কী দিয়েছে থ্রিজি, কী দিবে ফোরজি

বাংলাদেশে ফোরজি সার্ভিস

এক জিবি’র একটি ফাইল ডাউনলোড করতে গ্রহণযোগ্য থ্রিজি নেটওয়ার্ক পরিস্থিতিতে যেখানে ২০ মিনিট লাগছে, একই রকম পরিস্থিতিতে ফোরজিতে সেটি সম্ভব হবে পাঁচ থেকে ছয় মিনিটে।

অনলাইনে মুভি দেখছেন, বাফারিংয়ের বিরক্তি! সেটি দূর হয়ে যাবে ফোরজিতে ল্যাটেন্সি অনেক ভালো হওয়ার কারণে। একইভাবে অনলাইনে ক্লাস করছেন বা ই-মেডিসিনে স্বাস্থ্য সেবা নিচ্ছেন সেখানেও পাবেন বাধাহীন সেবা।

মোট কথা, ফোরজি মানেই হলো ইন্টানেটের রাস্তাটা আরো অনেক চওড়া হয়ে যাওয়া বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট এক্সপ্রেসওয়েতে উঠে যাওয়া। ওই রাস্তায় তখন গাড়ি চলবে বেশ দ্রুতগতিতে।

টুজি ইন্টারনেটে আমরা মন্থরগতির গলিপথে ঘুরে বেড়িয়েছি। থ্রিজিতে এসে রাস্তাটা একটু চওড়া হলো। কাজের গতিও বাড়লো। ফলে আগের তুলনায় একই সময়ে ডিভাইসে অনেক বেশি কাজ করে ফেলা সম্ভব হলো। অফিসের অনেক কাজই রাস্তায় যানজটে বসেই সেরে ফেলা গেলো।

কিন্তু সমস্যাটা হলো, যতো পরিমাণ গ্রাহক থ্রিজিতে আসবে বলে ধারণা করা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি সংযোগ চালু হয়ে যাওয়ায় আবার অনেক জায়গায় সেবা পরিস্থিতি হয়ে গেলে গড়বড়ে, কোথাও কোথাও ভয়ানক রকমের খারাপ।

বিশেষ করে শহরের বাইরে বিভিন্ন এলাকায় থ্রিজি’র অভিজ্ঞতা করুণ। তবে এটিও ঠিক যে, থ্রিজি আমাদেরকে কতোখানি ইন্টারনেট নির্ভর করেছে তার প্রমাণ মিলেছে গ্রামে গেলে বা ছুটিতে ঢাকার বাইরে গেলেই। এক ধরণের হাহাকার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় অনেকের মধ্যে। বলে উঠে, “হায় হায়, ইন্টারনেট নেই!”

বাংলাদেশে থ্রিজি প্রযুক্তির আরেকটি বড় বাধা- এখানে এই সেবা প্রযুক্তি স্পেকট্রামের যে ব্যান্ডে দেওয়া হয়েছে (২১০০ ব্যান্ড) তার বড় দুর্বলতা হলো এটি পাশাপাশি উঁচু ভবন থাকলে বেজ স্টেশন বা টাওয়ারের মাঝে এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়ে যায়। তাই নেটওয়ার্ক ভালো পাওয়া যায় না। ফলে শহরের বড় বড় ভবনের অলি-গলিতে নেটওয়ার্কও ভালো মেলে না।

ফোরজিতে এখানেই সবচেয়ে বড় অগ্রগতি হবে। কারণ, অপারেটররা যে কোনো ব্যান্ডেই ফোরজি সেবা দিতে পারবেন। ফলে ভালো নেটওয়ার্কের বড় অগ্রগতি হবে এর মাধ্যমে। কথা বলা এবং ইন্টারনেট ব্যবহার– দুই ক্ষেত্রেই তা হবে।

টেলিকমিউনিকেশন্সে ‘টেকনোলজিক্যাল নিউট্রালিটি’ বলে একটি টার্ম আছে। যার মানে দাঁড়ায় যে কোনো স্পেকট্রাম ব্যান্ডে যে কোনো সেবা দেওয়ার সুযোগ। বাংলাদেশে এতোদিন এটি ছিলো না। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি স্পেকট্রাম নিলামের সময় থেকে এটি উন্মুক্ত করা হয়েছে। ফলে একে তো অপারেটর তার হাতে থাকা স্পেকট্রাম দিয়ে ইচ্ছে মতো নেটওয়ার্কের ডিজাইন করতে পারবেন; দ্বিতীয়ত, টেকনোলজিক্যাল নিউট্রালিটি এমনিতেই স্পেকট্রামের ইফিসিয়েন্সি বা কার্যক্ষমতা দেড় থেকে দুইগুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিবে। এতে করে বিদ্যমান স্পেকট্রাম দিয়েই অপারেটরা গ্রাহকদের সন্তুষ্টির কাছাকাছি চলে যেতে পারবে। ‘সন্তুষ্টির কাছাকাছি’ বলছি এ কারণে যে, সন্তুষ্টির তো কোনো সীমা-পরিসীমা নেই!

দেশে এখন থ্রিজি প্রযুক্তির ইন্টারনেটের গড় গতি ৩ দশমিক ৭৫ এমবিপিএস। অন্তত টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের হিসাব তাই বলছে। থ্রিজি আসার আগে এটি কতো ছিলো? নিশ্চিতভাবে সেটি ছিলো কেবিপিএস গতির মধ্যে। আর ফোরজি হলে গতি অন্তত এমবিপিএসের হিসাবে দশকের ঘরে চলে যাবে। তারপরেও গ্রাহক সন্তুষ্ট নাও হতে পারেন। কারণ তার আকাঙ্ক্ষা আরো বাড়বে।

দেশে থ্রিজি চালু হওয়ার শুরুর দিকে মোবাইল ইন্টারনেটের সংযোগে প্রতি মাসে ডেটার ব্যবহার ছিলো ৯০ এমবি। আর এখন সেটি সাড়ে ছয়শ এমবি! পাঁচ বছরে ডেটা ব্যবহারের হার শুধু মোবাইল ফোনেই বেড়েছে সাতগুণ। ফোরজি যুগের সাত বছরে এটি আরো সাত থেকে দশগুণ পর্যন্ত বাড়বে বলে ধারণা করা যেতে পারে।

কিন্তু, আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি দেশে ফোরজি’র লাইসেন্স দেওয়া বা সেবা উন্মুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গেই কি গ্রাহকের ইন্টারনেট গতি বেড়ে যাবে?

তেমনটি আশা করা এই মুহূর্তে বোকামিই হবে। কারণ, সবে তো অপারেটরা স্পেকট্রাম আর টেকনোলজিক্যাল নিউট্রালিটি পেলো। তাই সুবিধাগুলো পুরোপুরি চালু করতে বা গ্রাহকের সেবা পেতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

তাছাড়া, আরো একটি বিষয় হলো ফোরজি চালু হলে যারা ফোরজি ইন্টারনেট ব্যবহার করবেন তারা মূলত বড় ভলিউমের ইন্টারনেটই ব্যবহার করবেন। এতোদিন তারা থ্রিজি ব্যবহার করতেন। তারা থ্রিজি থেকে ফোরজিতে চলে আসলে থ্রিজি’র স্পেকট্রামের ওপর চাপ কমবে এবং যেখানে ফোরজি নেটওয়ার্ক থাকবে না সেখানে থ্রিজি পরিস্থিতিও আগের চেয়ে ভালো হবে।

এতো কিছুর পরেও এখনো বাংলাদেশে ফোরজি’র দুটি বড় চ্যালেঞ্জ থাকছে। প্রথম চ্যালেঞ্জ- হ্যান্ডসেট। দেশে যতো হ্যান্ডসেট ব্যবহার হচ্ছে তার মাত্র দশ শতাংশের মতো সেটে ফোরজি সেবা গ্রহণ করা সম্ভব। গ্রামীণফোনের সিইও গত সোমবার দাবি করেছেন তাদের গ্রাহকদের ১৪ শতাংশের হাতে ফোরজি সেট রয়েছে।

দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো- ডাটা পরিবহনের জন্যে অপারেটররা মূলত ফাইবার অপটিক ক্যাবলই ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু আইনগত বাধ্যবাধকতায় তারা নিজেরা ফাইবার অপটিক ক্যাবল বসাতে পারেন না। এবং দেশে ফাইবার নেটওয়ার্কও যথেষ্ট শক্তিশালী নয়।

এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফোরজি বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ সেবায় বড় অগ্রগতি নিয়ে আসবে- সেটি বলা যায় নিঃসন্দেহে।

থ্রিজি যেমন ইন্টারনেটের গতি-ই বাড়ায়নি, সেই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নতুন নতুন সেবাকে ইন্টারনেটের ওপর তুলে দিয়েছে। ফোরজিতেও দেখবেন অনেক প্রচলিত সেবা ইন্টারনেট-ভিত্তিক হয়ে যাবে। আর পার্থক্যটা বোঝা যাবে তখনই।

থ্রিজি ইন্টারনেট চালু হওয়ার আগেই কি আমরা ভাবতে পেরেছি, আপনার ডিভাইসে কয়েকটি বাটনে চাপ দিলেই বাসার গেটে গাড়ি এসে হাজির হবে? বা অর্ডার করলেই খাবার হাতে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে যাবেন কেউ? ড্রাইভার, মিস্ত্রি- কী লাগবে? সব পাবেন এখন অনলাইনে। গোটা ইকোসিস্টেমে এমন হাজার রকমের সেবা যুক্ত হয়ে যাবে ফোরজি’র ছোঁয়ায়।

কিন্তু, সবকিছুর ওপর যেটি লাগবে সেটি হলো- সেবার গাড়িটিকে তার গতিতে চলতে দেওয়ার সুযোগ। সরকার চাইলেই ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেবে বা নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেবে তাহলে কিন্তু ফোরজি ওয়ানজিতে নামতেও সময় লাগবে না।

Comments

The Daily Star  | English
Banks deposit growth in 2024

Depositors leave troubled banks for stronger rivals

Depositors, in times of financial uncertainty, usually move their money away from troubled banks to institutions with stronger balance sheets. That is exactly what unfolded in 2024, when 11 banks collectively lost Tk 23,700 crore in deposits.

12h ago