সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে রওশন লজ্জা পান!
একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলে থাকা জাতীয় পার্টিকে (জাপা) প্রকৃত বিরোধী দল হওয়ার সুযোগ করে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চেয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা ও জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ। গত মঙ্গলবার সংসদে দেওয়া বক্তব্যে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে তার দলের এমপিদের বাদ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি এই হাস্যকর আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু বর্তমান যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তাতে রওশনের বক্তব্য মানুষকে এতটুকুও অবাক করেনি।
রওশনের স্বামী জাপার চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ গত চার বছর ধরে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়ে রয়েছেন। সংসদে বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়ে বেশ কিছু অনুষ্ঠানে তিনি নিজেই জাপাকে “গৃহপালিত বিরোধী দল” আখ্যা দিয়েছেন। জাপার এমপিদের মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করার কথা তিনিও বলেছেন। যদিও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদটি নিজেই আঁকড়ে রেখেছেন।
এরশাদ যখন তার দলের এমপিদের মন্ত্রিসভা ছাড়তে বলেছিলেন তখন কিন্তু উল্টো কথা বলেছিলেন রওশন। জাপার এমপিদের মন্ত্রিত্ব ধরে রাখাতে সমর্থন দিয়েছিলেন তিনি। তিন জন এমপি মন্ত্রিসভায় আর বাকি এমপিরা বিরোধী দলের আসনে বসার স্ববিরোধিতার কারণে জাপা যে পরিচয় সংকটে ভুগছে সেই কথা কিন্তু তিনি স্বীকার করেননি। শুধু তাই নয়, সংসদে তাদের ভূমিকা নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলেছিলেন সেদিন তীব্র ভাষায় তাদের সমালোচনা করতেও ছাড়েননি। রওশন বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, সরকারের গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে জাতীয় পার্টি তার নেতৃত্বে “প্রকৃত বিরোধী দল” হয়ে উঠেছে।
কিন্তু চার বছর পর রওশন এরশাদের মতি বদল হয়েছে। এখন তারা পরিচয় সংকটে ভুগছেন। বলেছেন, তারা নাকি আর দেশ-বিদেশে পরিচয় দিতে পারছেন না। তার মনে প্রশ্নের উদয় হয়েছে, “আমরা কি সরকারি দল নাকি বিরোধী দল?”
সরকারকে প্রশ্নের মুখে রেখে তাকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ রাখা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিরোধী দলের কাজ। সেই সাথে সরকারের নীতিকে চ্যালেঞ্জ করে প্রয়োজনে ভিন্ন নীতি উপস্থাপনের মাধ্যমে বিকল্প বা ছায়া সরকারের ভূমিকা পালন করার দায়িত্ব রয়েছে তাদের। সংসদে বিরোধী দলকে সঠিক দিশায় পরিচালিত করার গুরু দায়িত্বও বর্তায় বিরোধী দলের নেতার ওপর।
এখন রওশনের বক্তব্য থেকে প্রমাণ হয় তার নেতৃত্বে গত চার বছর সংসদে বিরোধী দল আসলে কোন ভূমিকায় ছিলো। তিনি বলেছেন, সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা লাগে। কারণ, সবাই জানতে চায়, জাতীয় পার্টি সরকারি দল না বিরোধী দল। একারণেই নাকি তিনি সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দেন না।
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তিনি প্রশ্ন করেন, আপনারা যখন বিদেশে যান, “বলতে পারেন বিরোধী দলে কারা আছে? …প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম, আমাদের মন্ত্রীগুলোকে উইথড্র করে নেন। এটা যদি আপনি করতেন, জাতীয় পার্টি বেঁচে যেত। জাতীয় পার্টি সম্মানের সঙ্গে থাকতে পারত।”
কিন্তু মঙ্গলবার এই বক্তব্য দেওয়ার পরদিনই তিনি সেটা ভুলে যান। বুধবার তিনি বলেন, সংসদে বিরোধী দলের অর্পিত দায়িত্ব তারা পালন করছেন। এর আগে কোনো সরকারই শান্তিপূর্ণভাবে তাদের মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। সরকারকে প্রশংসায় ভাসিয়ে বলেছেন, এই সরকারের আমলে যত উন্নয়ন হয়েছে, অতীতে তা হয়নি। বিরোধী দল সাহায্য-সহযোগিতা করেছে বলে উন্নয়ন হয়েছে।
একেক দিন একেকে ধরনের কথা বলার জন্য এরশাদের দুর্নাম রয়েছে। মাত্র এক দিনের ব্যবধানে রওশনের দুই ধরনের বক্তব্য প্রকারান্তরে তাকে এরশাদেরই কাতারে নিয়ে গেছে।
কিন্তু রওশনের এসব কথার মানে কী? নিজ দলের এমপিরা যারা মন্ত্রিসভায় রয়েছে তাদের ওপরই কি তাহলে জাপার নিয়ন্ত্রণ নেই? এর আগে এরশাদ নিজেও বহুবার বলেছেন তার দলের মন্ত্রীরা পদত্যাগ করবেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত তাদের কেউই মানেননি। হাস্যকরভাবে তিনি নিজেও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদ ছাড়েননি।
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানানো এমপিদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্যও কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে দলটি। ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় দলে ভাঙন দেখেছে জাতীয় পার্টি। সেসময় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারে যোগ দিয়েছিল জাপা। দলটির একজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে তখন মন্ত্রীও করা হয়। একপর্যায়ে দলের হাইকমান্ড থেকে সরকারের প্রতি সমর্থন তুলে নেওয়া হলেও তিনি মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করতে রাজি হননি। দলটির প্রায় অর্ধেক এমপি মন্ত্রিত্ব না ছাড়ার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করলে জাপা ভেঙে যায়।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বিরোধী দলীয় নেতা নিজেই যখন বলছেন তারা “প্রকৃত বিরোধী দল” হয়ে উঠতে পারছেন না তখনই সংসদে তাদের প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তার মতে, গণতান্ত্রিক চর্চাটা কীভাবে হতে পারে তা এই সংসদে দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে। ধৈর্য দেখানোর জন্য তিনি রওশনসহ জাতীয় পার্টির নেতাদের প্রশংসা করেছেন। এটাই এখনকার রাজনৈতিক বাস্তবতা।
গত চার বছর ধরে প্রধান বিরোধী দল কোনো কাজে বা কথায় সরকারের অস্বস্তির কারণ হয়নি। সংসদে এই সময়ের মধ্যে যত বিল পাশ হয়েছে তার একটিতেও তারা “না” ভোট দেননি। আর বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় যখন জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দল হয়েছে তখন প্রধানমন্ত্রী কিভাবে বা তাদের সমালোচনা করতে পারেন?
কিন্তু প্রশ্ন হল, বিরোধী দলের এই অবস্থা আমাদের দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের জন্য কী বার্তা দিচ্ছে? যখন বিরোধী দলের নেতা অসহায় হয়ে তাদের নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তখন সেটা দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের দেউলিয়াত্বকেই প্রকাশ করে। এটা পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দেয় যে বর্তমান জাতীয় সংসদ ঠিকভাবে কাজ করছে না। পার্লামেন্ট যখন অকার্যকর হয়ে পড়ে তখনই সরকার বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এরকম বহু দেশের উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। সরকারকে তার কাজের জন্য পার্লামেন্টে দায়বদ্ধ রাখা সম্ভব না হলে আইনের শাসন, মানবাধিকার আর দুর্নীতিমুক্ত শাসন ব্যবস্থা অধরাই থেকে যায়। এসব বিপদ থেকে কতটুকু মুক্ত আমরা?
২০১৪ সালে জাতীয় পার্টির তিন জন এমপিকে মন্ত্রী করার পর বাকি সাংসদরা যখন বিরোধী দলের আসনে বসেছিলেন তখন আওয়ামী লীগের একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ একে “কাঁঠালের আমসত্ত্ব” বলেছিলেন। যে বস্তুটিকে আমসত্ত্ব বলা হয় সেটিকে অবশ্যই আম থেকে তৈরি হতে হবে, কাঁঠাল থেকে নিশ্চয়ই এটা হতে পারে না।
গত চার বছর ধরে জাতীয় পার্টি সংসদে যে নাটক মঞ্চস্থ করে চলেছে তাতে একটা বার্তা স্পষ্ট। আর সেটা হলো, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। আর আগামী সংসদ নির্বাচনের জন্য এটা জরুরি। আর যেন কাঁঠালের আমসত্ত্ব না হয়।
ভাষান্তর: আবু সাদিক
Comments