পণ্য মূল্য এবং বেনাপোল- পেট্রাপোল বন্দরের জটিলতা

বাংলাদেশে পণ্য মূল্য বৃদ্ধির জন্যে সব সময় কারণ দরকার হয় না। কারণ ছাড়াও বাড়ে, একবার বাড়লে কমে না। এমনটা মোটামুটি সাধারণ নিয়ম হয়ে গেছে। কারণ না থাকলেও রমজানে দাম বৃদ্ধি নিয়মিত বিষয় হয়ে গেছে।
Benapole Landport
বেনাপোল স্থলবন্দর। স্টার ফাইল ছবি

বাংলাদেশে পণ্য মূল্য বৃদ্ধির জন্যে সব সময় কারণ দরকার হয় না। কারণ ছাড়াও বাড়ে, একবার বাড়লে কমে না। এমনটা মোটামুটি সাধারণ নিয়ম হয়ে গেছে। কারণ না থাকলেও রমজানে দাম বৃদ্ধি নিয়মিত বিষয় হয়ে গেছে।

আসন্ন রমজানে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না। প্রতিবারের মত বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এবারও একথা বলেছেন। বাণিজ্যমন্ত্রীর যুক্তি রমজানে   যে পণ্যের যে পরিমাণ চাহিদা তার চেয়ে বেশি মজুদ আছে। আমদানি করা হয়েছে, রোজার শুরুর আগেই আরও আমদানি হয়ে দেশে চলে আসবে। বাজারে কোনো পণ্যের ঘাটতি থাকবে না। চাহিদা অনুযায়ী পণ্য বাজারে থাকবে। ফলে দাম স্বাভাবিক থাকবে বা দাম বাড়বে না। বাণিজ্য মন্ত্রীর কথায় সত্যতা আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রায় কোনো সময়েই দাম পণ্যের ঘাটতির কারণে বাড়ে না। প্রায় সব সময়ই বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণ পণ্য থাকে,তারপরও দাম বাড়ে- রমজানে বাড়ে অস্বাভাবিক হারে।

চালের দাম যখন বাড়ল, বাজারে চালের যে খুব একটা সংকট ছিল তা কিন্তু নয়। সরকারের মজুদ কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল কেজিতে ১৫ থেকে ২২ টাকা। ভারতে তখন চালের দাম বাড়েনি। ভারত চাল রপ্তানিও করছিল। সরকার শুল্ক কমিয়ে দিয়েছিল, আমদানি হয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ দেশে আসছিলও। দাম কমছিল না। মজার ব্যাপার হলো বাংলাদেশে দাম যেভাবে বেড়েছিল,চালের দাম সেভাবে আর কমেনি।

রমজানে পণ্য বৃদ্ধির মূল কারণ ‘চাহিদা ঘাটতি’ নয়। বাজারের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকা,অবাধ রাজনৈতিক চাঁদাবাজি  পুলিশি চাঁদাবাজি। এবং ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফার মানসিকতা। টিসিবি নামক সরকারি সংস্থাটির কোনো কার্যকারিতা নেই। রাজনৈতিক দল- সংগঠনের নামে পণ্য পরিবহনের সময় সারা বছর যে চাঁদাবাজি চলে, রোজার সময় তা বেড়ে যায় অত্যধিক মাত্রায়। একইভাবে সারা বছরের চেয়ে রোজার সময় পুলিশের চাঁদার পরিমাণও বেড়ে যায়। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ কমিশনারকে তা বলেছেনও ব্যবসায়ী নেতারা।

চাঁদাবাজি বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ কমিশনার। তা কতটা কার্যকর হবে, সন্দেহ সব মহলেই থাকছে।

রমজানে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির জন্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা খাদ্য মন্ত্রণালয়কে অভিযুক্ত করলেও, এর সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বড়ভাবে সম্পৃক্ত।

রমজানসহ বিভিন্ন সময়ে হঠাৎ হঠাৎ জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে কিছু আমদানি জটিলতারও দায় আছে। বাংলাদেশ চালসহ নানাবিধ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করে ভারত থেকে। বেনাপোল স্থল বন্দর দ্রুত পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের  কাছে কাছে গুরুত্ব পায়। আমদানির ক্ষেত্রে বেনাপোল বন্দরের রয়েছে নানাবিধ জটিলতা।

বাংলাদেশের বেনাপোল এবং ভারতের পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে আমদানি রপ্তানি নিয়ে ভারতের ‘দ্য হিন্দু বিজনেস লাইন’ একটি সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,

 ‘পার্কিং কম্পাউন্ডের ভেতরে ডজন খানেক ট্রাক সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশে রপ্তানির জন্যে পণ্য রয়েছে সেই ট্রাকগুলোতে। কিন্তু, সেগুলো আটকা পড়ে রয়েছে এখানে। কেননা, স্থলবন্দরে রয়েছে পণ্যজট। তাই, বনগাঁওয়ে বেসরকারি উদ্যোগে এরকম আরও অনেক পার্কিং প্লেস এবং ওয়ারহাউজ তৈরি হয়েছে। চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিনে দিনে বাড়ছে এগুলোর সংখ্যাও। ’

২০১৭ সালের ১ আগস্ট থেকে পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ২৪ ঘণ্টা স্থলবাণিজ্য শুরু হলেও এই সীমান্ত দিয়ে বাণিজ্যের গতি বাড়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অথচ, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের জন্যে ব্যবসায়ীরা এই পথটিকেই বেশি পছন্দ করে থাকেন।

২০১৬-২০১৭ সালে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ৭.৫ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্যের ৩৫ শতাংশই হয়েছিল পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে। ভারতীয় মুদ্রার হিসাবে এর পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৫০১ কোটি রুপি। তবে ২০১৭-২০১৮ সালের মোট বাণিজ্যের হিসাব পাওয়া না গেলেও জানা যায় এই পথে বাণিজ্য সামান্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৭৯৮ কোটি রুপিতে।

স্থলবন্দরের কর্মকর্তারা জানান, বন্দরে ক্লিয়ারেন্সের গতি আগের থেকে একটু বেড়েছে। আগে যেখানে দিনে ৩০০ পণ্যবাহী ট্রাককে ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হতো এখন সেখানে দেওয়া যাচ্ছে ৪৫০টি ট্রাক। কিন্তু, প্রতিদিন যখন ৩,৫০০ ট্রাক রপ্তানি পণ্য নিয়ে সীমান্তে আসে  সেই তুলনায় ক্লিয়ারেন্সের গতি নগণ্যই বলা যায়।

বন্দরের সিএন্ডএফ এজেন্টদের সংগঠনের একজন প্রতিনিধি কার্তিক চক্রবর্তীর দাবি, যে সংখ্যক ট্রাক ক্লিয়ারেন্স পায় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ক্লিয়ারেন্স পাওয়া ট্রাকও।

সাধারণত, পচনশীল পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার জন্যে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা থাকলেও গত বছর থেকে কটন ফেব্রিকসের চল্লিশটির বেশি সিলগালা করা কন্টেইনার কার্গোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। আবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দিনে গড়ে ১০০টি ট্রাকের চেসিসের কন্টেইনারগুলোর জন্যে অগ্রাধিকার চাওয়া হচ্ছে।

সেই হিসাবে ২০০টির মতো কনসাইনমেন্টকে অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা হয়েছে। ফলে অধিকাংশ রপ্তানিকারকের জন্যে রয়েছে সীমিত সুযোগ। এ কারণে, পণ্যজট একটি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সীমান্তের ভারতীয় অংশে বিভিন্ন পার্কিং প্লেসে গড়ে ১০ দিনের মতো অপেক্ষা করতে হচ্ছে পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে। এর জন্যে পাকিং ফি হিসাবে ট্রাকগুলোকে অতিরিক্ত ৪,০০০ রুপি বেশি গুণতে হচ্ছে। এর সঙ্গে চাঁদাবাজি তো রয়েছেই।

এটা ভারতীয় পেট্রাপোল অংশের চিত্র। এবার দেখা যাক বাংলাদেশ অংশের চিত্র।

বেনাপোলে দুষ্টচক্র

বেনাপোলে কার্গো ক্লিয়ারেন্সের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বাংলাদেশে যাত্রীদের টার্মিনালের উন্নতির জন্যে খরচ করা হলেও কার্গো পরিচালনা ব্যবস্থায় রয়েছে হতাশাব্যাঞ্জক চিত্র। বিশেষ করে, ভারতীয় অংশে যেখানে আধুনিক কার্গো হ্যান্ডেলিং সুবিধা রয়েছে তার তুলনায় বেনাপোলে সেই ব্যবস্থা অপ্রতুল।

যেখানে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্য আপলোড করতে বন্দরের ভারতীয় অংশে গড়ে ১২ ঘণ্টা সময় লাগে সেখানে বাংলাদেশে লাগে গড়ে ছয়দিন।

ফলে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা মনে করেন, অবকাঠামোগত অসুবিধা এবং অপর্যাপ্ত ওয়ারহাউজের কারণে বেনাপোলে ট্রাকগুলোকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

এছাড়াও, ট্যারিফ ব্যবস্থাতেও রয়েছে গড়মিল। ভারতীয় অংশে প্রথম ২৪ ঘণ্টা পর বাকি সময়ের জন্যে দিনে ৫,০০০ রুপি অতিরিক্ত ফি দিতে হচ্ছে। কিন্তু, বাংলাদেশে এমন ব্যবস্থা না থাকায় প্রভাবশালী আমদানিকারকরা বেনাপোল বন্দরকে তাদের কম খরচের ওয়ারহাউজ হিসেবে ব্যবহার করছেন।

ভারত থেকে আমদানি করা পণ্য প্রায়শই মাসের পর মাস বেনাপোল স্থলবন্দরে পড়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশের বাজার বুঝে ধীরে-সুস্থে পণ্য খালাস করা হয় বলে অনেকেই জানান। বিশেষ করে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্যে তাৎক্ষণিকভাবে আমদানি করা পণ্যও দীর্ঘসূত্রিতার ফাঁদে পড়ে কখনও কখনও। আবার ব্যবসায়ীরা আমদানি করে এনেও বন্দরে রেখে দেয়, সুবিধাজনক সময়ে বেশি লাভের প্রত্যাশায়।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অব ইকোনমিক মডেলিং (এসএএনইএম)-এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হানের মন্তব্য, স্থলবন্দরটির বাংলাদেশ অংশে পর্যাপ্ত জায়গার অভাবে এবং যে জায়গা রয়েছে তার যথাযথ ব্যবহার না করার কারণে অনেক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।

কার্গো ক্লিয়ারেন্সের ধীর গতির কারণে সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ পণ্যজট। ফলে ভারতীয় অংশে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠছে ওয়ারহাউজ এবং পার্কিং প্লেস। ট্রাক মালিকদের অভিযোগ তারা প্রতি ট্রিপে বাংলাদেশে ৩,০০০ রুপি থেকে ৪,০০০ রুপি মাস্তানদের চাঁদা দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

সূত্র মতে, “বন্দরে ২৪ ঘণ্টা ক্লিয়ারিং ব্যবস্থার পরও তা সাধারণ ব্যবসায়ীদের কাছে তেমন কোনো সুফল বয়ে আনেনি। বেনাপোলে কার্গো ব্যবস্থাপনার উন্নতি হলে এর সুফল পাওয়া যেতে পারে। ”

বাংলাদেশে পণ্য মূল্য বৃদ্ধির কারণগুলোর মধ্য,বেনাপোলসহ স্থল বন্দরগুলোর অব্যবস্থাপনা একটি কারণ।

Comments

The Daily Star  | English

How hot is too hot?

Scientists say our focus should not be on just heat, but a combination of heat and humidity

56m ago