দায় শিক্ষামন্ত্রীর, জেলে কেন শিক্ষার্থীরা

Nurul Islam Nahid
৩ মে ২০১৮ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন যে এসএসসি পরীক্ষা আবার নেওয়া যৌক্তিক হবে না। ছবি: স্টার/ তুহিন শুভ্র অধিকারী

‘আগে অনেকে খাতা না দেখেই নম্বর দিয়ে দিতেন। এখন ভালো করে খাতা দেখার ফলে গতবারের মতো এবারও পাসের হার কমেছে।’

কথাগুলো বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।

গাজীপুর আর স্যাটেলাইট উত্তেজনায়, শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য মানুষের অতটা নজরে আসেনি-যতটা আসার কথা।

‘আগে’ মানে সেই ‘আগে’ যে ‘আগে’ও নুরুল ইসলাম নাহিদই শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর সময়ের শুরু থেকেই অভিযোগটি সামনে এসেছিল, পাসের হার বাড়ানোর জন্যে নির্দেশনা দিয়ে পাস করানো হচ্ছে। যাদের পাস করার কথা নয়, তাদেরও পাস করানো হচ্ছে। খাতা না দেখে বা ভুল লিখলেও নম্বর দেয়া হচ্ছে। যাদের সাধারণভাবে পাস করার কথা, তারা পেয়ে থেকে জিপিএ ৫। ফলে প্রকৃত পড়াশোনা করা আর পড়াশোনা না করা শিক্ষার্থীরা একাকার হয়ে গেছে। মৌখিকভাবে এই নির্দেশনা- যারা খাতা দেখতেন- তাঁদের দেওয়া হয়েছিল।

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ তখন এই অভিযোগের সত্যতা অস্বীকার করেছেন। ‘খাতা না দেখে’ নাম্বার যে দেওয়া হতো, এখন তা স্বীকার করছেন। শিক্ষার কি করুণ চিত্র, খাতা না দেখেই নাম্বার দেওয়া হতো। আর এই করুণ চিত্রের নির্মাতা শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।

এখন পাসের হার কিছুটা কম হওয়ায় শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, ‘খাতা ভালো করে’ দেখা হয়েছে। বাস্তবে চিত্র আগেও যা ছিল, এখনও তেমনই আছে। পাস করার জন্যে পড়াশোনা করতে হয় না, তা শিক্ষার্থীরা জেনে গেছে। সবাই এমন করছে না, তবে অনেকেই করছে।

‘সহনীয় মাত্রায় ঘুষ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে’ আলোচিত হয়েছেন নুরুল ইসলাম নাহিদ। এবার এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার সময় প্রশ্নফাঁস বিষয়ে কথা বলেছেন। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে যারা পরীক্ষা দিয়েছেন, তাদের প্রতি কঠোর হুশিয়ারি বা হুমকি দিয়েছেন। আজকের লেখার বিষয় এই হুশিয়ারি বা হুমকি।

১. ‘যারা একবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, ধরা পড়েছেন তাদের সবার পরীক্ষা, ছাত্রজীবন, শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’

প্রশ্ন ফাঁস হওয়া নিয়ে কম আলোচনা হয়নি। আজ পর্যন্ত কোনো অনুসন্ধান বা আলোচনাতেই এই তথ্য বের হয়ে আসেনি যে, শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন ফাঁস করেছেন বা প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা জড়িত। যতবার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ বা তথ্য প্রমাণ সামনে এসেছে, ততবার শিক্ষামন্ত্রী তা অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, প্রশ্ন ফাঁস হয়নি, ফাঁসের গুজব ছড়ানো হয়েছে। এখন এসে তিনি অন্তত স্বীকার করছেন যে, প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। এক সময় প্রশ্ন ফাঁসের জন্যে সকল দায় শিক্ষকদের উপর চাপিয়েছেন। এখন সকল দায় শিক্ষার্থীদের উপর চাপাচ্ছেন। চাপাচ্ছেন মানে তাদের জেলে রেখেছেন। এসএসসি পরীক্ষার্থীরা বাংলাদেশের আইনানুযায়ী শিশু। সেই শিশুদের শিক্ষামন্ত্রী হুমকি দিয়ে বলছেন, ‘এদের সবাইকে খুঁজে বের করতেছি। কেউই রেহাই পাবে না।’

এই শিশু শিক্ষার্থীদের অপরাধ কী? প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে। আগে থেকে ঘোষণা দিয়ে অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিকাশে অর্থ পাঠালে প্রশ্ন পাঠানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এই ঘোষণা দেখে একজন দুজন বা দুই-চার হাজার নয়, অনেক অনেক শিক্ষার্থী-অভিভাবক প্রশ্ন সংগ্রহ করেছেন। সবাই যে অর্থ দিয়ে সংগ্রহ করেছেন, তাও নয়। যারা ফাঁস করল, অনলাইনে ছড়িয়ে দিল, তাদের সন্ধান করলেন না- ধরলেন না। ধরলেন সেই প্রশ্ন যেসব শিক্ষার্থীদের হাতে এলো তাদের কয়েকজনকে।

২. এসএসসি পরীক্ষা চলাকালীন ১৫৭ জন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে জেলে রাখা হয়েছে। পরে আরও শতাধিক শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন এই তথ্য শিক্ষামন্ত্রী নিজে দিয়েছেন।

বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছিল শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. কায়কোবাদের সঙ্গে। প্রশ্ন ফাঁস না হওয়ার উপায় বের করা কমিটির তিনি অন্যতম সদস্য। তারা একটি রিপোর্টও ইতিমধ্যে দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের শাস্তি বা জেলে রাখা বিষয়ে ড. কায়কোবাদ বলেন, ‘যা অন্যায়, যা অনৈতিক এমন কিছু আমরা ধরব না, ছুঁয়ে দেখব না। এমন প্রত্যাশা আমাদের থাকতে পারে। থাকা উচিত। কিন্তু, আমরা কোন সমাজে বাস করি? যে সমাজে সর্বত্র অন্যায়-অবিচার-অনৈতিকতা। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন সামনে এসেছে, শিক্ষার্থীরা অনেকে তা সংগ্রহ করেছে। ফাঁস তো শিক্ষার্থীরা করেনি। তাদের শাস্তি দিতে পারেন না, জেলে তো রাখতে পারেনই না।’

প্রশ্ন ফাঁস কী করে ঠেকানো যায়, সে বিষয়ে কাজ করেছেন, রিপোর্ট দিয়েছেন ড. কায়কোবাদ। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ১০ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৫ হাজারের বেশি পরীক্ষার্থীর হাতে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র যায়নি। প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। মাত্র ৫ হাজার শিক্ষার্থী তা পেল, বাকিরা পেল না। কী এমন মেকানিজম বা প্রযুক্তিগত সুবিধা নিয়ে ‘৫ হাজার’ বিষয়ক তথ্য জানলেন শিক্ষামন্ত্রী? এমন কোনো মেকানিজম বা প্রযুক্তি আছে কিনা, জানতে চাইলাম ড. কায়কোবাদের কাছে।

‘দেখেন বিষয়গুলো এত সহজ নয়। এতজন পেয়েছে, এর বেশি পায়নি- এটা কোনো কথা নয়। প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, কেন ফাঁস হয়েছে, সেটা জানা দরকার। কারা ফাঁস করেছে, তা জানা দরকার। শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টারে কেন যায়, তা অনুধাবন করা দরকার। যে কারণে যায়, সেটা জেনে সমাধান করা দরকার। কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার দরকার নেই। স্কুলে ঠিকমতো পড়াশোনা হলে কেউ কোচিং সেন্টারে যাবে না। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ‘৫ হাজার’ সংখ্যার মধ্যে তা সীমাবদ্ধ ছিল না, থাকার কথা না। অনলাইনে যারা প্রশ্ন পেয়েছে সেই পরীক্ষার্থীরা কোনো দোষ করেনি। যারা ফাঁস করেছে তারা দোষী, যারা ফাঁস ঠেকাতে পারেনি, তারা দোষী।’

ফাঁস ঠেকানোর উপায় সম্বলিত একটি রিপোর্ট তো আপনারা দিয়েছেন।

‘আমাদের  কাজের পরিধি খুব  বড় ছিল না। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করে একটা রিপোর্ট দিয়েছি। এখানে সবচেয়ে বড় বিষয়, সত্য আগে স্বীকার করতে হবে। স্বীকার না করলে সমাধান মিলবে না। সাধুবাদ জানাই এবারের এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পেরেছে। আশা করি তা আগামী পরীক্ষাগুলোতে অব্যাহত থাকবে। আর শিক্ষার্থীদের জেল বা শিক্ষাজীবন নষ্ট করা ঠিক হবে না। তারা দোষী না।’

৩. শিক্ষামন্ত্রী দাবি করেছেন, প্রশ্ন ফাঁস করেছে শিক্ষকদের একটা অংশ। সাধারণভাবে সংবাদকর্মী হিসেবে যা জেনেছি- দেখেছি, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে যারা জড়িত তারা সবাই শিক্ষামন্ত্রীর অধীনের কর্মকর্তা-কর্মচারী। সরকারের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রণালয় নুরুল ইসলাম নাহিদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যে মন্ত্রী তাঁর কর্মকর্তাদের ‘ঘুষ খাবেন না’ বলেন না, ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা। মন্ত্রী পরামর্শ দেন ‘ঘুষ খান তবে সহনীয় মাত্রায় খান’। সেই মন্ত্রী ফাঁস হওয়া প্রশ্ন সংগ্রহ করার মত ‘অনৈতিক’ কাজের জন্যে শিশু শিক্ষার্থীদের জেলে ঢুকিয়েছেন। ছাত্র জীবন-শিক্ষা জীবন, ধ্বংস করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্যে একজন কাউকে যদি দায়ী করা হয়, সেই একজন শিক্ষামন্ত্রী নিজে। শিক্ষামন্ত্রী দায় কোনো বিবেচনায় কোনো যুক্তিতেই, এড়াতে পারেন না। ফাঁস হওয়ার যাবতীয় তথ্য-প্রমাণ অস্বীকার করে, শিক্ষামন্ত্রী আরও বড় দায় নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছেন। এখন আবার ‘৫ হাজার’ তত্ত্ব সামনে এনেছেন । যার কোনো গ্রহণযোগ্য ভিত্তি নেই। শিক্ষামন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগেও যদি প্রশ্ন ফাঁস হয়ে থাকে, তা ৫ হাজার শিক্ষার্থীর হাতে গেছে, অন্যদের হাতে যায়নি- এটা কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্য নয়। আর প্রশ্নপত্র শুধু ২০/৩০ মিনিট আগেই ফাঁস হয়নি, আগের রাতেও ফাঁস হয়েছে। অনলাইন পোর্টাল, পত্রিকায় সেই ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ছাপা হয়েছে, টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে। লক্ষ লক্ষ পরীক্ষার্থী তা দেখেছেন। শিক্ষার্থীদের উপর দায় চাপিয়ে, জেলে রেখে, নিজে দায়মুক্ত হওয়া যাবে না। খাতা না দেখে নম্বর দেওয়া মানে অনৈতিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা। সহনীয় মাত্রায় ঘুষ খেতে বলা মানে সমাজে অবক্ষয় ডেকে আনা, অবক্ষয় টিকিয়ে রাখা। এসব কাজের কোনোটাই শিক্ষার্থীরা করছেন না। সুতরাং শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষার্থীদের হুমকি দিতে পারেন না, জেলে রাখতে পারেন না। প্রশ্ন ফাঁসের জন্যে তারা দায়ী নয়।

Comments

The Daily Star  | English
Khaleda Zia calls for unity

‘Seize the moment to anchor democracy’

Urging people to remain united, BNP Chairperson Khaleda Zia has said the country must quickly seize the opportunity to institutionalise the democratic system.

6h ago