সব কিছুর পরেও চাই বাংলাদেশের রান্না

bangla food

“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি”, ঠিক তেমনি বলা যায়, এমন মজাদার রান্নাও কোথায় খুঁজে পাবে নাকো তুমি। হ্যাঁ আমি বাংলাদেশের খাবারের কথা বলছি। বাঙালিরা বিশ্বের যে দেশেই বসবাস করুক না কেন, নিজের দেশের খাবারের স্বাদ তাদের কাছে অমৃত সমান। আর তাইতো কানাডায় -৩৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় বরফের মধ্যে বসে প্রায় প্রতিটি বাঙালির বাড়িতে খিচুড়ি আর মাংসের হাড়ি চড়ে। বোস্টন থেকে বন্ধু ছবি পাঠালো বাইরে তুষারপাত হচ্ছে, অফিস ছুটি ঘোষণা করেছে, আর ওরা এই সুযোগে রেঁধে ফেলেছে সোনামুগের ডালের খিচুড়ি, ডিম ভাজি, বেগুন ভাজি, আলু কপি ভাজি আর সাথে বিক্রমপুরের গাওয়া ঘি। ওর ভাষায়, বিদেশে থাকি ঠিকই কিন্তু মনটা দেশি খাবার ছাড়া শান্তি পায় নারে বন্ধু।

বৃষ্টির দিনে লন্ডনে থাকা বাঙালি পরিবারে পাওয়া যাবে গরম গরম ইলিশ ও বেগুন ভাজার গন্ধ। আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা জানি, যেখানে বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীরা ছুটির দিনে একসাথে হয়ে চাঁদা দিয়ে গরুর মাংস ভুনা, খিচুড়ি, মাছের ঝোল বা মুড়ো ঘণ্ট বা কলিজা ভুনা রান্না করে খায়। কারণ সপ্তাহে অন্তত একদিন দেশের রান্না না খেলে তাদের সপ্তাহটাই ভেস্তে যায়।

এক ইতালীয় মেয়েকে চিনি, যে শুধু বাংলাদেশি রান্নার গুণে প্রেমে পড়ে গিয়েছিল সালেহীনের। কারণ সালেহীন খুব মজাদার সব বাংলাদেশি রান্না জানতো। বাংলাদেশের টেকশ্যাভি ছেলে কামাল প্রতিবছর জার্মানি থেকে দেশে আসে, শুধু মায়ের হাতে চ্যাপা শুটকির ভর্তা খেতে। খেয়েই ক্ষান্ত হয় না কামাল, যাওয়ার সময় খুব গোপনে, নানা কায়দায় ব্যাগে ভরে এতটাই নিয়ে যায়, যেন আরও মাসখানেক এই শুটকি দিয়ে ভাত খেতে পারে। কামাল বলেছিল ও নাকি অনেক দেশের খাবার খেয়েছে। কিন্তু শুটকির উপর কোন খাওয়া নেই। ওর ভাষায়, “উহু… আমি স্বর্গে গেলেও শুটকি আর ভাত চাই।”

Bangladeshi Food

ফেসবুক খুললেই দেখা যায় পৃথিবীর আনাচে-কানাচে থাকা বাংলাদেশিরা বিভিন্ন সময় দেশি খাবার রান্না করছে আর ছবি আপলোড করছে। বরিশালের ছেলে মিল্টন, ঢাকায় থাকার সময়, শত রকমের মাছ খাওয়ার জন্যই ওর বাড়িতে আমরা খেতে যেতাম। সেই মিল্টন কানাডা প্রবাসী হয়েও অবিরত মাছের কথাই বলে যায়, মাছের স্বপ্ন এঁকে যায়। প্রতিটি বাংলাদেশি বিদেশ যাওয়ার সময় যে বইটি সাথে নিয়ে যাওয়া “ম্যান্ডেটরি” বলে মনে করে, সেটা হল সিদ্দিকা কবীরের রান্নার বই।

আমি নিজেকে দেশি রান্নার চরম ভক্ত মনে করি। যে দেশেই যাই, যা কিছুই খাই কিন্তু দু-চারদিন পরই বাংলা খাবারের জন্য মন কেঁদে ওঠে। কিন্তু কেন এমনটা হয়? কী যাদু এই বাংলা খাবারে? নাকি শুধুই আমরা অভ্যস্ত বলে এমনটা হয়।

অভ্যস্ততা তো আছেই কিন্তু এর উপরে আছে বাংলাদেশি রান্নার যাদু। বাংলাদেশি খাবারের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে এই খাবারের বৈচিত্র্য। কত ধরণের খাবার যে বাংলাদেশি মেন্যুতে আছে তা কল্পনাও করা যায় না। এদের স্বাদ একটার চেয়ে আরেকটা বেশি। বাংলার চিরায়ত সাদা ভাতের সাথে খেতে পারেন অন্তত ১০০ রকমের মিষ্টি পানির মাছ, আরও আছে সমুদ্রের মাছ, শতরকমের ভর্তা, ভাজি, সবজির নানা পদ, আলু ভাজি, বেগুন ভাজি, শুক্তো, বড়ি, কলার মোচা, অনেক রকমের শুটকি, নানা পদের ডাল, আচার, গরু, খাসি, মুরগি, হাঁসের মাংস রান্না এবং আরো কত কি। এই খাবারগুলোর মধ্যে কোনটাতে তেল-মশলার ব্যবহার বেশি, কোনটায় হালকা। যে যার পছন্দমত রাঁধে। বাংলার পিঠে-পুলিরও কোনো শেষ নেই। কত ধরণের পিঠা যে বানানো হয় শীতের মৌসুমে। আছে পায়েস, জর্দা, হালুয়া, দইসহ আরও কত কি।

Bangladeshi Food

আছে মোগলাই খানা পোলাও-কোর্মা, রোস্ট, রেজালা, মাছ-মাংসের কালিয়া, কোপ্তা-কাবাব, চিংড়ির মালাইকারি, ডিমের কোর্মা, মোরগ পোলাও, কাচ্চি বিরিয়ানি, তেহারি, বোরহানি। আছে বাঙালির খাবার খিচুড়ি-মাংস-ডিম ভাজি এবং সাথে ঘি বা আচার। এত ধরনের আচার আর কোন দেশে বানায় কিনা আমার জানা নেই।

এছাড়াও আছে রুটি, পরোটা, নান, বাকরখানি, হরেক রকমের কাবাব, হালুয়া, মিষ্টি, বিভিন্ন ধরণের শরবত। বাংলাদেশের পথের ধারের ছোট ছোট দোকানে যে সিংগারা, সমুচা, ডালপুরি, আলুপুরি, ঝালমুড়ি, মোগলাই পরোটা, আলুর চপ, বেগুনি, ছোলা, হালিম, জিলাপি বিক্রি হচ্ছে। এসবের স্বাদও অসাধারণ। যারা একবার এসবের স্বাদ পেয়েছে, তারা আর কোনদিনও সেই স্বাদ ভুলবে না। বাংলাদেশে নিযুক্ত একজন ব্রিটিশ কর্মকর্তা তার বিদায়ী ভাষণে বলেছিলেন, বাংলাদেশে উনি আবার ফিরে আসবেন শুধু এদেশের অপূর্ব রান্না খাওয়ার জন্য। বিশেষ করে  সিংগারার কথা উনি কখনও ভুলতে পারবেন না।

এত ধরনের বাহারি রান্না কিন্তু হঠাৎ করে বাংলাদেশের রন্ধনশালায় ঢুকে যায়নি। এর একটা ইতিহাস আছে। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে বাংলাতে প্রথম দিকে মাছ, ভাত, দুধ, মিষ্টি এবং শাক-সবজি প্রচলন ছিল বেশি। ১৫৭৬ সালে মুঘলরা বাংলা শাসন শুরু করলে এখানে মোঘলাই রান্নার চল শুরু হয়। ঢাকাতে মুঘল রান্নার সাথে বাংলার আদি রান্নার সম্মিলনটা এত বেশি হয়েছিল যে, আজকের ঢাকাইয়া রান্নাতে মুঘলাই ঘরানার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আর তাই আমাদেরও যখন তেলে-ঘিয়ে মাখামাখি করে খুব খানদানি রান্না খেতে ইচ্ছে করে, চলে যেতে হয় পুরনো ঢাকায়। ঢাকার সবচেয়ে নামকরা খানদানি খাবারের বাবুর্চিদের ঠিকানা কিন্তু সেই পুরানো ঢাকা।

যদিও দিল্লি ছিল মুঘলদের রাজধানী, কিন্তু ঢাকার কাচ্চি বিরিয়ানির কাছে যে দিল্লির কাচ্চি বিরিয়ানি দাঁড়াতে পারেনি, সে কথা বারবার বলেছেন দিল্লির খুব বিখ্যাত একজন নিউরোসার্জন। উনি যখনই ঢাকায় আসেন, তখনই তার প্রধানতম খাদ্য হয়ে দাঁড়ায় এই কাচ্চি। উনি বলেন, “আমি বাংলাদেশের চিতল মাছের রান্না, কোপ্তা, ইলিশ, কই এসব খাবারের কথা ভুলতে পারি না। আমি নিজে রাজস্থানের লোক হলেও বাংলাদেশের রান্না আমি এতটাই ভালোবাসি যে আমার কুক একজন বাঙালি।”

Bangladeshi Food

“এরকম মজাদার কাচ্চি আমি জীবনেও খাইনি,” বলে মন্তব্য করেছে আমার পরিচিত আরও একজন ভারতীয়। বাংলাদেশের রান্না ও ভারতের বাঙালিদের রান্না এক মনে হলেও কিন্তু পুরোপুরি এক নয়। দুই বাংলার রান্নার ধরনে, মশলা প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেকটাই ফারাক আছে। আর তাই স্বাদও হয়ে যায় ভিন্ন। যেমন, ওরা মাছ রানতে গিয়ে যত মশলা ব্যবহার করে এবং যতটা কড়া করে রান্না করে, বাংলাদেশে কিন্তু সেভাবে মাছ রান্না করে না। এখানে খুব একটা মশলার ব্যবহার হয় না এবং রান্নাও হয় হালকা ধরনের।

মুঘলদের পরে আসে ব্রিটিশ জমানা। নবজাগরণের এই যুগে বাঙালিদের রান্নার উপর প্রভাব পড়ে সাহেবি রান্নার স্টাইল। পাওয়া যেতে শুরু করে চা, কেক, বিস্কুট, মাংস, আলু দিয়ে নানারকম পদ ও রুটির নানা ধরন। পর্তুগিজরা চালু করে পনির। পারস্য, তুরস্ক ও আরব খাবারেরও একটা প্রভাব লক্ষ্য করা যায় বাঙালি রান্নার উপর। এত ধরনের কালচারের রন্ধন কৌশল বাংলার আদি রান্নার সাথে মিলে একে এতটাই সুস্বাদু করেছে যে, বাংলাদেশের রান্না হয়ে উঠেছে খুবই বৈচিত্র্যমন্ডিত ও ক্লাসিক।

শুধু কি তাই, পাক-ভারত উপমহাদেশ যখন ছিল, সেসময় পাশের দেশ বার্মা বা আজকের মিয়ানমারের সাথে ছিল আমাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। এই আরাকানি রাজ্যের রান্নার প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রামের রান্নার উপরে। চট্টগ্রামের রান্নায় ব্যাপক ঝাল ও ঝোলের ব্যবহার ও শুটকি খাওয়ার প্রবণতা এসেছে আরাকান মুল্লুক থেকে।

বাংলাদেশের রান্নার আরেকটি আকর্ষণীয় দিক হল এখানকার অঞ্চলভেদে রান্নার ধরন ও উপকরণ বিভিন্ন। বাংলাদেশের ভৌগোলিক এলাকা ছোট এবং সেই অনুপাতে জনসংখ্যা অনেক বেশি। তবে এই জনমানুষরা সবাই মোটামুটি সমজাতীয় বা হোমোজেনাস। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এদের রান্নার কৌশল ও স্বাদের মধ্যে কিন্তু বেশ বৈচিত্র্য আছে। আর যে কারণে দেশের ভেতরেই বাঙালি রান্নার স্বাদও হয় বিভিন্ন।

Bangladeshi Food

উত্তরাঞ্চলে যে কায়দায় রান্না হয়, দক্ষিণে রান্না হয় অন্যভাবে। যেমন উত্তরের জেলাগুলোতে মাছ, মাংস রান্না হয় হালকা ধরনের- কম তেল, কম মসলা। তবে অনুষ্ঠানের খাওয়াতে পোলাও এর সাথে কোর্মা, রোস্ট, আলু ভাজা, বেগুন ভাজা এসব থাকবেই। এখানকার রান্নায় আলুর ব্যবহার খুব বেশি। এরা ডাল, সবজিতে পাঁচফোড়নের বাগাড় দেয়। পোস্ত, মেথির ব্যবহার বেশি থাকে। অন্যসব খাবারের সাথে এই এলাকার নিজেদের খাবার কাউনের খিচুড়ি, আলুর ডাল, লাফা শাক, সিদল ও প্যালকা।

আবার দক্ষিণে চট্টগ্রামের দিকে রান্নায় মশলার ব্যবহার বেশি। মাছের চেয়ে মাংসের জনপ্রিয়তা বেশি। সবজি ও ডালের প্রচলন কম। মাছের মধ্যে সামুদ্রিক মাছের কদর বেশি। আর চলে শুটকি মাছের তরকারি। তবে চাটগাঁইয়া রান্নায় গরুর মাংসের প্রভাব অনেক বেশি। শুধু চট্টগ্রামের মানুষের কাছে নয়, এখানকার মেজবানি মাংস ও গরুর কালাভুনা আজ দেশব্যাপী খুবই জনপ্রিয় একটি খাবার। এই মাংস রান্না একবার যে খেয়েছে, সে কখনও ভুলবে না।

খুলনা-যশোর অঞ্চলে যেকোনো রান্নার সাথে নারকেলের দুধ ও নারকেল ব্যবহার হয় খুব বেশি। রান্নায় চিংড়িসহ নানা ধরনের মাছের খুব চল। তবে চুই ঝাল বলে একটি অসামান্য মশলা বা হার্বের ব্যবহার হয় এখানে। এখানে চুই ঝাল দিয়ে যে মাংস রান্না হয়, সেটার স্বাদও অসাধারণ।

সিলেট এর দিকে রান্না হয় বেশ কড়া পাকের। মশলার ব্যবহারও বেশি। আর সিলেটের রান্নায় খুব বেশি ব্যবহৃত হয় সাতকড়া নামে এক ধরনের লেবু জাতীয় ফল। এখানেও মাংস রান্না হয় সাতকড়া দিয়ে। এই মাংস রান্নার স্বাদ আবার একেবারে অন্যরকম। চট্টগ্রামের মেজবানি মাংস, সিলেটের সাতকড়া মাংস, আর খুলনা অঞ্চলের চুই ঝাল মাংস সবই বিখ্যাত ও খেতেও মজাদার। কিন্তু এই তিন পদের মাংসের স্বাদ একেবারেই ভিন্ন।

বাংলাদেশে বিভিন্ন আদিবাসীদের বাস। আদিবাসীদের রান্নার স্টাইল একদমই আলাদা রকমের। এই রান্নারও একটা বড় ধরনের চাহিদা রয়েছে বাংলাদেশে। এতকিছু আলোচনার পর নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে কেন স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় এই বাংলাদেশের রান্না। চাইলে তেল-মশলা সহযোগে রান্না, না চাইলে হালকা ধরনের রান্না। ঝাল-টক-মিষ্টি সবকিছুই পাওয়া যাবে রান্নার স্বাদে। স্বাদের এত ভিন্নতা কি আর কোন দেশের রান্নায় আছে? জানিনা, তবে এটা জানি আমরা বাঙালিরা যাই খাই না কেন, সব কিছুর পর চাই বাংলার রান্না। এককথায় বলি, তোরা যে যা বলিস ভাই আমার বাংলাদেশের খাবার চাই।

লেখক: যোগাযোগকর্মী

Comments

The Daily Star  | English
future of bangladesh after banning awami league

What are we building after dismantling the AL regime?

Democracy does not seem to be our focus today. Because if it were, then shouldn’t we have been talking about elections more?

17h ago