আবুল মনসুর আহমদকে নিয়ে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হলো আন্তর্জাতিক সেমিনার

কলকাতায় অনুষ্ঠিত হলো ‘আবুল মনসুর আহমদ ও সমকালীন বাংলা: ইতিহাস ও সাহিত্য’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সেমিনার। পশ্চিমবঙ্গের নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভাষা, অনুবাদ ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র’ এবং আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পরিষদ, বাংলাদেশ- যৌথভাবে এই সেমিনারের আয়োজন করে।
কলকাতায় ‘আবুল মনসুর আহমদ ও সমকালীন বাংলা: ইতিহাস ও সাহিত্য’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনারে আলোচকবৃন্দ। ছবি: স্টার

কলকাতায় অনুষ্ঠিত হলো ‘আবুল মনসুর আহমদ ও সমকালীন বাংলা: ইতিহাস ও সাহিত্য’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সেমিনার। পশ্চিমবঙ্গের নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভাষা, অনুবাদ ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র’ এবং আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পরিষদ, বাংলাদেশ- যৌথভাবে এই সেমিনারের আয়োজন করে।

গতকাল শনিবার স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টায় সেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সল্টলেক ক্যাম্পাসে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত সেমিনারের তিন পর্বে বক্তারা সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদ-এর জীবন, দর্শন নিয়ে গভীর আলোকপাত করেন এবং বর্তমান প্রজন্মের কাছে বরেণ্যে এই ব্যক্তির জীবনাদর্শ তুলে ধরার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। কলকাতার গবেষক এবং সাংবাদিকরাও এতে উপকৃত হবেন-এমনটাই মনে করেন তারা।

এদিন সকালের সেমিনারের উদ্বোধন করেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক ড. সেলিনা হোসেন। এ সময় দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, ভারতের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সাধন চক্রবর্তী,  নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শুভ শঙ্কর সরকার এবং নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মানববিদ্যা অনুষদের অধিকর্তা মননকুমার মণ্ডল মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দুই দেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হয়।

সেমিনারের প্রথম পর্বে ‘দেশভাগ, হিন্দু-মুসলমান বিরোধ ও আবুল মনসুর আহমদের ব্যঙ্গরচনা’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. চেঙ্গীশ খান।

‘সমকালীন পূর্ববঙ্গ ও আবুল মনসুর আহমদের কথাসাহিত্য’ শীর্ষক আরেকটি প্রবন্ধ যৌথভাবে পাঠ করেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. বরেন্দু মণ্ডল ও কলকাতা প্রেসক্লাবের সভাপতি সাংবাদিক  স্নেহাশিস শূর।

দুপুরের পর অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বের ‘আবুল মনসুর ও বাঙালি মুসলিম মানসের ক্রমবিবর্তন (১৯৪০-১৯৭০)’ শীর্ষক প্রবন্ধের পাঠ বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. রাজর্ষি চক্রবর্তী।

এখনো আবুল মনসুর আহমদ কতটা প্রাসঙ্গিক সেই বিষয়ে আলোচনা করেন কবি ও আবুল মনসুর আহমদ স্মারকগ্রন্থের সম্পাদক ইমরান মাহফুজ। আলোচনায় অংশ নেন কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হাবিব আর রহমান।

আলোচকদের মধ্যে সাংবাদিক অংশুমান শূর বলেন, রাজনীতি সাহিত্য এবং সাংবাদিকতার ত্রিধারা যুক্ত মানুষ ছিলেন আব্দুল মনসুর আহমদ। প্রথমে তার সাহিত্যিক হওয়ার স্বপ্ন, এরপর সাংবাদিক এবং তার রাজনৈতিক জীবন। তিনটি ধারার বহমান হওয়া বর্ণময় জীবনের অধিকারী ছিলেন তিনি। তিনি আরও বলেন, স্বল্প দিনের জন্য হলেও দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায়তেও ছিলেন। একজন মানুষ, শুরু সাংবাদিক হিসেবে ব্যাঙ্গ সাহিত্যিক হিসাবে তার দূতি ছড়িয়েছেন এবং পরবর্তীতে রাজনীতিক।

প্রথম তিনি সাপ্তাহিক মোহম্মদীতে কাজ শুরু করেন। সেখানে মতান্তর হওয়ার পর দ্য মুসলমান পত্রিকায় যুক্ত হন। তখনকার দিনে ৬৫ টাকা বেতন পেতেন তিনি। ইংরেজি লেখার জন্যই সাংবাদিক হিসাবে তার খ্যাতি ছিল। কৃষক প্রজা সমিতির উদ্যোগে প্রকাশিত কৃষক পত্রিকায় কাজ করেছেন। নবযুগ ও এ কে ফজলুল হক এবং ইত্তেহাদ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন।

অধ্যাপক সাধণ চক্রবর্তী বললেন, আমরা কিছু ভুল করেছি। ইতিহাস যদি আমরা ঠিক মতো পড়াশোনা করি, আমাদের যে ইতিহাস যেখানে যদিও কোনো ভুল থাকে সেটাকে শুধরে নেওয়ার সুযোগ এমন আলোচনায় থাকে। তৎকালীন ইতিহাস ও সাহিত্যের মধ্যদিয়ে বিশ্লেষণ করলে এর ভুলগুলো আমরা খুঁজে পাবো। আমরা যারা সমাজ নিয়ে ভাবি, বিশ্ব নিয়ে ভাবি তাদের কাছে এই ধরণের আলোচনা একটা বড় পাওয়া।

অধ্যাপক শুভ শঙ্কর সরকার বললেন, আবুল মনসুর আহমদ-এর মতো একজন দূরদর্শী মানুষের ভূমিকা ইতিহাসে আছে সেটাকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, ২০১৮ সালে আমি বলবো আবুল মনসুর আহমদ কৈশোরে বয়সেই এতো গভীরভাবে ভেবেছিলেন, সেই চেতনাকে ধারণ করেই যেমন তিনি বিস্তৃত করেছেন নিজের পরিসর, বিস্তৃতি করেছেন বাঙালির সামাজিক চেতনা বোধের জায়গা, বাংলা সাহিত্যকে বাঙালি মুসলমানের জীবনের পটভূমিতে বিস্তৃত করেছেন। যদি সাহিত্য একটি জনগোষ্ঠীর উত্তরণের অংশ হয়ে দাঁড়ায় সেই জায়গাটি তৈরি করার জন্য তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন এবং তার অনেক কিছু পরিচর্যার জায়গা ছিল, রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি নানা জায়গা তিনি তার চিন্তা-ভাবনা সব কিছু নিয়োগ করেছেন। এই সময় তিনি ১৯৩৫ সালে তার প্রকাশিত আয়না গ্রন্থের উদাহরণও টানেন।

আজও কেন বিভক্ত ভারতে আবুল মনসুর আহমদ প্রাসঙ্গিক এই বিষয়ে আলোচনা করেন মাহফুজ ইমরান। বলেন, আজ একজন হিন্দু আমাকে যে ভাই বলছে সেটা করে দেওয়ার কাজ করেছেন আবুল মনসুর আহমদ। হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরির কাজ করেছেন তিনি। ভারতবর্ষে অনেক জনগোষ্ঠী পিছিয়ে আছে। আজ সেই পিছিয়ে থাকা সেই জনগোষ্ঠীর ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে আবুল মনসুরের আহমদের মতাদর্শ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

তিনি আরও বলেন, ব্যঙ্গ সাহিত্যের মাধ্যমে ধর্ম কী মানুষ কী, জাতি কী সেটা আবুল মনসুর আহমদ দেখিয়ে গিয়েছেন।

আবুল মনসুর আহমদের পুত্র ও দ্য ডেইলি স্টার এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এই উদ্যোগের জন্য সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ দিয়ে বলেন, তারা দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা প্রকল্পের মতো বড় একটা কাজ হাতে নিয়েছে। সেই কাজের অংশ হিসাবেই প্রথমবার আবুল মনসুর আহমদের সাহিত্য, তার রাজনীতি নিয়ে এই ধরণের একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করেছে।

মাহফুজ আনাম এসময় কলকাতার তার বাবার জীবন নিয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনাও করেন। বলেন, কলকাতা শহর ১৯২২-১৯৩৯ এবং দ্বিতীয় দফায় ১৯৪৯ পর্যন্ত ইত্তেহাদ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তার বাবা। আবুল মনসুর আহমদের সাহিত্য রচনার মধ্যে খুব মূল্যবান কিছু বই কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল বলেও জানান দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক।

তিনি বলেন, আয়োজকরা নতুন ভাবে কলকাতার পাঠকদের, কলকাতার গবেষকদের এবং কলকাতার সাহিত্যিকদের আবুল মনসুর আহমদকে পরিচিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন সেটা সত্যিই গর্বের এবং কৃতজ্ঞতার।

এই সময় তিনি বলেন, দেশভাগের ইতিহাসে যেসব লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিকরা অবদান রেখেছেন তার মধ্যে আবুল মনসুর আহমদ একজন। প্রতিবছর এই ধরণের একটি আলোচনা চক্র করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন মাহফুজ আনাম।  

অনুষ্ঠানের মধ্যহ্নভোজের পর আবুল মনসুর আহমদের ওপর নির্মিত ১৫ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

6h ago