আবারও করের টাকা যাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন সংকট উত্তরণে সামনের বাজেটে ফের ২,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার কথা বিবেচনা করছে সরকার। ব্যাংকগুলোতে দুর্নীতি ও ঋণ জালিয়াতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কার্যত ব্যর্থতার পরিচয় দেওয়ার পর এবারও করের টাকা ঢেলে ব্যাংকগুলোকে সংকট থেকে বের করে আনার পথে হাঁটছে সরকার।
চলতি বাজেটেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর জন্য ২০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। বরাদ্দের টাকা ছাড় করা না হলেও গতকাল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ইঙ্গিত দিয়েছেন, আগামী বাজেটেও একই পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখা হতে পারে।
সেই সঙ্গে ধুঁকতে থাকা ব্যাংকিং খাতের জন্য ব্যাংক কমিশন গঠন করারও কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। যদিও প্রায় দুই দশক আগে গঠন করা এধরনের একটি কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোই বাস্তবায়িত হয়নি।
অর্থনীতি বিশেষকরা বলছেন, পূর্বের ব্যাংক সংস্কার কমিটির সুপারিশগুলো সরকার উপেক্ষা না করলে বর্তমান ব্যাংকিং খাতের অবস্থা এতটা শোচনীয় হতো না। ওই কমিটি মোট ১৮৮টি সুপারিশ করেছিল। এর একটি ছিল ব্যাংকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা।
গত কয়েক বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও জনতা ব্যাংকে বড় ধরনের ঋণ জালিয়াতি ধরা পড়েছে। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ঋণের নামে এই ব্যাংকগুলো থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এই অবস্থায় জালিয়াতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান না নিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ব্যাংকগুলোকে মূলধন সরবরাহের সরকারি নীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থমন্ত্রী গত ফেব্রুয়ারি মাসে সংসদে জানান, ২০০৫-০৬ অর্থবছর তেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলকে সরকার মূলধন সহায়তা হিসেবে ১০,২৭২ কোটি টাকা দিয়েছে। এভাবে বছরের পর বছর অর্থ ঢালার পরও গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর মূলধন সংকট দাঁড়ায় প্রায় ২০,০০০ কোটি টাকা। এর এক বছর আগে মূলধন সংকটের পরিমাণ ছিল ১৩,৮১৯ কোটি টাকা।
গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় মুহিত জানান, চলতি মাসেই ব্যাংক মিশন গঠনের ঘোষণা আসবে। তিনি বলেন, টার্মস অব রেফারেন্স হয়ে গেছে। এখন এর সদস্য ঠিক করা হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন ব্যাংকিং ডিভিশনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে গতকাল বলেন, ব্যাংক কমিশন নিয়ে অর্থমন্ত্রীকে ইতিমধ্যে তারা একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। প্রস্তাবে কমিশনের সদস্য সংখ্যা ও তাদের কাজের পরিধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে শিগগিরই তিনি কমিশন গঠন চূড়ান্ত করবেন।
দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে শৃঙ্খলা আনতে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা দীর্ঘদিন ধরেই সরকারের কাছে ব্যাংক কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে আসছেন।
১৯৯৬ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের এরকম একটি কমিটি গঠন করেছিল। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাসে কমিটি তার প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও নতুন বেসরকারি ব্যাংকের জন্য ১৮৮টি সুপারিশ করা হয়েছিল।
এর একটি সুপারিশে ‘ন্যাশনাল ব্যাংকিং এডভাইসরি কাউন্সিল’ গঠন করতে বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এই কাউন্সিলের কাজ হবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য নিয়োগের জন্য প্যানেল তৈরি করা। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো কাউন্সিল গঠিত হয়নি।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দিতে শুরু করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। এর পর একাধিক ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি বের হয়ে গেলেও লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক। একসময়ের লাভজনক এই ব্যাংকটি থেকে ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ৪,৫০০ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। এই সময় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন আব্দুল হাই বাচ্চু। রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পেয়েছিলেন তিনি। বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন ৫৬টি মামলা করলেও এর একটিতেও তাকে অভিযুক্ত করা হয়নি। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের প্রায় সবাই রয়েছেন বহাল তবিয়তে। অনেকেই পেয়েছেন পদোন্নতির পুরস্কার। এসব মামলা তদন্তে গড়িমসি ও অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার না করায় সম্প্রতি হাইকোর্ট দুদকের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এক ব্যক্তির মালিকানাধীন স্বল্প পরিচিত কয়েকটি কোম্পানিকে জনতা ব্যাংক নিয়ম ভঙ্গ করে ৫,৫০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়। এই ঘটনায় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের কাউকেই দোষী করা হয়নি, যদিও তারাই এসব ঋণ অনুমোদন দিয়েছিল।
সোনালী ব্যাংকের ২,৬০০ কোটি টাকা জালিয়াতির জন্য ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে ২০১৩ সালের ৭ অক্টোবর চার্জশিট দিয়েছে দুদক।
এছাড়াও রাজনৈতিক বিবেচনায় বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার কারণে পুরো ব্যাংকিং সেক্টরই সংকটে পড়তে হয়েছে যা ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাবকে নতুন করে সামনে এনেছে।
Comments