যাত্রাপথের যত খাবার
ছোট বেলায় ঢাকা থেকে রংপুর বাসে যাওয়ার পথে আরিচাতে ফেরি পার হতে হতো। সময়টা ৭০/৮০ এর দশক এবং ৯০ এর প্রথম ভাগ। সে সময় ফেরি পারাপার ছিল বেশ ঝক্কির ও সময়সাপেক্ষ একটা ব্যাপার। দুই-তিন ঘণ্টা থেকে চার-পাঁচ ঘণ্টাও লেগে যেত কখনও কখনও। তখন খাওয়া দাওয়ার জন্য যমুনা নদীর ঘাটে যেমন ছিল ছোট-ছোট বেড়ার চালার অসংখ্য দোকান, তেমনি ছিল থাকার জন্য দুই-তিন তলা টিনের হোটেল।
সেসব হোটেলে অন্তত ১০-১২ পদের মাছ, গরুর মাংস, ডিমের তরকারি, ভর্তা ভাজি পাওয়া যেত। আর ছিল হাড়ি ভরা পাতলা ডাল। সেই মাছের ঝোলের রং ছিল টকটকে লাল, আর ঝালে ভরা। তবু খেতে ছিল দারুণ, অসাধারণ। আমরা প্রতিবার বাড়ি যাওয়ার পথে পরিবারশুদ্ধ সবাই সেইসব হোটেলে বসে ভাত-মাছ খেতাম। যদিও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার একটু অভাব ছিল বলে আম্মার প্রবল আপত্তি ছিল। কিন্তু আমরা কানে তুলতাম না। উহ্... মুখে লেগে আছে সেই স্বাদ। এমনও সময় গেছে যখন ঘাটে মাছ কিনে, সেই মাছ রান্না করিয়ে খাওয়া হয়েছে।
কোনো কারণে ঘাটে যদি খাওয়া নাই হতো, খাওয়া হতো ফেরিতে। ফেরিগুলো সব দুই-তিন তলা ছিল। ভেতরে খাওয়ার ব্যবস্থাও ভালো ছিল, এখনও আছে। নিয়ম ছিল শুধু তরকারির দাম দিতে হতো, ভাত-ডাল ফ্রি। যে যতটা খেতে পারে, খায়। আমার এখনও মনে পড়ে একবার ফেরিতে খেতে বসে দেখলাম আমাদের পাশের টেবিলে এক যাত্রী এক পিস মাছ কিনে পুরো এক গামলা ভাত ও বড় এক বাটি ডাল খাওয়ার পরও যখন আরও ভাত-ডাল ফ্রি খাওয়ার জন্য হৈ চৈ শুরু করে, তখন ফেরির ক্যান্টিনওয়ালাদের সাথে তার প্রায় হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। শেষে ফেরির পুলিশ এসে ব্যাপারটা মিটমাট করেছিল। এখনও আরিচা-নগরবাড়ি ঘাটে এই রেওয়াজ চালু আছে।
ঘাটের সেই বেড়া বা টিনে ঘেরা দোকানগুলোতে বসে সেই খাওয়া কিন্তু আবার নতুন করে, অন্যভাবে ফিরে এসেছে দেখতে পাচ্ছি। লোকজন সকাল নেই, রাত নেই, দিন নেই ছুটির দিন হলেই গাড়ি হাঁকিয়ে মাওয়া ঘাটে ছুটে চলেছে ঘাটের হোটেলে গরম গরম ইলিশ ভাজা ও বিভিন্ন মাছের তরকারি খেতে। সেখানে পাওয়া যায় মাছের ডিম ও মাথার ভর্তা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল আরিচা ঘাটে আমাদের সে সময়ের খাওয়াটা ছিল প্রয়োজনের আর আনন্দের কিন্তু এখন মাওয়া ঘাটে খাওয়াটা শুধুই বিনোদনের। কারণ এই পথে পদ্মা পার হওয়া যাত্রীদের অধিকাংশের সময়ই থাকে না ঘাটে বসে খাওয়া-দাওয়া করার।
যমুনা ব্রিজ হওয়ার পর উত্তরের ১৬টি জেলার বাস-ট্রাক-গাড়ি সব সেদিক দিয়ে গেলেও, দক্ষিণাঞ্চলের অনেক গাড়ি আরিচা-দৌলতদিয়া দিয়ে এখনও চলাচল করে। আর তাই ওই দুই ঘাটে এখনও বহু ভাতের দোকান চালু রয়েছে। বিশেষ করে দৌলতদিয়া ঘাটের দোকানগুলোতে এখনও ভালো মাছের তরকারি পাওয়া যায়।
এদিকে যারা লঞ্চে করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা যাতায়াত করেন, তারা জানেন যে লঞ্চের রান্না কতটা মজাদার। মাছ, মাংস, সবজি, পরোটা, পুডিং সবকিছুই দারুণ স্বাদের। দিনে দিনে এইসব বড় বড় লঞ্চে খাবারের তালিকা দীর্ঘতর হচ্ছে। কাজেই লঞ্চে যারা ভ্রমণ করবেন, একবার হলেও এখানে খাবার চেখে দেখবেন।
এতো গেল জলযাত্রার আয়োজন। এবার আসি ট্রেন যাত্রার কথায়। আজকের দিনে ট্রেন যাত্রার যে জৌলুস ও মজা আছে, ১০-১৫ বছর আগেও কিন্তু তা ছিল না। তখন ট্রেনের বগিগুলো ছিল লাল রঙের, আর কামরা ও সিটগুলোও এত ঝকঝকে তকতকে ছিল না। তবে তখনও বা তারও আগে যে কাটলেট ও বাটার পাউরুটি রেলের ক্যাফেটেরিয়াতে পাওয়া যেত, এখনও তা পাওয়া যায়। সাথে যোগ হয়েছে কেক। অনেকেই কাটলেটের স্বাদ নিয়ে নানা কথা বললেও, রেলযাত্রার আনন্দ বহু গুণ বাড়িয়ে দেয় এই কাটলেট। আর একটি কথা যে আমাদের অনেকেরই স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই কাটলেটের সাথে।
এখনকার সবুজ আর সাদা রঙের ট্রেনে যেতে যেতে যেমন আপনি নিজেদের বাড়ি থেকে আনা খাবার খেতে পারেন, তেমনি ট্রেনেও পাবেন ভাত, ডাল, মজাদার তরকারি এবং চা কফি। মাঝেমাঝে বিভিন্ন ধরনের চিপস ও চকলেট নিয়ে আসবে ফেরিওয়ালারা। কোন স্টেশনে একটু বেশি সময় থামলে, ট্রেন থেকে নেমে কিনে আনা যায় গরম গরম পরোটা ও ডিম ভাজি, ছোলা বুট মাখা, বাদাম ভাজা, কলা, এবং সেদ্ধ ডিম। ফেরিওয়ালাদের সেই সেদ্ধ-বয়েল ডিমের হাঁক-ডাক প্রতিটি ট্রেন যাত্রীর কাছে পরিচিত। কপাল ভালো থাকলে বিকেল বেলা কোনো স্টেশনে আপনি পেয়ে যেতে পারেন গরম জিলাপি।
সবচেয়ে বেশি ধরনের ও মজাদার খাবার বোধকরি পাওয়া যায় সড়কপথে যেতে যেতে। এখন প্রতিটি রুটেই রয়েছে অসংখ্য খাবার দোকান। এরমধ্যে কোন কোনটি খুবই নামকরা। এসব দোকান এতটাই নামকরা মানে এদের খাবার এতটাই মজাদার যে ঢাকা থেকে লোকে গাড়ি হাঁকিয়ে এসে এসব দোকানে খেয়ে যায়। এটাই যেন একটা বেড়ানো।
যারা দূরপাল্লা বাসে ভ্রমণ করেন, তারা কিন্তু জানেন কোন রুটে কোন দোকানের খাবার সেরা। কোনো হোটেলের খিচুড়ি ভালো, কোনো হোটেলের সবজি ভালো, কোনোটার ভালো মাংস ভুনা, আবার কোনোটার ভালো মিষ্টি। গত ১০-১৫ বছরে হাইওয়েগুলোর পাশে গড়ে উঠেছে বড় বড় সব হোটেল। পথের পাশের ছোট ছোট রেস্তোরা ও ছাপড়া দোকানের পাশাপাশি এই হোটেলগুলো খাবারে এনেছে ভিন্ন মাত্রা।
যেমন উত্তরাঞ্চলে যাওয়ার পথে পাবেন এরিস্টোক্র্যাট এবং হাইওয়ে ইন নামে দুটি চমৎকার খাওয়ার হোটেল। এরিস্টোক্র্যাটের ভুনা মাংস যেমন ভালো, ঠিক তেমনি ভালো হাইওয়ে ইনের রসগোল্লা। সিলেটের পথে যেতে থামতে হবে উজান ভাটিতে। ভৈরব সেতু পার হওয়ার পরই পেয়ে যাবেন হোটেলটি। পরোটা ভাজি, মাংস ভাত সবই মজার। এদের এখানেও অধিকাংশ সময় বসার জায়গা পাওয়াই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
যেতে হবে চট্টগ্রাম রুটে, সেখানেও কোনো সমস্যা নাই। পথে খেতে ইচ্ছা করলে গাড়ি দাঁড় করাবেন হাইওয়ে ইনে। এদের খিচুড়ি আর ভুনা মাংস ভুবনখ্যাত বলা যায়। এখানেও তাই, জায়গা পাওয়া কঠিন, সে আপনি দুপুরেই যান, আর রাতে। এই হোটেলগুলোর খাবারের আয়োজন দেখলে মনে হবে দিনরাত উনুন জ্বলছে, আর ২৪ ঘণ্টা ধরে দফায় দফায় মানুষ এসে খাচ্ছে। এইসব রুটে চলাচলকারী ভালো বাসগুলো সবাই এই হোটেলগুলোতেই থামে।
যাত্রা পথে খাওয়া-দাওয়া একটি বড় ব্যাপার। বাড়ি থেকে খাবার আনাও সবসময় সম্ভব হয় না কিন্তু চিন্তা কি। পথে বেরুলেই পেয়ে যাবেন রসনা মেটানোর মত কিছু খাবার। শুধু বেছে নিতে হবে ভালো রসনা খানাটি।
শাহানা হুদা: যোগাযোগকর্মী
Comments