নারী বান্ধব নগরীর প্রতীক্ষায়

ছবি: ত্রিবেণী চাকমা

মধ্য দুপুরে বাসের ভেতর গাদাগাদি ভিড়। সামনের দিকে বেশিরভাগ নারী যাত্রী। অল্প কিছু পুরুষ। হঠাৎ নারী কণ্ঠের ঝাঁঝালো চিৎকার- গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন? সরে দাঁড়ান। উৎসুক দৃষ্টিতে যাকে জড়িয়ে কথা বলা, তার দিকে তাকালাম। কেতাদুরস্ত ভদ্রবেশী। হাফহাতা শার্ট, প্যান্ট, পরিপাটি জুতো জোড়া। এক হাতে বগলদাবা করা একটা ফাইল। তার দিকেই সন্দেহের তীর। সামনের দিক থেকে মিনমিন করা অন্য এক নারী কণ্ঠের আওয়াজ- “আমার গায়েও হাত দিসে এই লোক। আপা, একটু সরে দাঁড়ান। কি আর করবেন?” ঝাঁঝালো কণ্ঠ এবার বলল- “আগে বলেন নাই কেন? আপনাদের মত অনেক মেয়ে চুপচাপ থাকে বলেই এরা অন্যদের সাথে আবার একই কাজ করে।” বাসের অন্য সবাই চুপচাপ। জ্যামে বাস আটকে পড়তেই সন্দেহের ব্যক্তি বাস থেকে নেমে চলে গেল।

স্কুটি চালিয়ে যাচ্ছিল বিশ্ববিদ্যালয় পুড়ায়া এক ছাত্রী। জ্যামে আটকে থাকতেই পাশের মাইক্রোবাসের চালকের টিপ্পনী, “আফা দেখি হুন্ডা চালায়। গাড়ির সাথে বাইজা গেলেই বুজবেন মজা।” জ্যাম শেষে চলতে শুরু করার সুযোগে ছোট্ট ধাক্কা লাগলো স্কুটিতে। সেই মাইক্রোবাসের ধাক্কা। স্কুটিসহ পড়ে গেল মেয়েটি। ছুটে এলো চালক। মেয়েকে টেনে তুলতে তুলতে বলল- “আফার হাত তো খুব নরম।” সাথে নোংরা হাসি আর চাহুনি তো আছেই।

বিচ্ছিন্ন দুটি ঘটনা। কিন্তু দুটি ঘটনাই নারীদের রাজপথের নিরাপত্তাহীনতার প্রতিচ্ছবি। এমন ঘটনা প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ঘটেই চলেছে। স্কুটি চালানো নারী চালককে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া, ফাঁকা যানবাহনে নারী যাত্রীকে তুলে অন্য পথে নিয়ে যাবার চেষ্টা, মিছিল বা সমাবেশের মধ্যে রাস্তায় নিপীড়নের শিকার হওয়া, গণপরিবহনে মেয়েদের পোশাক ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে দেওয়া, নোংরা ও আপত্তিকর মন্তব্য ছুড়ে দেওয়া, লোলুপ দৃষ্টিতে তাকানো এগুলো এখন প্রায় স্বাভাবিক নোংরামিতে পরিণত হয়েছে। আর বড় ধরনের সহিংসতার মধ্যে আছে গুম, খুন, ধর্ষণ, রাজপথে ছুরি মারা, এসিড ছোড়া ইত্যাদি।

সব বয়সী নারীই এইসব নোংরামির শিকার। সেটা স্কুল ছাত্রীই হোক, কিংবা বয়স্কা। নারী মাত্রই নিগ্রহের শিকার। সব পেশার নারী ভুক্তভোগী। বিশেষ করে যারা একা চলাফেরা করেন, তারাই আক্রান্ত হচ্ছেন সব থেকে বেশি। আর যেসব নারী প্রয়োজনে রাত করে পথে বের হচ্ছেন, তারা যে কতটা ভুক্তভোগী সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নারী সাংবাদিক, শিক্ষক, ডাক্তার, উকিল, ছাত্রী, নাট্যকর্মী, গার্মেন্টস কর্মী, গৃহিণী কে নেই সেই দলে? সব জাতি, পেশা, ধর্ম এখানে মিলেমিশে একাকার। হিংস্র জঘন্য পুরুষের লালসার শিকার হবার জন্য শুধু একটা পরিচয়ই যথেষ্ট—নারী।

একজন নারী রাস্তায় বহু মানুষের চোখের সামনে অপমানিত হলে কতটা লজ্জিত হয়, মনের উপর কতটা চাপ পড়ে সেটা ভুক্তভোগী মাত্রই উপলব্ধি করেন। কখনো কখনো সেটা মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণও হয়ে দাঁড়ায়। রাতের পর রাত জেগে থাকা, ঘুমালে দুঃস্বপ্নে ভয় পেয়ে জেগে ওঠা, যে কোনো বয়সের পুরুষ দেখলেই তাকে নোংরা, মস্তিষ্ক বিকৃত মানুষ ভাবা তার জন্য কি খুব অস্বাভাবিক?

যেখানে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের রিশার মত স্কুল ছাত্রী নিরাপদ না, বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু নিরাপদ না সেখানে অন্য নারীদের নিরাপত্তার আশা করাটা বোকামি নয় কি? কী অপরাধ ছিল হাজারীবাগের ২৭ বছরের মা আকলিমা বেগমের? সন্তানকে নিয়ে স্কুলে পৌঁছানোর আগেই উপহার পেতে হল এসিড? আমরা লজ্জিত ইয়াসমিন, তনু, রিশা, মিতু, বিউটি, আকলিমা। এত লজ্জা নিয়েও আমরা মায়ের জাতি বলে গর্ববোধ করি। মায়ের জাতি হিসেবে সামান্য সম্মান কি আমাদের প্রাপ্য নয়?

তাই বলে কি মুখ বুজে মেনে নিবে সব? বেশিরভাগ ঘটনা থেকে যায় আড়ালে। নিজে ও তার পরিবার লজ্জায় গোপন করে। অনেক নারীই সরাসরি প্রতিবাদ করেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফল হয় উল্টো। ভুক্তভোগী নারীকেই কটূক্তি, পাল্টা অপমান সইতে হয়। খুব কম ক্ষেত্রেই লোকে এগিয়ে আসেন সাহায্য করতে, নিশ্চুপ দর্শকের সংখ্যাই বেশি। এখন প্রতিবাদের ধরন পাল্টেছে। অনেকেই ফেসবুকে নিজের ওয়ালে কিংবা মেয়েদের বিভিন্ন গ্রুপে ছড়িয়ে দিচ্ছে তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা। সেখানেও নানান ঝক্কি, তুলে নিচ্ছেন পোস্ট। মামলার ঝামেলায় জড়াতে চান না প্রায় কেউই।

ছোট্ট শিশু পরম মমতায় তার বাবার কাছে নির্ভরতা আর নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে বেড়ে ওঠে। নারীদের এই অপমান প্রতিটি ভাই, বাবার জন্য অপমানের। যেন সমস্ত লজ্জার দায়ভার তাদের। একদল সুস্থ, বিবেকবান পুরুষই পারে সামাজিক অবক্ষয়, অসুস্থ চিন্তাধারাকে চিরতরে রুখে দিতে। কিছু বিকৃত মানসিকতার মানুষের নোংরা কর্মের জন্য সমস্ত পুরুষ তাদের মাথায় অপবাদের বোঝা বয়ে বেড়াবেন, সেটা নিশ্চয়ই কাম্য নয়।

তানজিনা আকতারী মৌমি: সংবাদ পাঠক, বাংলাদেশ বেতার

Comments

The Daily Star  | English
ACC finds Nagad corruption evidence

ACC raids Nagad HQ over hiring controversy

"During the drive, the ACC team found initial evidence of irregularities in the recruitment process"

48m ago