বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি, বঙ্গবন্ধু-১ দেখেছি
একটা সময় হয়তো দেখবেন যখন সময়কেন্দ্রিক একটা সীমারেখা চালু হয়ে যাবে স্যাটেলাইট পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী প্রজন্ম, যেমনটা ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধের বেলায়। স্যাটেলাইট প্রযুক্তির ব্যবহারের হিসাব মেলাতে এমনটা হতেই পারে।
আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, বই পড়ে বা সে সময়ের মানুষদের কাছে শুনে মুক্তিযুদ্ধকে জানি। স্যাটেলাইটবিহীন বাংলাদেশও হয়তো তখন জানার বিষয় হয়ে যাবে। কারণ আমার বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু-১ এর মাধ্যমে এই যে পথচলা আমাদের শুরু হল সেটি আসলে দুটি সময়ের মধ্যে বড় একটি পার্থক্য তৈরি করে দেবে।
এখন মাত্র একটি স্যাটেলাইট উড়লো, তো কয়েক দিন বাদে দেখবেন আরও স্যাটেলাইট যুক্ত হচ্ছে বহরে। ফলে স্যাটেলাইটের সুবিধা নিয়ে ডিজিটাল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি দেশের তার আগের স্যাটেলাইটবিহীন সময়ের সঙ্গে বড় পার্থক্য হবে এটাই তো স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের কথা আসলেই যেমন অবধারিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধুর কথা আসে। তখন হয়তো দেখবেন সময়ের পরিক্রমায় ডিজিটাইজেশনের কথা আসতেই আসবে স্যাটেলাইট আর বঙ্গবন্ধু-১ এর কথা।
আমরা যারা গত এক দশক ধরে স্যাটেলাইটের খবর লিখে লিখে এর অংশ হয়ে উঠেছি তারাও তখন হয়তো স্যাটেলাইটবিহীন বাংলাদেশ কেমন ছিল সে বিষয়ে গল্প বলতে পারবো, গদ্য রচনা করতে পারবো। ‘জানো জানো, তখন না আমরা হংকং আর থাইল্যান্ডের দুটি স্যাটেলাইট ভাড়া নিয়ে কাজ চালাতাম।’ নিশ্চয়ই গল্পের লাইনগুলো এমনই হবে। ‘চিন্তা করতে পারো, আমাদের তখন নিজেদের একটা স্যাটেলাইটও ছিল না। আমরা ঝড় ঝঞ্ঝাপ্রবণ জাতি তারপরেও দুর্যোগের সময় জরুরি যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় আমাদের না তখন অনেক ভুগতে হয়েছে ….।’ গল্পের গতিধারা এভাবে এগিয়ে যাবে।
দুই সময়ের এই পার্থক্য হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া স্যাটেলাইট এর মধ্যেই হয়ে উঠবে দেশের আর্থসামাজিক এবং সামগ্রিক উন্নতির চালিকা শক্তি। ফলে মুক্তিযুদ্ধ বা বঙ্গবন্ধুকে না দেখলেও বঙ্গবন্ধু-১ দেখা আমাদের প্রজন্মের জন্যে বড় একটা সম্পদ হিসেবেই আবির্ভূত হবে।
কেন এমন কথা বলছি? গতকাল যে স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে তা প্রায় ৪০টি সেবা দেবে আমাদেরকে। এর আগে এই সেবাগুলোর কোনো কোনোটি আমরা অন্য দেশের স্যাটেলাইট থেকে ভাড়া হিসেবে কিনে নিতাম। কোনো কোনো সেবার খরবই হয়তো রাখতাম না। আর সেবা কিনতে গেলে তো আমাদেরকে গুণতে হতো কোটি ডলার। সেটিও আরেকটি ব্যাপার।
উপকূলে ঝড়-বন্যা আসলে তো টেলিযোগাযোগ সেবা বিঘ্নিত হয়। ফলে দুর্গত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগও হয়ে পড়ে কঠিন এক কাজ। উদ্ধার-ত্রাণ এসবও তখন দুরূহ ব্যাপার। সাগরে জেলে মাছ ধরতে গেছে, কিন্তু সাগর ততোক্ষণে মুখ ভার করে ফেলেছে। নিম্নচাপ বা জলোচ্ছ্বাসের আঘাৎ থেকে বাঁচার জন্যে ফিরে আসার যথেষ্ট সময় তার হাতে নেই। নিজস্ব স্যাটেলাইট থাকলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে যেমন অসহায়ের সহায় হবে তেমনি জেলেরাও হয়তো সময় মতো খবরটা পেয়ে ফিরে আসতে পারবে নিরাপদে।
তথ্য প্রযুক্তির প্রসারের এই সময়েও দেশের বিস্তীর্ণ একটি এলাকায় ইন্টারনেট নেই। হাওড়, বাওড়, পাহাড়, উপকূল, দ্বীপ–ইউনিয়ন দিয়ে সংখ্যার হিসাব করলে যা দাঁড়ায় ৭৫০টিতে। এক্ষেত্রে স্যাটেলাইট নিশ্চিত করবে ইন্টারনেটের এই সংযোগ। যদিও সেখানে খরচ একটু বেশিই হবে, কিন্তু ইন্টারনেট সেবাতো অন্তত মিলবে। বহুমাত্রিক সুবিধার এই যে তালিকা সেটি দুটি সময়ের মধ্যে বড় পার্থক্য তৈরি করবে।
এখন আমাদের দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সম্প্রচার কাজের সুবিধা নেয় অন্য দেশের স্যাটেলাইট ভাড়া করে। এর জন্যে বছরে খরচ হয় কোটি ডলার। বঙ্গবন্ধু-১ পুরোদমে কাজ শুরু করলে (যেটা এক মাসের মধ্যেই হওয়ার কথা) নিশ্চয়ই এর ক্যাপাসিটি উল্টো আমরাই ভাড়া হিসেবে দিতে পারব। ফলে এক মাসের ব্যবধানে ভাড়াটিয়ার বাড়ির মালিকানা পাওয়ার অধ্যায়েরও শুরু হবে। নিশ্চয়ই এ এক অভূতপূর্ব রূপান্তরের গল্প হবে তখন।
বঙ্গবন্ধু-১ এর মহাকাশে যাত্রা নিয়ে গত কয়েক মাস নানা পর্যায়ের মধ্য দিয়ে গেছে জাতি। স্যাটেলাইট নির্মাণ এবং উৎক্ষেপণের নানা পর্যায় নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এতো আলোচনা-আগ্রহ যে এখান থেকে সাফল্য কুড়াতে একরকম বাধ্যই হয়ে পড়বে সরকার। ফলে এর পর দেখবেন বঙ্গবন্ধু-১ এর পর বঙ্গবন্ধু-২, বঙ্গবন্ধু-৩ বা বঙ্গবন্ধু-৪ও চলে যাবে মহাকাশে।
কিন্তু প্রথম যেটি, তার হাত ধরে তৈরি হওয়া এই পার্থক্য রেখাই বড় হবে সকলের সামনে। ডিজিটাইজেশনের এই রূপান্তরের জন্যেই যে এখন আমাদের সব অপেক্ষা।
Comments