উর্বর মাটি ‘লুট’ হয়ে যাচ্ছে
সুস্থ-সুন্দরভাবে পরবর্তী প্রজন্মের বেড়ে ওঠার জন্য যে নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশ দরকার দেশে তা এখন হুমকির মুখে। এর মধ্যে আবার কিছু এলাকায় নতুন এক প্রকার ‘ডাকাত’-এর উপদ্রব শুরু হয়েছে। তাদের দৌরাত্ম্যে ধ্বংস হতে বসেছে আমাদের গ্রামীণ জলাশয়-মাটি-প্রকৃতি।
সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া এলাকায় কৃষিজমির ওপরের অংশের উর্বর মাটি ‘লুট’ হয়ে যাচ্ছে। এই মাটি চলে যাচ্ছে ইটভাটায়। প্রকৃতি ধ্বংস করার মহোৎসবের এক ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে সেখানে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, উর্বর ফসলি জমি থেকে ওপরের কয়েক ফুট মাটি কেটে নিচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। এই মাটি তারা বিক্রি করে দিচ্ছে ইটভাটায়। সম্ভবত স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের সহযোগিতায় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে নিয়ে সংঘবদ্ধ অপরাধীরা এটা করে চলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন ইটভাটার মালিকরাও।
যে জায়গায় একসময় সবুজ মাঠে হাওয়ায় দোল খেত দিগন্ত বিস্তৃত ধানখেত, এখন ওই এলাকার যে ছবি ছাপানো হয়েছে তা দেখে স্যাটেলাইট থেকে তোলা চাঁদ বা মঙ্গলগ্রহ বলে মনে হতে পারে।
জমির ওপরের স্তর, পাহাড়, জলাভূমি থেকে মাটি কাটা এমনকি কৃষিজমির আশপাশে ইটভাটা তৈরি করাও বেআইনি। এই অবস্থায় যে প্রশ্নটি আমাদের তুলতেই হচ্ছে তা হলো, পরবর্তী প্রজন্মের কাছ থেকে আমরা আর কী কী কেড়ে নেব?
আমি মনে করি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছ থেকে আমরা যেটি প্রথমে কেড়ে নিয়েছি তা হলো পানি। কোনো ধরনের সুপরিকল্পনা ছাড়াই বেপরোয়া ও অব্যাহতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে দেশের ৬২টি উপজেলায় পানির স্তর সাত মিটার নিচে নেমে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে এর স্তর আরও নিচে নেমে যাওয়ায় ১১ মিটারের কমে পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
অনেক জেলায় অগভীর নলকূপে আর পানি উঠছে না। এ কারণে কৃষিজমিতে সেচের জন্য গভীর নলকূপের দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে। জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে, শেরপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল, নাটোর, কুষ্টিয়া, পাবনা, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, ঢাকা, নরসিংদী, সিরাজগঞ্জ, কুমিল্লা, কক্সবাজার ও এর আশপাশের অঞ্চল।
এখানে উল্লেখ্য, এভাবে পানি উত্তোলন সহনীয় মাত্রার বাইরে চলে যাওয়ার পর ভূগর্ভের পানিতে আর্সেনিক দূষণ ধরা পড়েছে।
এটা ঠিক যে এর সবকিছুই করা হয়েছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য। কিন্তু একইভাবে আমরা পানীয় জলেরও সংকট তৈরি করেছি। ফলে আজ আমরা যে সাফল্য নিয়ে গর্ব করছি, সেটি টেকসই না হওয়ায় নতুন ধরনের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
পানির পর আমরা বাতাসকে দূষিত করেছি। মুক্ত বাতাসে মানুষের শ্বাস নেওয়ার যে অধিকার সেটাই যেন কেড়ে নিয়েছি। বর্তমান বিশ্বে ঢাকা তৃতীয় সর্বোচ্চ দূষিত শহর। দূষণে ঢাকার আগে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারতের দিল্লি ও মিসরের কায়রো।
ভারতের রাজধানীর উদাহরণ দিয়ে আমরা হয়ত ভাবছি আমরাই সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় নেই। এটা ভেবে কেউ কেউ স্বস্তি পেলে পেতেও পারেন। ভারতেরই আরেক শহর কলকাতা একসময় পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর একটি ছিল। কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না কলকাতা সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেও ঢাকা পারেনি। স্বাভাবিকভাবেই তাই প্রশ্ন চলে আসে কলকাতার কাছ থেকে কেন আমরা শিক্ষা নিলাম না?
বায়ুদূষণ বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বের ৯০ শতাংশ মানুষ দূষিত বায়ুতে শ্বাস নিচ্ছে। এই দূষণের জন্য তথাকথিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তথা সভ্যতার ওপরই দায় চাপিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু এ থেকে উত্তরণে অনেক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকার পরও আমরা করিনি সেটাও বা কিভাবে অস্বীকার করা যায়।
পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের প্রতি আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকদের উদাসীনতার আরেকটি উদাহরণ ঢাকার ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ)। দাতাদের কোটি কোটি টাকায় বছরের পর বছর সময় নিয়ে এই পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর পরও ভূমিদস্যু ও লোভী ডেভেলপারদের স্বার্থ রক্ষায় দফায় দফায় ড্যাপ-এ পরিবর্তন আনা হয়েছে। ঢাকার টিকে থাকায় এরাই এখন সবচেয়ে বড় হুমকি।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছ থেকে বন কেড়ে নিয়েছি আমরা।
রাস্তা, শিল্প ও নগরায়ণের জন্য অনেক দেশেই বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের মতো বেপরোয়া আর অপরিকল্পিতভাবে আর হয়ত কেউই এই কাজ করেনি। গাছ কাটতে সিদ্ধহস্তের পরিচয় দিলেও এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য সমন্বিত কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। ফলাফল, পৃথিবীতে সবচেয়ে কম বনভূমি থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এখন অন্যতম।
আমি আশা করি, বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনের পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে যারা মাহাথির মডেলের কথা বলেন তারা নগর পরিকল্পনায় তার মডেল অনুসরণ করুক।
যারা কুয়ালালামপুর বা মালয়েশিয়ার অন্য কোনো শহরে গেছেন তারা বুঝতে পারছেন আমি কী বলতে চাইছি। বাংলাদেশের মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা, নগর পরিকল্পনাকারী ও আমলারা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তাদের অনেকেই হয়ত একাধিকবার মালয়েশিয়া গেছেন। তবে বিরোধী দল ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় মাহাথিরের হস্তক্ষেপ ছাড়া তারা সেখান থেকে আর কোনো শিক্ষা নিয়ে আসতে পারেননি।
সম্ভবত নদী ধ্বংস করে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছি আমরা।
বদ্বীপ হিসেবে সরাসরি নদী থেকে তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চল। নদীর পলি জমে এভাবে ভূখণ্ড জেগে ওঠার ঘটনা পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। এর ফলে আমাদের দেশের মাটি যেমন উর্বর তেমনি রয়েছে বন্যার ঝুঁকি।
অন্যভাবে বলতে গেলে নদী ছাড়া বাংলাদেশ অস্তিত্বহীন। নদীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের অস্তিত্ব। তবুও দৃশ্যমান এই সত্য দেখেও যেন আমরা বুঝতে চাই না। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের সুস্থ-সুন্দর ভবিষ্যৎ কেড়ে নেওয়ার জন্য আমাদের দোষী করলে অবশ্যই তা করবে নদী নিয়ে। কারণ এই নদী এখনও যেমন আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, তেমনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্বের প্রশ্নটিও জড়িয়ে থাকবে এই নদীর সঙ্গেই।
দুই দিক থেকে আমরা আমাদের নদীকে ধ্বংস করছি। এর একটি পরিমাণগতভাবে অন্যটি গুণগতভাবে। একসময় যা নদীর ছিল নিজের সেই জমি আমরা দখল করেছি। অন্যদিকে নদীর পানি দূষিত করে জলজ পরিবেশের সর্বনাশ করেছি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জলজ প্রাণির বসবাসের জন্য ঢাকার আশপাশের নদীগুলো আর কোনোভাবেই উপযোগী নয়। মাছ বেঁচে থাকার জন্য পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটারে ন্যূনতম পাঁচ মিলিগ্রাম হওয়া প্রয়োজন। ঢাকার পাশের পাঁচটি নদীর সবগুলোতেই অক্সিজেনের মাত্রা শূন্য থেকে এক মিলিগ্রামে নেমে গেছে।
নদী বাঁচাতে এই সংবাদপত্রটি শত শত প্রতিবেদন, নিবন্ধ ও সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। কিন্তু এতেও দায়িত্বশীলদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়নি। আমাদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
দেশজুড়ে ক্ষমতাধর গোষ্ঠীগুলো স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতা কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতায় নদী দখল করেছে। ঢাকার বাইরে নদীগুলোর পানির মান ঢাকার নদীগুলোর মতো শোচনীয় না হলেও পানি প্রবাহের পথ সংকীর্ণ হয়ে মরণোন্মুখ হয়ে পড়েছে।
একদিকে আমরা মধ্যম আয়ের দেশের পথে অগ্রসর হওয়ার গর্ব করছি অন্যদিকে যে প্রকৃতি আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে তাকেই ধ্বংস করে চলেছি। দুটোই কি একসঙ্গে চলতে পারে?
ইংরেজি থেকে ভাষান্তর: আবু সাদিক
Comments