পুলিশ, রাষ্ট্র না বোঝে গোলাপের ভাষা!

সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান ‘অন্যায্য’ এবং ‘বৈষম্যমূলক’ কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত অনেক ছাত্রকে রবিবার বিকালে দেখা গেল শাহবাগ এলাকায় দায়িত্বরত পুলিশদের গোলাপের শুভেচ্ছা জানাতে চেষ্টা করছে। তারা পুলিশের দিকে লাল গোলাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। পুলিশ নেয়নি।
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীরা রবিবার ফুল এগিয়ে দিলে পুলিশ তাদের ফিরিয়ে দেয়। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

গোলাপের ভাষা যদি পুলিশকে বুঝতে দেওয়া হতো তাহলে কি ঘটনা অন্যরকম হতে পারতো না?   

সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান ‘অন্যায্য’ এবং ‘বৈষম্যমূলক’ কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত অনেক ছাত্রকে রবিবার বিকালে দেখা গেল শাহবাগ এলাকায় দায়িত্বরত পুলিশদের গোলাপের শুভেচ্ছা জানাতে চেষ্টা করছে। তারা পুলিশের দিকে লাল গোলাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। পুলিশ নেয়নি। গোলাপের শুভেচ্ছা গ্রহণ করতে তাদের অস্বীকার করার কারণ জানা যায় কয়েক ঘণ্টা পর। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমের আসার পর পুলিশ বাহিনী হামলা চালায় আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর। লাঠিপেটা, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ এবং জল কামানের ব্যবহার করে রাস্তা থেকে ছাত্রদের হটিয়ে দেয়। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন পরবর্তীতে সহিংস আকার ধারণ করে। মধ্যরাতে সরকারি দলের একজন নেতা শাহবাগে উপস্থিত হয়ে ঘোষণা দেন যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, ওবায়দুল কাদের, যিনি ক্ষমতাসীন দলেরও সাধারণ সম্পাদক আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনায় বসবেন।

আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে এটাই চাওয়া হচ্ছিল যে সরকার তাদের দাবি নিয়ে তাদের সাথে আলোচনা করুক। রবিবার রাস্তায় অবস্থান নেওয়ার পরে তারা বার বার এ ঘোষণাই দিয়েছেন। কিন্তু কেন সরকারের তরফ থেকে গভীর রাতের উদ্যোগটা দিনের বেলায় নেওয়া হলো না? এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির ভেতরে নিহিত থাকতে পারে। সরকার এবং সরকারি দলের বাইরে যারা, তাদের দাবি যত যৌক্তিক এবং ন্যায্য হোক না কেন সরকার শুরুতে তাতে কর্ণপাত করে না। আন্দোলন দমানের চেষ্টা করে। আন্দোলন দমন করতে আছে রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী। সাথে আছে রাষ্ট্রের পুলিশি ক্ষমতা; মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ক্ষমতা। দমন করতে পারলে সরকার সফল। কিন্তু আন্দোলন সহিংস আকার ধারণ করার পর যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া শুরু করে, তখন সরকার আন্দোলনকারীদের দাবির প্রতি কর্ণপাত করে; আলোচনার প্রস্তাব দেয়। অথচ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামতে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যেকোনো দাবি দাওয়া বা বিতর্ক নিষ্পত্তি করাই উত্তম উপায়। আন্দোলনকারীদের দমন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করা কোনো সভ্য রাষ্ট্রের নিয়ম-নীতির মধ্যে পরে না। বলপ্রয়োগ করা পুলিশি রাষ্ট্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য; এটা কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চরিত্র হতে পারে না। পুলিশ, রাষ্ট্র বোঝে না গোলাপের ভাষা; জানে না আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান খুঁজতে। বলপ্রয়োগ একমাত্র নীতি হিসেবে দেখা দেয়। আর পুলিশ বাহিনীকে বলপ্রয়োগ কাজে মাত্রাতিরিক্ত অপব্যবহার করার ফলটা আরও অনেক বেশি ক্ষতি বয়ে আনে। রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহার হতে হতে পুলিশ তাদের প্রকৃত দায়িত্ব এবং কাজগুলো পালনে অক্ষম হয়ে পড়ে। সরকারের নীতিনির্ধারণে যারা আছেন তারা বিষয়গুলো নিয়ে যত দ্রুত ভাববেন ততই দেশ, জনগণ এবং সর্বোপরি সরকারেরও মঙ্গল।

আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে টিয়ার শেল ছুড়ছে পুলিশ। ছবি: স্টার

শাহবাগ এলাকায় ছাত্ররা রাস্তা অবরোধ করেছেন; যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এ জন্য কি ছাত্ররা এককভাবে দায়ী? এটাইতো আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি; আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জন-জীবন ব্যাহত করে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা, সরকারকে বাধ্য করা আলোচনার টেবিলে বসতে। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল অতীতে এ কাজ করেছে। দিনের পর দিন তারা হরতাল অবরোধ ডেকেছে; স্বাভাবিক জন-জীবন বিপর্যস্ত হবার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে পড়েছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে গেছে। ছাত্ররা কি তাদের কাছ থেকেই এ রাজনৈতিক সংস্কৃতি শিখছে না? আন্দোলনের নামে স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত যাতে না হয় সেটা নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রকে; সরকারের নীতি নির্ধারকদেরকে গোলাপের ভাষা বুঝতে হবে; আলাপ-আলোচনার পথ অনুসরণ করতে হবে। পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার করে আন্দোলন দমানোর নীতি পরিহার করতে হবে।

এবার দেখা যাক, আন্দোলনকারীদের কোটা সংস্কারের দাবি কতটা যৌক্তিক। বেসামরিক প্রশাসনে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান পদ্ধতিতে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য এক শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, আদিবাসীদের জন্য পাঁচ শতাংশ, অনগ্রসর জেলার জন্য ১০ শতাংশ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এবং নাতি-নাতনীদের জন্য ৩০ শতাংশ। বাকি ৪৪ শতাংশ মেধা ভিত্তিক। কিন্তু আমাদের সংবিধান বিদ্যমান কোটা পদ্ধতিকে কতটা অনুমোদন দেয়?

সংবিধানের প্রস্তাবনায় দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে “আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।”

কোটা সংস্কারের দাবিতে লেখা পোস্টার মাড়িয়ে চলেছে পুলিশ। ছবি: পলাশ খান

প্রস্তাবনার আলোকেই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ঘোষণা এবং নাগরিকের মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের একটি মূলনীতি হিসাবে সংবিধানের ১৯ (১) অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, “সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।” অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন নীতি প্রণয়নে এ নীতি প্রতিফলিত হবে।

আবার সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতাকে নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৯ (১) বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।” রাষ্ট্র যদি এ বিধানের পরিপন্থি কোনো আইন বা নীতি প্রণয়ন করে তাহলে সংবিধানের ২৬ (২) অনুচ্ছেদ অনুসারে তা বাতিল হয়ে যাবে।

তেমনি সংবিধানের ১৪০ (১) (ক) অনুচ্ছেদে সরকারি কর্ম কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, “প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগের জন্য উপযুক্ত ব্যাক্তি দিগকে মনোনয়নের উদ্দেশ্যে যাচাই ও পরীক্ষা পরিচালনা করা।”

তাহলে কোটা পদ্ধতির আইনগত ভিত্তি কী? সংবিধানে একটু ব্যতিক্রম রাখা হয়েছে। সংবিধানের ২৯ (৩) (ক) অনুচ্ছেদে “নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা হইতে”- রাষ্ট্রকে নিবৃত্ব করিবে না। এই বিশেষ বিধানের আলোকে প্রতিবন্ধী, নারী, আদিবাসী এবং অনগ্রসর জেলার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত জন্য কোটা সংরক্ষণ করা যুক্তিযুক্ত হতে পারে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এবং নাতি-নাতনীদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের যুক্তি এবং আইনগত ভিত্তি কোথায়? মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এবং নাতি-নাতনীদের জন্য কোটা সংরক্ষণে আবেগপূর্ণ অনেক কথা বলা যেতে পারে। তারাও কি সমাজের অনগ্রসর অংশ হিসেবে এ সুবিধা ভোগের দাবি করতে পারেন?

বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংস্কারের প্রস্তাব দীর্ঘ দিনের। অনেক আলোচনা হয়েছে। কোটা পদ্ধতি সংস্কারের পক্ষে যুক্তি অনেক জোরালো। ছাত্ররাও আন্দোলন করছেন কয়েক বছর ধরে। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে সাড়া মিলছে না। রাস্তা অবরোধ করে আর আন্দোলন নয়; আন্দোলন দমনে পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার নয়। কোটা পদ্ধতি সংস্কারের পক্ষে- বিপক্ষে আলোচনা দরকার, বিতর্ক হোক। সরকারকেও খোলা মনে এগিয়ে আসতে হবে; কোটা পদ্ধতির সংস্কার করা যাবেই না এমন চিন্তা পরিহার করতে হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

5h ago