স্থান কখনও ‘শূন্য’ থাকে না
প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ করে না। না, বিজ্ঞান নিয়ে লিখছি না। তবে রাষ্ট্র বিজ্ঞান বা রাজনীতি জাতীয় কিছু একটা বলা যেতে পারে। সাধারণ জনমানুষের ধারণা বা প্রত্যাশা ছিল অনেকটা এমন যে, শাসকদের অন্যায়- অনিয়ম বা জনস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদের শুরুটা হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তার সঙ্গে যোগ দেবে অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু ঢাকা বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সেই চরিত্রটা সম্ভবত আর অক্ষুণ্ণ থাকছে না।
গত কিছু বছর ধরে চিত্রটা বেশ দৃশ্যমানভাবে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। অনেকগুলো জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান জনস্বার্থ পরিপন্থি। জনস্বার্থের পক্ষে অবস্থান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। তারা আন্দোলনের ধরনে, দাবি আদায়ের প্রক্রিয়ায় ভিন্নমাত্রা যোগ করেছেন। ঢাকা বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন সরকার সমর্থক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়ে, অন্যায়- অনৈতিকতার পক্ষেও অবস্থান নিচ্ছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অন্যায়- অনৈতিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে জনমানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করছেন। ঢাকা বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকার মানসিকতায় পরিবর্তন হচ্ছে। দু’একটি ঘটনার আলোকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব।
১. বাংলাদেশের জন্মের আগে থেকেই আন্দোলন- সংগ্রামের পথ দেখানো প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই ঐতিহ্যের ধারক অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও।
অন্যায়- অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দৃষ্টান্ত জন্ম দিয়েছে বারবার।
১৯৯০ তো বটেই, সর্বশেষ ২০০৭-এও পথ দেখিয়েছে। প্রতিবাদ- প্রতিরোধে মানুষকে সাহসী হতে শিখিয়েছে।
প্রতিবাদ-প্রতিরোধ এবং সাহসিকতার পরিচয় যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই দেখিয়েছিলেন তা নয়। শিক্ষকরাও সব সময় শিক্ষার্থীদের পাশে থেকেছেন। বর্তমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা গত কয়েক বছরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেন তার সেই চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। এ কারণেই বলছি স্থান ‘শূন্য’ না থাকার কথা। কয়েকটি উদাহরণ দেই-
ক. প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা বেতনের দাবি নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা শহীদ মিনারে জমায়েত হয়েছিলেন। পুলিশ নির্দয়ভাবে পিটিয়েছিল, পেপার স্প্রে নিক্ষেপ করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা নীরব ছিলেন। এত বড় অন্যায়- অনৈতিকতার প্রতিবাদ করেননি। শিক্ষকদের পাশে দাঁড়াননি।
খ. পহেলা বৈশাখে টিএসসি এলাকায় নারীদের নিপীড়ন করা হয়েছে। ছাত্র ইউনিয়নসহ বাম ছাত্র সংগঠনগুলো প্রতিরোধ-প্রতিবাদের চেষ্টা করেছে। প্রতিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে ক্যাম্পাস দখলে রাখা ছাত্রলীগ। শিক্ষকরা নীরব থেকেছেন।
গ. কিছুদিন আগে ছাত্রীদের শারীরিক এবং মানসিকভাবে নাজেহাল করা হয়েছে, যৌন নিপীড়ন করা হয়েছে। কারা করেছে জানা থাকার পরও শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নীরব থেকেছে। চিহ্নিত নিপীড়ক, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়ন করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
ঘ. যৌন নিপীড়নকারীদের বিচারের দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের কাছে গেছেন। পর পর তিনটি গেটে তিনটি তালা দিয়ে উপাচার্য রুমে বসে থেকেছেন। শিক্ষার্থীরা তালা ভেঙ্গে উপাচার্যের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছেন। উপাচার্য ছাত্রলীগ ডেকে শিক্ষার্থীদের পেটানোর ব্যবস্থা করেছেন।
২. এই তালিকা আরও অনেক বাড়ানো যায়। সেদিকে না গিয়ে এর বিপরীত চিত্রটার দিকে দৃষ্টি দেওয়ার চেষ্টা করি-
ক. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ভ্যাট আরোপ করল সরকার। তারা ফেসবুকে পেজ খুলে প্রতিবাদ জানালেন। স্মারকলিপি দিলেন। সমাজের অনেকেই তাদের ‘ফার্মের মুরগি’ বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করলেন। তাদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে সামান্যতম গুরুত্ব দেওয়া হলো না। তাতে প্রতিবাদ থেমে গেল না।
খ. এক পর্যায়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এলেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন দমন করার মত করেই সরকার পুলিশ দিয়ে আন্দোলন থামানোর চেষ্টা করল। নির্যাতন চালানো হলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা শিক্ষার্থীরা তখন তাদের পাশে দাঁড়ালেন না। এখনকার কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পাশে দাঁড়িয়েছেন।
রাজনীতি না করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছেন, কিন্তু একটি গাড়ি-মার্কেট বা দোকান ভাঙচুর করেননি। ‘নো ভ্যাট গুলি কর’- শ্লোগান ধারণ করে ন্যায্য দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করেছেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন অহিংস, কিন্তু কার্যকর আন্দোলন আগে কখনো হয়নি।
গ. উত্তরা ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্রীকে বাসে যৌন নিপীড়নের চেষ্টা চালায় তুরাগ পরিবহনের হেলপার-ড্রাইভাররা। কৌশলে নিপীড়ন থেকে রক্ষা পান সেই ছাত্রী। ছাত্রীর অভিভাবক থানায় মামলা করেন।
ইউনিভার্সিটি ফিরে সহপাঠীদের জানান। সকল শিক্ষার্থী একত্রিত হয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। আবদুল্লাহপুরগামী তুরাগ পরিবহনের বাসগুলো উত্তরায় থামান শিক্ষার্থীরা। একে একে আটক করেন তুরাগ পরিবহনের ৩৫টি বাস। ইউনিভার্সিটির পাশের রাস্তায় নিয়ে বাসগুলো দাঁড় করিয়ে চাবি নিয়ে নেন শিক্ষার্থীরা। বাসের চাবি নিজেদের জিম্মায় নিয়ে বাসগুলো তারা পাহারা দিয়ে রাখেন। যাতে কেউ বাসের ক্ষতি করতে না পারেন।
শিক্ষকসহ পুরো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে যোগ দেন। শিক্ষার্থীরা আলটিমেটাম দেন আগামী ১৬ ঘণ্টার মধ্যে, যৌন নিপীড়ক ড্রাইভার- হেলপারদের গ্রেফতার করতে হবে। যদি তা করা না হয়, আটক বাসগুলোর ক্ষতি হলে দায়- দায়িত্ব তাদের থাকবে না। ১৬ ঘণ্টা সময় অতিক্রম করার আগেই ড্রাইভারসহ অভিযুক্ত তিন নিপীড়ককে গ্রেফতার করে পুলিশ। উল্লেখ্য উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ব্যতিক্রমী আন্দোলনে পুলিশ সহায়কের ভূমিকা পালন করেছে।
অন্যায়ের প্রতিবাদ, অন্যায়কারীর শাস্তির দাবির এমন অভিনব পদ্ধতি অনুসরণ করে সব মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা অর্জন করেছেন বেসরকারি উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
ঘ. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন জন শিক্ষার্থীকে চোখ বেঁধে টেনে হেঁচড়ে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গেল ডিবি। এর বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষকরা কোনো প্রতিবাদ করলেন না। প্রতিবাদ করলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ছাত্রনেতা- শিক্ষক নেতা, কর্মীরা এর বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না। কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের রাবার বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াননি শিক্ষকরা। মানববন্ধন করেছেন ‘ভিসির বাড়ি ভাঙ্গল কেন’র প্রতিবাদে।
একজন ছাত্র বুকে গুলি নিয়ে ঘুরছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার খবরও রাখছেন না। ছাত্রীদের যৌন নিপীড়নের কথা লেখার শুরুতে বলেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিপীড়কদের বাঁচিয়েছে। মাঝরাতে কবি সুফিয়া কামাল হল থেকে তিনজন ছাত্রীকে বের করে দেওয়ার ঘটনার প্রতিবাদ তো দূরের কথা, সমর্থন করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো তুলনা চলে না। কিন্তু উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয় কি কিছুটা লজ্জা দিতে সক্ষম হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে?
৩. ক্ষমতাসীনরা বিশেষ করে সামরিক সরকারগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী চরিত্র বদলে দেয়ার চেষ্টা করেছে সব সময়। ভয় দেখিয়ে কখনো তা পারেনি। লোভ দেখিয়ে দু’একজনকে কিনে নিলেও, তাতে কিছু আসে যায়নি। বর্তমান সময়ে সরকারের সকল কাজে সমর্থন দেওয়াটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিয়মিত কাজের অংশ মনে করছেন। অন্যায়-অনিয়ম-অনৈতিক সব কিছুকে তারা সমর্থন করছেন।
ধারণা করা হচ্ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, সেখান থেকে যদি প্রতিবাদ-প্রতিরোধ না হয়, তবে নিশ্চিন্তে থাকা যাবে। সেই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, দিচ্ছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সরাসরি রাজনীতি না করা শিক্ষার্থীরা। তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন তাদের মতো করে, অত্যন্ত কার্যকর অভিনব পদ্ধতিতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাম ছাত্র সংগঠনগুলো সরব-সক্রিয় আছেন। সরব-সক্রিয় আছেন শিক্ষকদের একটা অংশও। তারা সংখ্যায় বেশি না হলেও মনোবলে শক্তিশালী। দেশের মানুষের সমর্থন আছে তাদের প্রতি। ইতিমধ্যে প্রমাণ হয়েছে বিএনপির ছাত্র সংগঠন সক্রিয় না থাকলেও, আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ছাত্র সমাজের স্বার্থের বিপরীতে অবস্থান নিলেও, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হয়। সেই প্রতিবাদ প্রতিরোধে তাচ্ছিল্য করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শ্রদ্ধা-ভালোবাসা অর্জন করে নেন। পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে ঘোষিত কর্মসূচি না দিয়েও, ন্যায্যতার প্রশ্নে একসঙ্গে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করতে পারেন।
নিজেরা অন্যায়ের পক্ষ নেব- প্রতিবাদ করব না, অন্যদের করতেও দেব না, তা আর সম্ভব না।
ছাত্রদল অংশ না নিলে, ছাত্রলীগ প্রতিবাদের প্রতিরোধ-বিরোধিতা করলেও, ন্যায্যতার আন্দোলন সংগঠিত হয়। তাদের জন্যে স্থান শূন্য পড়ে থাকে না, প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী। ছাত্রলীগ এবং তাদের সমমনা উপাচার্য-শিক্ষকরা যদি তা বুঝতে পারেন তো ভালো, না বুঝলে দিন দিন শুধু গুরুত্বহীন অশ্রদ্ধার মানুষে পরিণত হতে থাকবেন।
Comments