রোহিঙ্গা: বাংলাদেশের সামনে গভীর সঙ্কট

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়ে নানাবিধ সঙ্কটে আটকে গেছে বাংলাদেশ। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির খেলোয়াড়েরা সবাই নিজেদের লাভের হিসাব করছেন। তাদের হিসাবে বাংলাদেশ নেই। মুখে বললেও কাজে যে বাংলাদেশের স্বার্থ গুরুত্ব পাচ্ছে না, তা মোটামুটি স্পষ্ট।
Rohingya Refugee Crisis
মিয়ানমার থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কক্সবাজারে পৌঁছানোর পর শারীরিক অবসাদে তীরের কাছেই বসে পড়েন এক রোহিঙ্গা নারী। ছবিটি গত ১ আগস্ট শাহপরীর দ্বীপে তোলা হয়। ছবি: রয়টার্স

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়ে নানাবিধ সঙ্কটে আটকে গেছে বাংলাদেশ। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির খেলোয়াড়েরা সবাই নিজেদের লাভের হিসাব করছেন। তাদের হিসাবে বাংলাদেশ নেই। মুখে বললেও কাজে যে বাংলাদেশের স্বার্থ গুরুত্ব পাচ্ছে না, তা মোটামুটি স্পষ্ট। আঞ্চলিক শক্তির সমর্থন অক্ষুণ্ন রেখে, দেশীয় রাজনীতিতে ভাবমূর্তি ঠিক রাখার জটিল সমীকরণ মেলাতে গিয়ে বাংলাদেশ নিজেও সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারছে কিনা, প্রশ্ন উঠছে বারবার। আশ্রয় দিয়ে ‘প্রশংসা’ ছাড়া সঙ্কট থেকে উত্তরণের দিক নির্দেশনার দেখা মিলছে না। রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সামনে আরও জটিল সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে, চলমান ঘটনা প্রবাহ তেমন ইঙ্গিত দিচ্ছে।

 

১. জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমার চাতুরতাপূর্ণ কৌশল নিয়েছে মূলত জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক চাপ থেকে বাঁচার জন্যে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ‘জাতিগতভাবে নিধন’ করেছে, ‘গণহত্যা’ সংঘঠিত করেছে। বাংলাদেশ তো বলেছেই, জাতিসংঘসহ সারা বিশ্ব তা বলেছে। এখনও প্রমাণ না হলেও, আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে তা স্পষ্ট হয়েছে। জাতিসংঘের তৎপরতা ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবির  প্রেক্ষিতে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) জাতিগত নিধন বা গণহত্যার তদন্তের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর ঘটানো ভয়ঙ্কর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে চায় আইসিসি। আগামী ২০ জুন আইসিসি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করবে। আইসিসির সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সারা পৃথিবী বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ‘জাতিগত নিধন’ বা ‘গণহত্যা’র বিষয়টি জেনেছে। আইসিসি বাংলাদেশের কাছে তার অভিমত জানতে চেয়েছে। বাংলাদেশকে আগামী ১১ জুনের মধ্যে প্রকাশ্যে অথবা গোপনে আইসিসিকে মতামত জানাতে হবে। বাংলাদেশ যদি সঠিকভাবে মতামত জানায়, আইসিসিতে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর জেনারেলদের। সত্যিকার অর্থেই চাপে পড়বে মিয়ানমার সরকার।

কিন্তু আইসিসিকে মতামত জানানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সিদ্ধান্তহীন অবস্থায় আছে। সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন এখনও ‘সিদ্ধান্ত হয়নি’।

আন্তর্জাতিকভাবে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের উপর চাপ দেওয়া হোক, তা চায় বাংলাদেশ। ভারত সফরে গিয়েও প্রধানমন্ত্রী সে কথা আবার বলেছেন। সেক্ষেত্রে দেখার বিষয়, বাংলাদেশ আইসিসিকে তার মতামত জানায় কিনা।

 

২. আইসিসিকে বাংলাদেশের মতামত জানানোর ক্ষেত্রে চীন, রাশিয়া এবং জাপানের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। চীন তার নিজের স্বার্থে, মিয়ানমারকে রক্ষা করতে চায়। রোহিঙ্গাদের ফেরত না নেওয়ার মিয়ানমারের যে নীতি, সেই নীতি পরিবর্তনে চীন চেষ্টা করছে বলে মনে হয় না। চীনের মিত্র রাশিয়াও ‘মিয়ানমার-চীন’ নীতির সঙ্গে আছে। এতদিন জাপান চুপ ছিল। এখন কিছুটা সরব হয়েছে। চীন-জাপান-রাশিয়ার অভিন্ন নীতি, আন্তর্জাতিকভাবে নয় বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকট মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করে সমাধান করুক। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘ বা আইসিসিতে যাক, তা চায় না চীন-জাপান-রাশিয়া।

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিশ্ব যখন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে সোচ্চার ছিল, তখন চীনের মধ্যস্থতায় মিয়ানমারের সঙ্গে এক অসম ‘সম্মতিপত্র’ স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। যার ফলে আন্তর্জাতিক চাপের প্রথম ধাক্কা থেকে রক্ষা পেয়েছে মিয়ানমার। এখন আইসিসিতে বাংলাদেশ যদি তার অবস্থান না জানায়, জোরালোভাবে না জানায়, চূড়ান্তভাবে সবচেয়ে বড় চাপ বা বিপদ থেকে বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে মিয়ানমারের।

 

৩. আর্থিক সঙ্কটের সম্ভাবনাও বাংলাদেশের জন্যে বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে।

প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার প্রতিদিনের খাদ্য যোগান দেওয়া নিয়ে সঙ্কট তৈরি হতে যাচ্ছে। এমনটা প্রতীয়মান হচ্ছে আন্তর্জাতিক খাদ্য সংস্থার (ডব্লিউএফপি) বক্তব্য থেকে। গত ১৫ মে ডব্লিউএফপির বাংলাদেশ কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ ক্রিস্টা রাডের বলেছেন, ‘আগামী ১০ মাসে রোহিঙ্গাদের খাবারের জন্য প্রয়োজন ২৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। পুনর্বাসনের বা ভরণপোষণের জন্যে প্রয়োজন ৯৫০ মিলিয়ন ডলার বা সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। এই সময়ের মধ্যে এই পরিমাণ অর্থ যদি আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে না পাওয়া যায়, রোহিঙ্গাদের বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়তে পারে।’

গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রয়োজন ছিল ৪৩৪ মিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের থেকে পাওয়া যায় প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার। যা দিয়ে রোহিঙ্গাদের খাদ্যের যোগান দেয়া সম্ভব হয়। এখন আন্তর্জাতিক সংস্থা বা দেশের থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা পাওয়া না যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

ক্রিস্টা রাডের জানিয়েছেন, ‘প্রয়োজন ২৪৩ মিলিয়ন ডলার, আছে মাত্র ৪৫ মিলিয়ন ডলার। ঘাটতি প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার।’

এরপর আমেরিকা দিয়েছে ৩০ মিলিয়ন ডলার। ইউরোপীয় ইউনিয়নও কিছু অর্থ দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তারপরও প্রায় ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘাটতি থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। ভরণপোষণ বা পুনর্বাসনের ৯৫০ মিলিয়ন ডলারের বিষয়টি আলোচনাতেই নেই।

প্রথম দিকে ২০টি দেশ রোহিঙ্গাদের সহায়তার ক্ষেত্রে আন্তরিক ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই আন্তরিকতা কমে গেছে।

প্রতিদিনের খাদ্য যোগানোর অর্থই আগামী দিনে ডব্লিউএফপি’র তহবিলে থাকবে না বলে ধারণা করছেন কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ ক্লিস্টা রাডের। ভরণপোষণের বিপুল অর্থ পাওয়ারও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এই পরিমাণ অর্থের চাপ বাংলাদেশের পক্ষেও বহন করা সম্ভব নয়। আশ্রয় শিবিরে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিলে রোহিঙ্গারা অশান্ত হয়ে উঠতে পারে। স্থানীয় বাঙালি- রোহিঙ্গা একটা টানাপড়েন এমনিতেই আছে।

 

৪. যে পরিমাণ চাপে পড়লে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার বাধ্য হতো, সেই পরিমাণ চাপে মিয়ানমার পড়বে বলে মনে হয় না। চীন এক্ষেত্রে মিয়ানমারের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ফিরিয়ে নেওয়ার যে আলোচনা চলছে, তা লম্বা সময় ধরে ফলাফলহীনভাবে হয়তো চলতে থাকবে। কোনো রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হবে, সম্ভাবনা খুব কম। ফিরে গেলে আবার মৃত্যুর মুখে পড়তে হবে, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের মনে এই ভীতি টিকিয়ে রেখেই আলোচনা চালিয়ে যাবে। স্বেচ্ছায় না গেলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে পারবে না বাংলাদেশ। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য রাখলেও, জাতিসংঘে কার্যকর কিছু করতে পারবে না, চীন ও রাশিয়ার ভেটো ক্ষমতার কারণে।

বাংলাদেশ সরকারের দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার ভাসান চর প্রকল্পও সফল হবে কিনা, সন্দেহ আছে। রোহিঙ্গাদের যে মনোভাব, তাতে বোঝা যায়- তারা ভাসান চরে যেতে ইচ্ছুক নয়।

প্রিয়াংকা চোপড়ার মতো তারকা রোহিঙ্গার শিবির ঘুরে গেলেন। আন্তর্জাতিক বিশ্ব আরও একবার জানল ভয়াবহ নিপীড়ন-নির্যাতনের কথা। এর প্রেক্ষিতে কিছু অর্থ সহায়তা এবং ‘বাংলাদেশের থেকে শেখার আছে’ জাতীয় প্রশংসা ছাড়া আর কোনো অগ্রগতির সম্ভাবনা ক্ষীণ।

আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিলতায় আটকে, বাংলাদেশ জাতীয় রাজনীতিতে সাফল্য প্রমাণের চেষ্টা করছে, করে যাবে। ‘বাংলাদেশ সারা পৃথিবীর প্রশংসা পেয়েছে’ ‘চীন-রাশিয়া-ভারত, আমেরিকা-ইউরোপ’ আমাদের ‘পাশে আছে’- এসব কথা বাংলাদেশ বললেও বাস্তবতা ভিন্ন। ভোট বা ভেটোর সময় দেখা যায়, চীন-রাশিয়া-জাপানের অবস্থান বাংলাদেশের অনুকূলে থাকে না। একাধিকবার ভেটো প্রয়োগ করে চীন-রাশিয়া তার প্রমাণ দিয়েছে। প্রয়োজনের সময়ে বাংলাদেশের পক্ষে ভোট না দিয়ে ভারত নীরব থাকে। চীনের প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলোও বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দেয় না।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের পক্ষে আলোর দেখা মিলছে না, গভীর সংকট যেন দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

5h ago