প্লাস্টিক যখন একটি বৈশ্বিক ব্যাধি

শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই প্রায় দুই কোটির বেশি পলিব্যাগ শুধুমাত্র একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়া হয়। এসব পলিথিন দূষণ সৃষ্টির পাশাপাশি পানি চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে জলাবদ্ধতা তৈরি করছে। ছবি: রাশেদ সুমন

বাসায় মেহমান আসার সময় শিশুদের জন্য এনেছেন চিপস, চকলেট, জুস, আইসক্রিম। আর বড়দের জন্য স্বচ্ছ প্লাস্টিকের মোড়কে মোড়ানো বিরিয়ানি। খাওয়া শেষে আবর্জনার ঝুড়িতে মোড়ক ফেলতে গিয়ে আঁতকে উঠলাম। প্লাস্টিকের ঝুড়ি প্রতিদিন পরিষ্কারের ঝামেলা এড়াতে প্রতিবার ময়লা ফেলার জন্য পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করি। সহজে বহনযোগ্য আর বাসায় অনেক বেশি পলিথিনের ব্যাগ থাকায় কাজের এই সহজ পন্থা আমিসহ অনেকেই বেছে নেন। এবার বলি, যে কারণে আঁতকে উঠলাম সেই কথা। আমার বাসার ময়লার ঝুড়ির ভেতরের পলিব্যাগ ভর্তি হয়ে গেছে বিভিন্ন মোড়ক ও প্লাস্টিকের নানা মাপের বোতলে। এবার ফেলে দেবার পালা ময়লার ডাস্টবিনে। কিন্তু তারপর এই সব প্লাস্টিকের পণ্য কোথায় যায়, কি হয় ভেবেছি কি?

১৮৪৫ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার পার্কস নাইট্রো-সেলুলোজ, প্লাস্টিসাইজার ও তার সঙ্গে অন্যান্য দ্রাবক পদার্থের মিশ্রণ ঘটিয়ে প্রথম তৈরি করেছিলেন প্লাস্টিক। হালের পলিথিন এই প্লাস্টিকেরই অন্যরূপ। কী তৈরি হচ্ছে না এই প্লাস্টিক দিয়ে? কম্পিউটার, টেলিভিশন, গাড়ির যন্ত্রাংশ, বৈদ্যুতিক সুইচ ও তার, ব্যাগ, পোশাক, বিভিন্ন আসবাব, খেলনা, মোড়ক থেকে শুরু করে দাঁত মাজা, চুল আঁচড়ানো এমনকি খাবার পরিবেশনের অতি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গটিও প্লাস্টিকের তৈরি। শিল্প ও বাণিজ্যের অনেক কাজই প্লাস্টিক ছাড়া কল্পনা করাও এখন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে প্রতিদিনের গৃহস্থালির কাজেও এর ব্যাপক ব্যাবহার থাকবে, এতে আর অবাক হবার কি আছে? কিন্তু ইদানীং জানতে পারছি, শুধু খাবার পরিবেশনেই নয়, স্বয়ং খাবার হয়ে উঠেছে প্লাস্টিক। প্লাস্টিকের চাল, ডিম এরপর নাকি তরল দুধও প্লাস্টিকের অবদান!

কিন্তু কেন শিল্প, বাণিজ্য, পরিবহন, গৃহস্থালি সবক্ষেত্র এত দ্রুত গ্রাস করছে প্লাস্টিক? কারণ সহজ- এর কাঁচামাল দামে সস্তা, টেকসই, তুলনামূলক কম খরচে এটি থেকে যে কোনো আকৃতি দেওয়া যায়, ওজনে হালকা, দেখতে স্বচ্ছ, বিদ্যুৎ, পানি ও কেমিক্যাল বিরোধী হওয়ায় খাবার ও অন্যান্য উপাদান অনেকদিন নিরাপদ ও সংরক্ষিত থাকে। আর তাই মানুষ ঝুঁকছে প্লাস্টিকের দিকে। আর আমরা কমাতে কমাতে প্রায় হারাতে বসেছি মাটি, স্টিল, কাঁসা, সিরামিক, বাঁশ, বেত, পাট ও পাটজাত দ্রব্যের ব্যবহার।

প্লাস্টিক কয়েক শত বছর মাটি বা পানিতে থেকে পচে নষ্ট হয় না, এটি অনবায়নযোগ্য, জলাবদ্ধতা ও মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করার অন্যতম কারণ, জলজ ও সামুদ্রিক পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

প্রতিদিন সারা বিশ্বে যে ৩৬ লাখ টন কঠিন বর্জ্য ফেলে হয়, তার মাঝে প্রায় ১০ শতাংশ এই সর্বনাশা প্লাস্টিক। প্রতি বছর সাগরের কোলে ঠাই নেয় প্রায় এক কোটি টন প্লাস্টিক। এই বিপুল প্রবাহ যদি এখনি ঠেকান যায়, তবুও এটি সমুদ্রে প্রচুর পরিমাণে রয়ে যাবে। গবেষণার ফলাফলে জানা যায়, সাগরের যত প্লাস্টিক বর্জ্য তার ৯০ শতাংশ এশিয়া ও আফ্রিকার ১০টি নদী বয়ে নিয়ে আসে। এশিয়ার ইয়াংসি নদী একাই প্রায় ১৫ লাখ টন বর্জ্য সাগরে বয়ে নিয়ে যায়। বর্তমানে যেভাবে চলছে, ঠিক সেভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ সাগরে মাছের চেয়ে প্লাস্টিকের ওজন বেশি হবে।

বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর প্লাস্টিকের উৎপাদন ২০ লাখ টন থেকে বেড়ে আজ প্রায় ৩৮ কোটি টনে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় তিনগুণ বেশি হারে বেড়েছে প্লাস্টিক উৎপাদন। হতাশার কথা হচ্ছে, ১৯৫০ সালের পর থেকে উৎপাদিত ৬৩০ কোটি টন প্লাস্টিকের মাত্র প্রায় নয় শতাংশ পুনরায় ব্যবহার করা হয়েছে এবং আরও প্রায় ১২ শতাংশ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। বাকি প্লাস্টিকের ঠাই হয়েছে খোলা জায়গায়, নয়তো বড় বড় গর্ত খুঁড়ে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে।

এসব ভয়াবহতা জেনেই বাংলাদেশ সরকার ২০০২ সালে আইন করে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। কিন্তু সেই আইনের ১৬ বছরেও সফল প্রয়োগ নেই। ফলে সারা দেশে হাজারের বেশি কারখানায় নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরি হচ্ছে। শুধুমাত্র ঢাকা শহরে একটি পরিবার দিনে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে বলে জরিপে তথ্য আছে। অর্থাৎ শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই প্রায় দুই কোটির বেশি পলিব্যাগ শুধুমাত্র একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়া হয়। শুধুই কি পলিথিন? পলিথিনের ছদ্মবেশ ধারণ করা টিস্যু ব্যাগ বা চায়না টিস্যু, যাকে ব্যবসায়ীরা কাপড়ের ব্যাগ বলে প্রচার চালাচ্ছেন সেটিরও প্রতিদিনের উৎপাদন ৩৫ লাখের বেশি। এই ব্যাগ ৩০০ বছর মাটিতে থেকেও মেশে না। কাজেই এর ভয়াবহতা পলিথিনের মতই। ফেলে দেওয়া সব ধরনের পলিথিনে ড্রেন, ডোবা, নালা, খাল ইত্যাদি ভরাট হয়ে পানির স্বাভাবিক গতিপথ বাধাগ্রস্ত করছে আর তার ফলাফল সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা।

আফ্রিকার দেশ কেনিয়ায় কেউ প্লাস্টিকের ব্যাগ বিক্রি করলে তার চার বছর কারাদণ্ড ও ৪০ হাজার ডলার পর্যন্ত জরিমানা হতে পার। কেনিয়া কঠোরভাবে এই আইন মেনে চলে। আমাদের দেশেও যদি উৎপাদক ও বাজারজাতকারীদের এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হতো, তাহলে হয়ত এর উৎপাদন, বিক্রি, ব্যবহার সব কমে যেত। আর সেই সাথে সচেতনতা খুব বেশি জরুর। বিকল্প হিসেবে পাট ও পাটের তৈরি চট, কাগজের তৈরি ব্যাগ ও ঠোঙ্গা, কাপড়ের বিভিন্ন দেশীয় ও পরিবেশ বান্ধব উপকরণের ব্যবহার বাড়বে আর এসবের সঙ্গে যুক্ত সব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কর্মসংস্থান হবে আর সেই সাথে প্রাণ ফিরে পাবে দেশীয় ঐতিহ্য।

আমরা স্বপ্ন দেখি, প্রতিটি মানুষের হাতে চট, কাপড় ও রঙিন কাগজের তৈরি ব্যাগ, ঠোঙ্গা। ব্যাগ বা ঠোঙ্গার কাগজ মুড়িয়ে, ভাঁজ দিয়ে শিশুরা বানিয়ে ফেলছে রঙিন প্লেন। বিভিন্ন রঙের প্লেন উড়িয়ে দিচ্ছে আকাশে, যে প্লেন পরিবেশবান্ধব বাসযোগ্য পৃথিবীর হাতছানি। স্বপ্ন দেখতে তো আর বাধা নেই...!

Comments

The Daily Star  | English

7 colleges to continue operating under UGC until new university formed

Prof AKM Elias, principal of Dhaka College, to be appointed as the administrator

7h ago