টাকা-ফ্ল্যাটের সঙ্গে গরু-ভেড়ার বিধানও চালু হোক

লাশ কাটা ঘরে নয়, মহাখালী ফ্লাইওভারের উপর থেতলে যাওয়া দেহ পড়ে ছিল সেলিম ব্যাপারীর। তখন কন্যা তার বাবার, স্ত্রী তার স্বামীর অপেক্ষায় ছিলেন। যে সেলিম ব্যাপারীকে গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যা করেছে, সে তখন বলছিল ‘এটা আমার এলাকা, কে কে আসবি, আয়’। আরও বলেছিল ‘কত টাকা চাও, দেব। অফ যাও...।’

তিন দিন আগে যখন বিষয়টি নিয়ে লিখেছিলাম, তখনই জানছিলাম নেপথ্যে অর্থ ফর্মূলা নিয়ে দর কষাকষি চলছে। খুব যে গোপনে চলছিল, তা নয়।

পাঁচ দিনের মাথায় আনুষ্ঠানিক আলোচনার মধ্য দিয়ে সেলিম ব্যাপারী হত্যাকাণ্ড বিষয়টির সমাধান হলো। সেলিম ব্যাপারীর স্ত্রীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হলো ২০ লাখ টাকা। প্রতি মাসে তাকে দেওয়া হবে ২০ হাজার টাকা। পরিবারের অন্য যেকোনো প্রয়োজনে পাশে থাকবেন এমপি একরামুল করিম চৌধুরী।

এই তথ্য সবাই জানি যে, এমপি একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে শাবাব চৌধুরীর গাড়ি চাপা পড়েই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন সেলিম ব্যাপারী।

একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে দিশেহারা পরিবার, বিচারের প্রত্যাশা বাদ দিয়ে, ২০ লাখ টাকা গ্রহণ করেছেন।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নতুন একটা দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যে, প্রভাবশালী বিত্তবানরা আপনাকে গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যা করলে, আপনার পরিবার পাবে ২০ লাখ টাকা। পিস্তল দিয়ে গুলি করে হত্যা করলে আপনার পরিবার পাবে একটি ফ্ল্যাট।

বিনময়ে আপনার পরিবার মামলা করবে না বা অভিযোগ তুলে নিবে।

যাদের মামলা- তদন্ত করার কথা, তারা আপস প্রক্রিয়ায় সর্বোতভাবে আপনার পরিবারকে সহায়তা করবেন। আপনার অসহায় পরিবারকে তারা বোঝাবেন-

ক. যিনি চলে গেছেন, তিনি তো আর ফিরে আসবেন না।

খ. তাছাড়া উনারা খুব প্রভাবশালী, অনেক টাকার মালিক। আপনাকে বা আপনার সন্তানেরও ক্ষতি করতে পারেন। আমরা রক্ষা করতে পারব না।

গ. মামলা করে তাদের সঙ্গে পারবেন না। মামলা চালানোর জন্যে অনেক টাকা লাগবে। টাকা কোথায় পাবেন।

ঘ. তারচেয়ে ২০ লাখ টাকা বা একটি ফ্ল্যাট নিয়ে সন্তানদের নিয়ে ভালো থাকেন।

 

এই অকাট্ট যুক্তি খণ্ডন করার সাধ্য আপনার পরিবারের থাকবে না। সেলিম ব্যাপারীর পরিবারেরও ছিল না।

আজকের তিনটি পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত করছি-

‘সাংসদের স্ত্রীর গাড়ির চাপায় পথচারী নিহত: ২০ লাখ টাকায় সমঝোতা, এখননো ‘তদন্ত’ চলছেই’। (প্রথম আলো, ২৫ জুন)

‘এমপির স্ত্রীর গাড়ির ধাক্কায় চালক নিহত, ২০ লাখ টাকায় মামলা রফা’। (সমকাল, ২৫ জুন)

‘এমপি পুত্রের গাড়ির চাপায় মৃত্যু ‘২০ লাখ টাকায় আপোস রফা’’। (ইত্তেফাক, ২৫ জুন)

২.

‘ব্লাড মানি’ বলে একটি কথা আছে সৌদি আরবের আইনে। কেউ কাউকে হত্যা করলে বিচারে মৃত্যুদণ্ড অবধারিত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি রক্ষা পেতে পারেন, যদি হত্যার শিকার পরিবার ক্ষমা করে দেন। এই ক্ষমার ঘটনা  ঘটে বড় অংকের অর্থের বিনিময়ে। সবাই যে অর্থের বিনিময়ে রাজি হন, তা নয়। তবে এই বিধানটি সৌদি আইনে আছে।

এখনও কিছু আফ্রিকান আদিবাসী সমাজে হত্যার পরিবর্তে প্রাণী দিয়ে মীমাংসার বিধান চালু আছে। হত্যাকারী যদি বড়লোক হয়, তবে ৫০০ থেকে ৮০০ গরু দিতে হয়। গরিব হলে ২০০ থেকে ৪০০ ভেড়া দিয়েও, হত্যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এই পরিমাণ গরু বা ভেড়া অধিকাংশের পক্ষে দেওয়া প্রায় অসম্ভব। হত্যার শাস্তি থেকে বাঁচার জন্যে, অসম্ভবকে সম্ভব করতে হয়। তা না হলে বাঁচতে পারেন না।

সৌদি আরব বা আফ্রিকান আদিবাসীদের বিধান বা আইন সভ্য পৃথিবী গ্রহণ করে না। তারপরও এসব সমাজে হত্যার বিচার- শাস্তি হয়। শাস্তি অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার আগে অর্থ বা গরু- ভেড়া দিয়ে জীবন বাঁচানোর সুযোগ পাওয়া যায়। হত্যার পর বিচার- শাস্তির আগে, আপস করে ফেলা যায় না।

৩.

ফিরে আসি সভ্য পৃথিবীর আধুনিক বাংলাদেশে। গাড়ি চাপায় হত্যার শিকার সেলিম ব্যাপারীর স্ত্রী- কন্যা কী, হত্যার দায়ে অভিযুক্তদের সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে আপস করে ফেলতে পারেন? যেহেতু স্বামী বা বাবা হত্যার বিচার তারা যাতে না চান সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেহেতু তারা বিচার চাইছেন না। এটা তারা করতে পারেন কি না? এক্ষেত্রে মামলা করা বা পরিচালনা কি সেলিম ব্যাপারীর স্ত্রীর এখতিয়ার? রাষ্ট্রের এক্ষেত্রে কিছু করার নেই?

বিষয়টি নিয়ে কথা বলছিলাম সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জোতির্ময় বড়ুয়ার সঙ্গে।

মি. বড়ুয়া বললেন, ‘বাংলাদেশের ফৌজদারি আইনানুযায়ী, হত্যা মামলা নিজেরা নিজেরা আপস করে ফেলা যায় না। হত্যার শিকার পরিবারের কোনো সদস্য ইচ্ছে করলেই হত্যাকারী হিসেবে অভিযুক্তদের সঙ্গে আপস করে ফেলতে পারেন না। রাষ্ট্রের আইন কোনো ব্যক্তিকে সেই ক্ষমতা দেয়নি। হত্যার শিকার হওয়া পরিবার মামলা চালাবেন কি না সেটাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ  আইনে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, কোন অপরাধ আপসযোগ্য আর কোনটি নয়। আপস করা যায় না এমন অপরাধের মামলা চালানোর দায়িত্ব সরকারের। মনে রাখতে হবে, ফৌজদারি মামলা ব্যক্তি দায়ের করলেও তা লেখা হয় এভাবে- “রাষ্ট্র বনাম অমুক”। রাষ্ট্রের পক্ষে অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্যেই জনগণের অর্থ দিয়ে পিপি নিয়োগ দিয়ে রাখা হয়। হত্যা মামলা আপস করার কোনো সুযোগ নেই। আইন এই আপস অনুমোদন করে না।’

এটা বাংলাদেশ যে আইনে চলে, সেই আইনের ব্যাখ্যা। এই আইন তৈরি করেছেন সংসদ সদস্যরা। নিজেদের তৈরি করা আইনানুযায়ী যা করা যায় না, তা করছেন সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী। ভারতে হরিণ হত্যার অপরাধে সালমান খানের জেল খাটতে হয়। হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য যে সালমান খানকে কেন্দ্র করে, ভারতের প্রায় সকল প্রভাবশালীদের সঙ্গে যার হৃদ্যতা, সেই বলিউড তারকা একটি হরিণ মেরে রক্ষা পান না। আর মানুষ মেরে ২০ লাখ টাকা বা একটি ফ্ল্যাটের বিনিময়ে রক্ষা পাওয়া যায় বাংলাদেশে।

সংবিধানে ন্যায়বিচার পাওয়া নাগরিকের অধিকার, তা লেখা আছে। হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধের তদন্ত- বিচার- শাস্তির বিধান, কাগজে লেখা আছে। সেখান থেকে যারা কারণে- অকারণে তা উদ্ধৃত করেন, তাদের নীরব সম্মতিতে বা সক্রিয় অংশগ্রহণে হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধের মামলা অর্থের বিনিময়ে, ফ্ল্যাটের বিনিময়ে আপস হওয়ার নজির তৈরি হচ্ছে সভ্য বাংলাদেশে।

৪.

বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে এখনো কিছু নিপীড়নের ঘটনা, গ্রাম্য শালিসি প্রক্রিয়ায় বিচার বা সমাধান করা হয়। যেমন-

ধর্ষণের শিকার মেয়ের বাবাকে হয়ত পাঁচ মণ ধান দেওয়া হয়। কখনও কখনও ৫-১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। সেলিম ব্যাপারী হত্যার আপস ফর্মুলা আর গ্রামের ধান ফর্মুলায় কী কোনো পার্থক্য আছে? নেই। পার্থক্য শুধু টাকার অংকে।

এই আপস ফর্মুলা অনুযায়ী বিত্তবান বা তাদের সন্তানরা (সবাই নয়) এমন ভেবে নিতেই পারেন যে, গাড়ি চাপা দিয়ে কাউকে হত্যা করলে ২০ লাখ টাকা দিয়ে পরিবার তাকে রক্ষা করবে।

স্বামী তার স্ত্রীকে হত্যা করে, শাশুড়িকে ২০ লাখ টাকা দিয়ে আপস করে ফেলবেন। ভাবতেই পারেন, এমনটা কী আর হবে?

সব তথ্য সামনে থাকার পরও যে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী পাঁচ দিন চুপ করে থাকে। চাপা দেওয়া চালককে গ্রেপ্তার তো দূরের কথা, চাপা দেওয়া গাড়ি পর্যন্ত জব্দ করে না। সেই দেশে ক্ষমতাবানদের জন্যে অসম্ভব বলে কিছু নেই। তা সেলিম ব্যাপারী হত্যার মধ্য দিয়ে আরও একবার প্রমাণ হলো।

৫.

আইনে যা আছে, প্রয়োগে তার উল্টাটা দৃশ্যমান। তাহলে তো টাকা- ফ্ল্যাটের আপোস ফর্মুলার আইন বা বিধানই করে ফেলা যায়। শুধু এখানেই বা সীমাবদ্ধ থাকব কেন, আফ্রিকান আদিবাসীদের মতো বাংলাদেশেও ৮০০ গরু বা ৪০০ ভেড়ার বিধান চালুর বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে। পাঁচ মণ ধানের যে ফর্মুলা গ্রামের কোথাও কোথাও প্রয়োগ হয়, তারও একটা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেওয়ার কথা ভাবা যায়।

হত্যাকাণ্ড ঘটবে, আপস প্রক্রিয়া চলবে। পুলিশ অভিযুক্তদের ‘হয়রানি’ করতে পারবে না। ‘আইনে নেই’- তখন আর একথা বলার সুযোগ থাকবে না। শুধু একটি নির্দিষ্ট এলাকা নয়, পুরো দেশটাই তো তাদের। তাদের বিনোদনের জন্যে এমন একটা বিধান করা যেতেই পারে।

Comments

The Daily Star  | English

JnU students vow to stay on streets until demands met

Jagannath University (JnU) students tonight declared that they would not leave the streets until their three-point demand is fulfilled

18m ago