেশের পাবনায়। যৌবনে ছিলেন ঢাকায়। বর্তমানে পরিবার নিয়ে ফ্রান্সে। এক যুগের বেশি সময় ফ্রান্স, আমেরিকা, ব্রিটেনে অভিনয় করছেন নিয়মিত। কাজ করছেন বিশ্বের আলোচিত পরিচালকদের সাথে। অস্কার পেয়েছে এমন মুভিতেও অভিনয় করেছে পার্থ। বিশ্ববিখ্যাত জেমস বন্ডের সাথেও কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। বাদ যাননি নাটক থেকেও। চমৎকার গুছিয়ে কথা বলেন নন্দিত এই নিঃশব্দের কবি। এক সময় ভারি দরাজ গলায় গান করতেন পার্থ। বিশেষ করে গণসংগীত। এখনো মিস করেন সংগীতকে। ভক্ত ছিলেন ভূপেন হাজারিকা ও কিশোর কুমারের গান। কথা প্রসঙ্গে এলে এখনো গেয়ে উঠেন- ‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা’, ‘জয় জয় নবজাত বাংলাদেশ, জয় জয় বাংলার মুক্তিবাহিনী’। জীবনের প্রথম দিকে অনুষ্ঠান করতেন বিভিন্ন জায়গায়। পল্টনে, রেস কোর্সে, প্রেস ক্লাবে, শিল্পকলা একাডেমিতে, আওয়ামী লীগের অফিসে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বঙ্গবন্ধুর সব জায়গায় সব ভাষণের আগে, গান করতেন সবার প্রিয় পার্থ। সুযোগ পেলে যোগ দিতেন দেশের বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানে। এভাবে হয়ে উঠেন বাংলার প্রিয়মুখ।
সাধারণ কাজ করে অসাধারণ হন প্রিয়মুখরাই। তাঁদের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে বাতাসে। হয়ে উঠেন ভক্তদের প্রাণের স্পন্দন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে নন্দিত নাম- ধ্বনি তোলে বিদেশের মাটিতেও। পার্থ আমাদের এমনই একজন প্রত্যাশার ফুল, যে সুবাস ছড়ায় অঙ্গে অঙ্গে। এই প্রিয় মুখ সম্পর্কে প্রিয় কবি শামসুর রাহমান বলেছেন- ‘পার্থ নীরবতাকে কবিতা করে তোলেন।’
সে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ফ্রান্স সরকারের এই পুরস্কার পেয়ে উচ্ছ্বাসিত শিল্পী পার্থ-প্রতিম। তিনি বলেন- ‘এ পুরস্কার বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে নিঃসন্দেহে। ১৯৬৩ সাল থেকে শিল্প ও সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য শেভালিয়ে (নাইট) উপাধি দিয়ে আসছে ফরাসি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ সরকার ২০১০ এ পার্থ প্রতীমকে একুশে পদক দেয়। বাংলা একাডেমি দিয়েছে বিশেষ ফেলোশিপ ২০১৪। ইউকে মিলেনিয়াম অ্যাওয়ার্ড (২০০০), প্রজন্ম ৭১’ পত্রিকা পুরস্কার ২০০৫, থিয়েটার রিপোর্ট এভিয়েশন অ্যাওয়ার্ড ২০০৮, মুনির চৌধুরী নাট্যপদক ২০০৯, মাইম একাডেমি অব ইন্ডিয়া কর্তৃক পেয়েছেন মাস্টার অব মাইম এ্যাওয়ার্ড, শ্রেষ্ঠ নাট্য অভিনেতা- ফ্রান্স ২০০৯ সহ আরো অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন পার্থ-প্রতিম মজুমদার।
মাইম সর্বকালের, সর্ব প্রাচীন শিল্প হলেও এখনো অতি-আধুনিক। এই আধুনিক শিল্পে কাজ করে, নিজের অবস্থান দখল করতে পার্থকে পোহাতে হয়েছে অনেক কাঠ-খড়। শুনতে হয়েছে নানান জনের নানা কথা। কী আসে যায় লোকের কথায়? থমকে যায় নি পার্থ, কাজ করে হয়েছেন সারা বিশ্বে নন্দিত। তাই তো আজ উচ্চকণ্ঠে বলতে পারেন- ‘আমি এই দেশের সন্তান। তৃণমূল থেকে উঠে এসেছি। এই দেশের প্রতিটি মাটি-কণা আমার প্রিয়। ফলে কিছু হলে খারাপ যেমন লাগে, তেমনি ভালোও লাগে। অন্যায় হলে দৃঢ়কণ্ঠে প্রতিবাদ করতে দ্বিধা করেন না। আমরা অনেক পিছিয়ে আছি, আমাদের যেতে হবে বহুদূর।’
সবশেষে তিনি বলেন, ‘এই পুরস্কার পাওয়ার আগে থেকেই আমি বাংলাদেশ যতোবার গিয়েছি, এমন কী ২০১০ সালে একুশে পদক প্রাপ্তি কিংবা ইউরোপের সর্বোচ্চ সম্মান নাটকের ‘মলিয়র পুরস্কার ২০০৯’ পাওয়ার পরও একই কথা বলেছি যে আমার স্বপ্ন এখন বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক মানের মাইম ইন্সটিটিউট তৈরি করা। আমি সেটাই করতে চাই।’
ইমরান মাহফুজ কবি, গবেষক ও সম্পাদক কালের ধ্বনি। সমন্বয়কারী ডেইলি স্টার বুকস।
Comments