প্রসঙ্গ কোটা: মাথা ব্যথা? কেটে ফেলুন!
মাথা ব্যথা? কী করবেন? ওষুধ খেয়ে ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে পারেন। সেটা স্থায়ী নয়। মাথা আছে, তো ব্যথা আবার হবেই। স্থায়ী সমাধান একটাই- মাথাটা কেটে ফেলুন। আর কখনো ব্যথা হবে না!
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি চালুর পর থেকেই তা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলেছে। কোনো কমিশন বলেছে সংস্কার করতে; কোনো কমিশন বলেছে এ পদ্ধতি বাদ দিতে। কোটা পদ্ধতিতে সংস্কার চেয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা আগেও আন্দোলন করেছে। এই দফা তাদের আন্দোলন অনেক বড় আকার ধারণ করেছে। দেশের মহাসড়কগুলো অবরোধের মাধ্যমে বলতে গেলে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল করে দিয়েছে। জনজীবনে অনেক ভোগান্তি বয়ে এনেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, কোটা নিয়েই যত ঝামেলা। তাদের দাবি অনুযায়ী একবার এ ব্যবস্থায় সংস্কার করা হলে এক বছর বা দুই বছর পর আবার সংস্কারের দাবি উঠবে; আন্দোলন হবে; রাস্তা ঘাটে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটবে। তাই এ ব্যবস্থা থেকে স্থায়ী সমাধানের উপায় একটাই- কোটা ব্যবস্থাই বাতিল করে দেওয়া। ঠিক, মাথা ব্যথার স্থায়ী সমাধানের মত।
এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়েও এমন হয়েছে। অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়। এ ব্যবস্থা নিয়েও ঝামেলা শুরু হয়। যার ফল ২০০৬ সালের শেষ দিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সঙ্কট এবং ২০০৭ সালের শুরুতে জরুরি অবস্থা জারি। এ ব্যবস্থার সংস্কারের প্রস্তাব নিয়েই ঝামেলা শুরু হয়। এ ব্যবস্থা বহাল থাকলে হয়ত ঝামেলা আবার হত। তাই এ ব্যবস্থাই বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে। এটাও ঠিক, মাথা ব্যথায় মাথা কেটে ফেলে স্থায়ী সমাধান পাওয়ার মতো ব্যাপার।
দুই
আইন, পদ্ধতি, প্রতিষ্ঠান, এমনকি ব্যক্তিকেও সময়ের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে নিজের ভেতর নানা পরিবর্তন ও উন্নয়ন করতে হয়। সহজ কথায় এটাই হল সংস্কার। এটা না করলে কোনো আইন আস্তে আস্তে তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে; কোন পদ্ধতি আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পরে। প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত হয়ে যায়। এমনকি ব্যক্তিও অন্যদের থেকে পিছিয়ে পরে। টিকে থাকার জন্য আমরা নিজেরা প্রতিনিয়ত কত পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাই। অনেকগুলো সম্পর্কে আমরা জানি, বুঝতে পারি। আবার এমন কিছু পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যেতে হয় যেগুলো স্বয়ংক্রিয়। পরিবর্তন বা সংস্কারের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে আমাদের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা চালু করেন। কোটা সুবিধার প্রকৃত দাবিদার যারা তারাই যেন এ সুবিধা পান; কেউ যেন একাধিকবার এ সুবিধা ভোগ করতে না পারেন এবং অপব্যবহার বন্ধ করতে অনেক আগেই কোটা সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছিল। কিন্তু বিগত কোনো সরকারই কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। সবাই চোখ বুজে থেকেছে। বর্তমান সরকারও বিগত সরকারগুলোর নীতি অনুসরণ করে গেছে। ছাত্র আন্দোলন যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল তখন সরকারের তরফ থেকেও নেওয়া হলো কট্টর সিদ্ধান্ত- সরকারি চাকরিতে কোনো কোটা থাকবে না। ৪৫ বছর পর বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার বিকালে জাতীয় সংসদে এ ঘোষণা দেওয়ার আগ পর্যন্ত বিষয়টা কল্পনাতীত ছিল। ঘোষণা কি একতরফা হয়ে গেল না? গত কয়েক দশকে কোটা সংস্কার নিয়ে তথ্য এবং যুক্তি নির্ভর দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বাতিলের ঘোষণার আগে কোথাও কি কোনো আলোচনা হয়েছে? মন্ত্রীসভায় কোনো আলোচনা হয়েছে? সংসদে হয়েছে? কোনো সেমিনার সিম্পোজিয়াম হয়েছে? আমলাদের নিয়ে গঠিত কোনো কমিটি এমন সুপারিশ করেছে? এমন কিছু হয়েছে বলে কোন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তবে কি ছাত্র আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় তাদের প্রতি পাল্টা চাল দিতেই কোটা বাতিলের ঘোষণা? নাকি ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ?
তিন
কোটা পদ্ধতি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা মানে হল আমাদের দেশে “অনগ্রসর” জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব নেই। দেশে পিছিয়ে পরা আদি গোষ্ঠী নেই? শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ সুবিধা দরকার নেই? নারীর ক্ষমতায়নের জন্য নানা পর্যায়ে সরকারি চাকরিতে তাদেরকে আর বিশেষ সুবিধা দেওয়ার প্রয়োজন নেই? নারী সমাজ যদি সরকারি চাকরি পেতে সব ক্ষেত্রে পুরুষদের সাথে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে যাবার যোগ্য হয়ে ওঠে তাহলে তাদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারের সকল প্রতিষ্ঠানে যে সংরক্ষিত আসন বহাল আছে সেগুলো রাখার প্রয়োজনও কি ফুরিয়ে গেছে? নির্বাচন কমিশনের সাথে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সকল স্তরের কমিটিতে ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব নির্বাচনের যে বিধান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সেটাও তবে পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।
আরও একটা কথা বলতেই হয়, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থেকে আমরা এত দিন বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে বাণিজ্য এবং ঋণ পেতে যেসব বিশেষ সুবিধা ভোগ করছিলাম সে সবেরও আর দরকার নেই? স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বের হবার প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করেই আমরা উন্নত দেশের কাতারে চলে গেলাম?
চার
যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটু ভাবতে হয়। আর বিষয়টা যদি গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল হয় তাহলে অনেক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত এবং সিদ্ধান্তের ফলাফল কী হতে পারে তা নিয়েও চুলচেরা বিশ্লেষণ করা জরুরি। খামখেয়ালীপনা নির্ভর কোনো পদক্ষেপ কখনো কারো জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে না। সেটা দেশ সমাজ পরিবার ব্যক্তি সবার বেলায় প্রযোজ্য।
Comments