পাহাড়ধস, মানব সৃষ্ট বিপর্যয়

দেশের সমতল অঞ্চলের মানুষের জীবনের যতটুকু মূল্য পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের জীবন তার চেয়ে ঢের সস্তা।
বছরের পর বছর ধরে গাছ কেটে পাহাড় ন্যাড়া করে ফেলা হয়েছে। গাছ না থাকায় মাটির কাঠামো দুর্বল হয়েছে। ফলে বৃষ্টি হলেই নামছে ধস। স্টার ফাইল ছবি

বাংলাদেশে যে বস্তুটি সবচেয়ে সস্তা তা সম্ভবত জীবন। সুনির্দিষ্টভাবে বললে ‘মানুষের জীবন’। ধনী গরিবের আকাশ পাতাল অর্থনৈতিক বৈষম্যের মতো সস্তা জীবনের মূল্যেও রয়েছে বৈষম্য। দেশের সমতল অঞ্চলের মানুষের জীবনের যতটুকু মূল্য পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের জীবন তার চেয়ে ঢের সস্তা। জীবনের দাম নিয়ে সর্বশেষ বড় দুঃসংবাদটি এসেছে পাহাড় থেকেই। রাঙ্গামাটিতে গতকাল সকালে পাহাড় ধসে অন্তত ১১ জন নিহত হয়েছেন। পাহাড়ের কাদামাটি মৃত্যু হয়ে মানুষগুলোর ওপর এসে পড়েছিল তখন তাদের অনেকেই ঘুমিয়ে ছিলেন। তাদের ঘুম চিরস্থায়ী হয়েছে।

বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ থেকে গত কয়েকদিন ধরেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় টানা বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর। এই সময়টায় বৃষ্টির সঙ্গে পাহাড়ধস হতে পারে সেটাও বলা হয়েছিল। কিন্তু পূর্বাভাস পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল সরকারি তৎপরতা। অনেক জায়গায় পাহাড়ের ঢাল থেকে লোকজনকে সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করে দায় সারা হয়েছে।

জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষদিকে বৃষ্টি শুরু হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু বৃষ্টি হলে পাহাড়ধস হবে এটা কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়; মানুষের প্রাণহানি তো নয়ই। এটি দুর্ঘটনা নয়, সরকারের গাফিলতিতে হওয়া মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। কোনোভাবেই এর জন্য বৃষ্টি বা পাহাড়ের ওপর দায় চাপানোর সুযোগ নেই। বছরের পর বছর ধরে নির্বিচারে গাছ কেটে পাহাড় ন্যাড়া করে ফেলা হয়েছে। শুধু কি গাছ, পাহাড় কেটে সমতল বানানো হয়েছে। গাছ না থাকায় মাটির কাঠামো দুর্বল হয়েছে। ফলে বৃষ্টি হলেই নামছে ধস।

পাহাড়ধস মানবসৃষ্ট ঘটনা হলে প্রথমেই প্রশ্ন আসে এর দায় কার?

পাহাড়ে শত শত বছর ধরে বসবাস করা পাহাড়িরা নয়,  দায়ী মূলত সমতল থেকে নিয়ে যাওয়া বাঙালিরা। পাহাড়িরা জানে কিভাবে প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস করতে হয়। জুম চাষের জন্য তারা আগুন দিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করলেও, পাহাড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় না। পাহাড় কেটে সমতল ভূমি তৈরি করে না। তাদের ঘরবাড়ি তৈরি করার প্রক্রিয়াও বাঙালিদের থেকে ভিন্ন। বাঁশসহ নানা প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে তারা পাহাড়ের ঢালে ঘর তৈরি করে। খেয়াল রাখে যেন ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। প্রকৃতিকে ভালোবাসায় প্রকৃতিও তাদের ওপর বিরূপ হয়নি তখন পর্যন্ত।

১৯৬২ সালে রাঙ্গামাটির কাপ্তাইয়ে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়। এই বাঁধের ফলে যে কৃত্রিম হ্রদ তৈরি হয় তাতে তলিয়ে যায় হাজার হাজার একর জমি ও বাসভূমি। ফলে বাধ্য হয়ে ওই এলাকার অধিবাসীরা ভিটেমাটি হারিয়ে পাহাড়ের ঢালের দিকে আশ্রয় নেয়। অনেকেই থাকতে না পেরে চলে যায় ভারতে। ১৯৮০ সালের দিকে অবস্থা আবার পাল্টাতে শুরু করে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সেসময় সমতলের ভূমিহীন বাঙালিদের পার্বত্য এলাকায় পুনর্বাসন শুরু করা হয়। কিন্তু পাহাড়ের জীবনের সঙ্গে অপরিচিত বাঙালি বন উজাড়ের পাশাপাশি পাহাড় কেটে সমতল ভূমি তৈরি করতে শুরু করে। মূলত ঘরবাড়ি তৈরি ও কৃষি জমি তৈরির জন্য পাহাড় কাটতে থাকে তারা। পাহাড়ের সঙ্গে কিভাবে খাপ খাইয়ে চলতে হবে সে সম্পর্কে তাদের কোনোদিন ধারণাই গড়ে ওঠেনি। সরকারিভাবেও তাদের কোনো প্রশিক্ষণ বা সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করা হয়নি।

এক বছর আগে ঠিক একই দিনে চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ পার্বত তিন জেলায় ভয়াবহ পাহাড়ধস হয়েছিল। সেদিন নিহত হয় দেড় শতাধিক মানুষ। আহতের সংখ্যা কত ছিল তা কেবল অনুমান করা যায়। কারণ নিহতের সংখ্যা নিয়ে যেখানে একেক গণমাধ্যমে একেক রকম তথ্য এসেছে সেখানে আহতের খবর আর রাখে কে? কোথাও নিহতের সংখ্যা বলা হয়েছে ১৫২, আবার কেউ লিখেছে প্রায় ১৭০। অন্তত দেড় শতাধিক প্রাণ মাটিচাপায় নিভে গিয়েছিল সেদিন সেটি নিশ্চিত। এর মধ্যে শুধুমাত্র রাঙ্গামাটি থেকেই প্রায় ১২০ জনের মৃত্যুর খবর এসেছিল।

গতবছর সে সময়টায় বঙ্গোপসাগরে একটি নিম্নচাপ ছিল। দিনরাত টানা বৃষ্টি চলে। এর পরই মৃত্যু হয়ে ধসে পড়ে পাহাড়। কিন্তু সেটা কি কোনো আকস্মিক দুর্যোগ ছিল? পাহাড়ে ধস নামতে পারে এরকম খবর গণমাধ্যমে আগে থেকেই প্রকাশিত হচ্ছিল। ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে ১২৭ জন নিহত হওয়ার পর একটি সরকারি কমিটি ৩৬ দফা সুপারিশ করে। পাহাড় ধসে প্রাণহানি বন্ধ করতে গত বছর আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে সরকারের কাছে ১২ দফা সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। ওই প্রতিবেদনে, ধস ঠেকাতে পাহাড় ও টিলা সংরক্ষণে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ কঠোরভাবে প্রতিপালন, পাহাড়ি এলাকায় ভূমিক্ষয় রোধে বনায়ন, পাহাড় সংরক্ষণ টেকসই কৃষির প্রবর্তন, পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, ম্যাপিং, জোনিংসহ পাহাড়ি এলাকার বিস্তারিত তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলা, পাহাড় সংরক্ষণ, পাহাড়ি এলাকার ব্যবহার সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, টেকসই পাহাড় ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়েছিল। গতকাল ১১ জন মারে গিয়ে প্রমাণ করেছেন এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হওয়া সুদূর পরাহত।

প্রত্যেকবার পাহাড় ধসে প্রাণহানির পরই কমিটি গঠন করে সরকার। কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়ে দায় সারে। আর যাদের ওপর সবচেয়ে বেশি দায় বর্তায় তারা প্রতিবছর বর্ষা এলেই পাহাড়ধস রোধে বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করাসহ উচ্ছেদের মতো অস্থায়ী কিছু ব্যবস্থা নেয়। শেষ মুহূর্তে পাহাড়ের ঢাল থেকে লোকজন সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করে তারাও দায় সারে। কিন্তু প্রতি বছর পাহাড় ধসের পর দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশমালা আরও দীর্ঘ হলেও বাস্তবায়ন হয় না।

প্রতিবার পাহাড়ধসের পর সরকারের নেতা মন্ত্রীদের আরেকটি মনোভাব দেখা যায়। গণমাধ্যমের সামনে তারা বলতে থাকেন, পাহাড়ের ঢাল থেকে লোকজনকে সরে যেতে বলা হলেও তারা সরে না। ফলে প্রাণহানি হয়। সেই সঙ্গে দায় চাপান প্রকৃতির ওপর। কিন্তু গরিব লোকগুলো পাহাড় ছেড়ে কোথায় যাবে তার কোনো দিশা দেখান না তারা। এ যেন নিহতের কাঁধেই তার নিজের মৃত্যুর দায় চাপানোর মতো পরিহাস।

মানুষ কি সখ করে পাহাড়ের ঢালে ঘর তৈরি করে? সহায় সম্বলহীন মানুষগুলো আর কোনো জায়গা না পেয়ে আশু বিপদ জেনেই ঝুঁকি নিতে বাধ্য হয়। তাদের কেউ কেউ হয়ত ভাবতে পারেন, অন্যদের বিপদ হলেও তারা হয়ত বেঁচে যাবেন। সেটা আলাদা কথা। কিন্তু মানুষের জানমাল রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যারা সরকারে আসেন তারা কি অন্যের ঘাড়ে বা প্রকৃতির ওপর দায় চাপিয়ে পার পেতে পারেন?

আরেকটি প্রশ্ন হলো পাহাড়ে বসবাসকারী লোকজনই কি শুধু পাহাড় কাটে, গাছ কাটে; আর সরকার তাদের নিরস্ত করার চেষ্টা করে? বাস্তবতা হলো পাহাড়িদের চেয়েও ব্যাপক মাত্রায় পাহাড় ধ্বংস করে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা। এক্ষেত্রে সামনের দিকে রয়েছে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী। ব্যারাক, বিনোদন কেন্দ্র তৈরিসহ নানা অজুহাতে তারা পাহাড় কাটে, গাছ কাটে। পাহাড় কেটে সার্কিট হাউজ, রেস্ট হাউজ বানায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। সমস্ত সরকারি সংস্থারও যেন পাহাড়ের চূড়ায় রেস্টহাউজ থাকা চাইই চাই। গাছের চোরাকারবারিদের সঙ্গেও তাদের দহরম মহরম।

পাহাড় ধসে গতকাল ১১ জন নিহত হয়েছেন। এই সংখ্যা যে এখানেই থেমে থাকবে না তা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। জীবিত মানুষ মরে গিয়ে সংখ্যায় পরিণত হবে। বিপর্যয় বাড়তে বাড়তে মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিবে। ততদিন পর্যন্ত কি দায়িত্বপ্রাপ্তরা চেয়ে চেয়ে দেখবেন?

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

5h ago