‘রাজাকারের বাচ্চা’ বনাম মুক্তিযোদ্ধা কোটা
যুক্তি না থাকলে কেউ কেউ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অশোভন ভাষা ব্যবহার করেন, কটাক্ষ করেন, এমনকি অশালীন ভাষায় গালি পর্যন্ত দেন। এসব করে তিনি নিজের মনের ঝাল মেটাতে চান; এক ধরনের মানসিক শান্তি লাভ করেন।
সোমবার জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সমালোচনা করতে গিয়ে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তাতে মনে হতেই পারে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে গিয়ে যুক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। দাবির সমালোচনা করে তিনি বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরা সুযোগ পাবে না, রাজাকারের বাচ্চারা সুযোগ পাবে? তাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংকুচিত হবে?”
সন্তানতুল্য ছাত্র-ছাত্রীদের এমন ভাষায় আক্রমণ করে তিনি কী শান্তি লাভ করেছেন? কাউকে কি খুশি করতে পেরেছেন?
তবে মতিয়ার এমন আক্রমণে সরকারের ভেতরের সমন্বয়হীনতা প্রকাশ পেয়েছে। কেননা তার বক্তব্যর কয়েক ঘণ্টা আগে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিদের সাথে সচিবালয়ে তার কার্যালয়ে বৈঠক করে আশ্বাস দিয়েছেন কোটা পদ্ধতি পর্যালোচনা করে দেখা হবে। তার আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিরা ৭ মে পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত রাখার ঘোষণা দেন। একটা অংশ অবশ্য মন্ত্রীর আশ্বাসের উপর আস্থা রাখতে পারেননি; তারা বিক্ষোভ চালিয়ে যাবার ঘোষণা দেন এবং আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।
মতিয়া চৌধুরীর এমন আক্রমণাত্মক বক্তব্যর পর মন্ত্রী কাদেরের আশ্বাসের উপর আস্থা রাখা পক্ষও তাদের আস্থা হারিয়ে ফেলেন। তার সাথে আবার যোগ হন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। পরদিন তিনি জানান দেন আগামী বাজেটের পর কোটা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করা হবে। অর্থাৎ জুনে বাজেট পাশ হবে। জুলাই মাসের আগে কোটা ব্যবস্থা পর্যালোচনা শুরুই হবে না। ওবায়দুল কাদের সময় নেন এক মাস; আর অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা মতে আড়াই মাস পর পর্যালোচনা শুরু হবে।
সরকারের নীতি নির্ধারকদের ভেতরকার এমন সমন্বয়হীনতা আন্দোলন স্থগিত এবং চালিয়ে যাবার প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত পক্ষকে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করে। আন্দোলন স্থগিত করা অংশও আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন।
সরকার কি আসলেই কোটা পদ্ধতি সংস্কার চায়? নাকি আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনার নামে সময় ক্ষেপণ করতে চায়?
তবে একটা বিষয় নিশ্চিত, কোটা পদ্ধতি সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে একটা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় আনতে হলে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন আনতে হবে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। কারণ অন্য জায়গায় খুব বেশি কাট-ছাট করার সুযোগ নেই।
দুই
সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা সংরক্ষণে বঙ্গবন্ধুর নীতি যথাযথ ভাবে অনুসরণ করা হলে আজকের এত জটিল পরিস্থিতির হয়তো সৃষ্টি হতো না।
বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্ব যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছিল প্রাণ বাজি রেখে আধুনিক সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে; দেশ স্বাধীন হবার পর স্বপ্নের বাংলাদেশ গঠনে মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তিনি সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা চালু করেন। ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে জারি করা আদেশে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা রাখা হয়।
তবে বঙ্গবন্ধুর সরকার আমলে এবং পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অনেকের চাকরি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যেভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করেছিলেন তাতে এ কোটার মেয়াদ, চালু হবার তারিখ থেকে, পরবর্তী সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্য আপনা আপনি শেষ হয়ে যাবার কথা। তেমনটাই হচ্ছিল। সরকারি কর্ম কমিশনের তথ্য অনুযায়ী ১৯৮২ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি প্রার্থীর সংখ্যা লক্ষ্যণীয় মাত্রায় কমতে শুরু করে। ১৯৮৯-৯০ সাল নাগাদ এটি এক শতাংশে নেমে আসে; বাকি ২৯ শতাংশ কোটা অপূর্ণ থেকে যায়। কোটা নীতির সংস্কারের প্রয়োজন দেখা দেয়। সংস্কারের প্রস্তাব ও দাবি জোরালো হতে শুরু করে। সরকারি কর্ম কমিশন মুক্তিযোদ্ধা কোটা কমিয়ে পাঁচ শতাংশ করার প্রস্তাব দেয়। এবং নারী কোটা বৃদ্ধির প্রস্তাব করে। ১৯৮৭ সাল থেকে এক দশক ধরে সরকারি কর্ম কমিশন সামগ্রিক কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের কথা বলে গেছে। কোনো সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি।
বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃতে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসে ১৯৯৬ সালে। পরের বছর হাসিনার সরকার মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সংস্কার আনে। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেলে অপূর্ণ কোটায় মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের অগ্রাধিকার দেওয়ার বিধান চালু করা হয়। কিন্তু এ সংস্কার ও আস্তে আস্তে অকার্যকর হতে শুরু করে। স্বাধীনতার এত বছর পর মুক্তিযোদ্ধা কোটায় মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থী পাওয়া অসম্ভব। শেষ পর্যন্ত তাদের সন্তান, নাতি-নাতনিদের দিয়েও এ কোটা পূরণ অসম্ভব হয়ে পরে।
তিন
মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সুবিধা পেতে হলে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম থাকতে হবে। শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়ন নিয়ে বিতর্ক। মুক্তিযোদ্ধা তালিকা নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির মত গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অনেকের মতে, এ বিতর্কের মুলে রয়েছে সরকারি চাকরি প্রাপ্তিতে সুবিধাসহ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারি আর্থিক সুযোগ-সুবিধা। মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও তালিকায় নাম লেখানো; মুক্তিযোদ্ধার জাল সনদে চাকরি নেওয়ার অভিযোগ অহরহ উঠছে। ২০১৪ সালে পাঁচ জন সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল হয়ে গিয়েছিল, যার মধ্যে খোদ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিবও ছিলেন। ভুয়া সনদ দিয়ে তিনি চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন।
স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়নি৷ বিগত এবং বর্তমান সরকার আমলে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে একটি নির্ভুল তালিকা প্রণয়নের। কিন্তু পদে পদে অনিয়ম- দুর্নীতির কারণে শুধু বিতর্কের মাত্রাই বেড়েছে। এ সব কিছুর মধ্য দিয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, যারা দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন, যারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়ে শোষণ এবং বৈষম্যমুক্ত স্বপ্নের দেশ গড়তে চেয়েছিলেন, তাদের প্রতি কি যথাযথ সম্মান দেখানো হচ্ছে?
চার
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সার্টিফিকেট দেওয়া নিয়ে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং মুক্তিযুদ্ধের অপব্যবহার রুখতে হলে যেসব জায়গায় সংস্কার অতি জরুরি তার মধ্যে অন্যতম হলো সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা।
কেবল মাত্র অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা রাখার অনুমোদন দেয় আমাদের সংবিধান। মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের বংশধরদের মধ্যে কেউ কেউ অনগ্রসর অবস্থায় থাকতে পারেন। তাদেরকে এ বিশেষ সুবিধা দেওয়া যেতেই পারে। তাই বলে ঢালাওভাবে সকল মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের বংশধরদেরকে “অনগ্রসর জনগোষ্ঠী” হিসেবে আখ্যায়িত করে বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখা সংবিধান সম্মত হতে পারে না।
তাই সংস্কারের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনঃনির্ধারণ এবং এ কোটা সুবিধা কারা পাবেন তার জন্য কিছু নিয়মনীতি চালু করা উচিত। যাতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান যারা নানা কারণে সমাজের অনগ্রসর অংশে অবস্থান করছেন তারা যেন কোটা সুযোগ-সুবিধা পান। আবার কোনো মুক্তিযোদ্ধা বা তার পরিবারের কোনো সদস্য কোটার সুবিধা একবার নিলে ওই পরিবারের আর কেউ এ সুবিধা দাবি করতে পারেন না। অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে জাল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে কেউ যেন আগের মতো এ বিশেষ সুবিধা নিতে না পারে সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
সরকারি চাকরিতে জেলা কোটা নিয়েও অনেক অনিয়ম এবং বৈষম্যর অভিযোগ উঠেছে। যে কারণে জেলা কোটা বাতিলের দাবি জোরালো হচ্ছে। তাই গোটা কোটা ব্যবস্থার সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে।
যে কাজ সরকারের নিজ উদ্যোগে অনেক আগেই করা উচিত ছিল সরকারগুলোর ব্যর্থতার ভার আজ ছাত্রসমাজের কাঁধে চেপেছে। তারা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে। দুর্ভাগ্যজনক হলো, কৃষিমন্ত্রীর ভাষায় “তারা রাজাকারের বাচ্চা”! কৃষিমন্ত্রীর মতো আরও যারা আন্দোলনকারীদের নিয়ে কটাক্ষ করছেন তারা ভেবে দেখবেন তারাই কিন্তু এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সন্তান। তাদের বাপ-দাদারা হয়ত সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। তাই বলে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেননি। বরং তাদের অনেকে নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতা করেছেন।
১৬ কোটির বেশি মানুষের দেশে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, তাদের বংশধর এবং রাজাকার, তাদের বংশধরদের বাইরে যে বিশাল জনগোষ্ঠী আছে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীরা কিন্তু তাদেরই সন্তান। তাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে বিভাজন টানার আগে ঠান্ডা মাথায় সব দিক চিন্তা ভাবনা করে দেখা উচিত।
কৃষিমন্ত্রীর উচিত সংসদে দেওয়া তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে দুঃখ প্রকাশ করা। তিনি যদি তা না করেন তবে স্পিকারের উচিত সংদের কার্যবিবরণী থেকে মন্ত্রীর আপত্তিকর বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করা।
Comments