বিশ্বকাপে ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি: খুঁটিনাটি যত তথ্য
২০১০ বিশ্বকাপে ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের গোল বিতর্কে শুরু গোল লাইন টেকনলোজির। তবে তাতেই ফুটবল ম্যাচের সব বিতর্ক শেষ হয়নি। কখনো গোলের আগে করা ফাউল এড়িয়ে গেছে রেফারিদের চোখ। ভুল পেনাল্টি দেওয়া, না দেওয়া নিয়ে তো বিতর্ক অহরহ। এবার বিশ্বকাপে এমন সব বিতর্ককে মাটিচাপা দিতে প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত হতে যাচ্ছে ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি (ভিএআর)।
ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি কী:
মূল রেফারি, দুইজন সহকারী রেফারি আর একজন ম্যাচ অফিশিয়াল- সাধারণত এই চারজন মিলেই একটি ফুটবল ম্যাচ পরিচালনা করতেন। ফুটবল মাঠে ভুলের মাত্রা আরও কমিয়ে আনতে তাতে যুক্ত হচ্ছেন প্রযুক্তিনির্ভর ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারিরা। এটি মূলত তিন সদস্যের একটি দল, যারা ভিডিও রিপ্লে দেখে মাঠের রেফারির কোন সিদ্ধান্ত ভুল মনে হলে সেটিকে সংশোধন করার জন্য একত্রে কাজ করবেন।
তিন সদস্যের এই দলে থাকবেন একজন প্রধান ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি (যাকে কি না অবশ্যই একজন বর্তমান কিংবা সাবেক রেফারি হতে হবে), একজন সহকারী ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি এবং একজন রিপ্লে অপারেটর। ভিডিও অপারেশন রুমে বসে ভিন্ন ভিন্ন অ্যাঙ্গেলে বসানো একাধিক ক্যামেরার সহায়তায় তারা পুরো ম্যাচের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন।
যেভাবে কাজ করবে ভিএআর:
মূলত চার ধরনের সিদ্ধান্তের জন্য ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির সহায়তা নিতে পারবেন মূল রেফারি- গোল কিংবা গোলের বিল্ড আপে কোন ধরনের অবৈধ ফাউল, পেনাল্টির সিদ্ধান্ত, লাল কার্ড এবং মিসটেকেন আইডেন্টিটি বা ভুল করে নির্দোষ খেলোয়াড়কে কার্ড দেখিয়ে দেয়া।
রেফারির কোন সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার বিষয়টি দুই ধাপে সম্পন্ন হতে পারবে। নিজের কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্দেহ থাকলে রেফারি নিজেই ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির দ্বারস্থ হতে পারেন, আবার মাঠের রেফারির কোন সিদ্ধান্ত ভুল মনে হলে কিংবা মাঠের কোন ঘটনা মূল রেফারির চোখ এড়িয়ে গেলে ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি সে ব্যাপারে মাঠের রেফারির সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
ধরা যাক, ডি বক্সের ভেতরে ডিফেন্ডারের হাতে বল লেগেছে কি না সে ব্যাপারে মূল রেফারি নিশ্চিত নন। সেক্ষেত্রে তিনি নিজে থেকে ভিএআরের সাহায্য চাইতে পারেন। আবার মাঠের কোন এক কোণায় এমন একটি ফাউল হলো যা রেফারির চোখ এড়িয়ে গেছে, অথচ সেটি শাস্তিযোগ্য ফাউল। সেক্ষেত্রে ভিএআর নিজে মাঠের রেফারিকে সে ব্যাপারে অবগত করতে পারবেন। কোন গোলের আগে এমন গুরুতর ফাউল রেফারির চোখ এড়িয়ে গেলেও ভিএআরের সহায়তা নিয়ে গোল বাতিল করবেন রেফারি। গোলের বিল্ড আপের সময়ও আইনবিরুদ্ধ কিছু হলে পরে হওয়া গোল বাতিল হয়ে যাবে। তেমনি করে বদলে যেতে পারে কোন খেলোয়াড়কে ভুল করে দেওয়া কার্ডের সিদ্ধান্ত।
তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাটা কিন্তু মাঠের রেফারির হাতেই থাকছে। তাঁর হাতে বিকল্প থাকবে তিনটি- হয় তিনি ভিএআরের কথা শুনে সাথে সাথে নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলতে পারবেন, নাহয় টাচলাইনের বাইরে রাখা মনিটরে নিজেই আরেকবার ঘটনাটার রিপ্লে দেখে নিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন, আর নাহয় ভিএআরের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে নিজের সিদ্ধান্তেই অটল থাকতে পারবেন।
ভিএআরের ইতিহাস ও বর্তমান ব্যবহার:
ফুটবলে ভিএআর ব্যবহারের প্রথম নজির ২০১৬ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ সকারের ম্যাচে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভিএআরের প্রথম ব্যবহার ২০১৭ সালের নভেম্বরে ইংল্যান্ড ও জার্মানির মধ্যকার এক প্রীতি ম্যাচে। ব্রাইটন ও ক্রিস্টাল প্যালেসের মধ্যকার এফএ কাপের ম্যাচেও ব্যবহার করা হয়েছে এই প্রযুক্তি।
ফিফা আয়োজিত বড় টুর্নামেন্টেও এরই মধ্যে ব্যবহার হয়েছে ভিএআর। গত বছর অনূর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপ ও কনফেডারেশন্স কাপে ব্যবহার করা হয়েছে নতুন এই প্রযুক্তি। ২০১৭-১৮ মৌসুম থেকে জার্মানি, ইতালি ও পর্তুগীজ লিগেও চালু করা হয়েছে ভিএআর।
ভিএআরের সমালোচনা:
ভিএআরকে স্বাগত জানালেও এর বিরুদ্ধে সমালোচনাও কিন্তু একেবারে কম নেই। ভিএআর ব্যবহারে সবচেয়ে বড় আপত্তির জায়গা সেটি হলো, বারবার খেলার মাঝে বিরতি পড়ায় ফুটবলের যে স্বাভাবিক ছন্দ, সেটি ব্যাহত হবে। বিরতির পর আবার নতুন করে ছন্দ ফিরে পেতে হিমশিম খেতে হতে পারে কোন দলকে, আর সেটির সুবিধা তুলতে পারে প্রতিপক্ষ দল।
আরেকটি সমালোচনা হলো, ভিএআর ব্যবহারের সময় দর্শকেরা সম্পূর্ণ ধোঁয়াশার মধ্যে থাকেন। রেফারির সাথে ভিএআরের কী কথা হচ্ছে, কোন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হলে সেটি কেন করা হলো, এসব বিষয়ে অজ্ঞাতই থেকে যাচ্ছেন দর্শকেরা। তবে ফিফা বলছে, দর্শকদের এ বিষয়ে আরও বেশি অবগত করার ব্যাপারে কাজ করে চলেছে তারা।
ভিএআরের একটি দুর্বলতা হলো, গোললাইন টেকনোলজির মতো এটি সম্পূর্ণ প্রযুক্তি নির্ভর নয়, বরং এটিও অনেকাংশেই মানুষের সিদ্ধান্তের উপরেই নির্ভর করে। পেনাল্টি কিংবা অফসাইডের মতো বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলোর ক্ষেত্রে তাই ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা হলেও থেকেই যায়।
Comments