নির্বাচনের নয়া মডেল
সাম্প্রতিক সবগুলো নির্বাচনের মধ্যে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছিল তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ। সদ্য শেষ হওয়া এই নির্বাচনে ভোটগ্রহণের দিন তেমন কোনো সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি। হতাহতও হয়নি কেউ। বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে এ ধরনের উদাহরণ খুব বেশি নেই।
শেষ কয়েকটি নির্বাচনের মতো গাজীপুরেও আচরণবিধি লঙ্ঘন, বুথ দখল করে বিএনপির পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়া, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের শো-ডাউন, ভোটারদের ভীতি প্রদর্শন, ব্যালট কেড়ে নিয়ে জোর করে সিল মারার মতো গুরুতর অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। তবে এসবের বিরোধিতা করার কেউ না থাকায় ‘শান্তিপূর্ণভাবে’ শেষ হয়েছে নির্বাচন।
তবু বেশ কিছু দিক থেকে গাজীপুরের নির্বাচন ছিল অনন্য। ভোটগ্রহণের দিন এগিয়ে আসতেই বিভিন্ন নাশকতার মামলায় আসামি বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো। বিরোধী দলের আসামিদের ধরতে তাদের বাড়িতে বাড়িতে যায় পুলিশ-র্যাব। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো অভিযান চালালেও সেই মাত্রায় বিএনপির নেতাকর্মী ধরপাকড় হয়নি। জনগণের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হতে পারে ভেবেই হয়তো তারা এটা করেনি। তবে বিরোধী দলের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্কের পরিবেশ বজায় ছিল।
ভোটের মাত্র সপ্তাহখানেক আগে বিএনপির আটজন নির্বাচন সমন্বয়কারীকে গ্রেপ্তার নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন দলটির মেয়রপ্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার। নেতাকর্মীদের হয়রানি করার অভিযোগ নিয়ে তারা নির্বাচন কমিশন ও রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কর্ণপাত করেনি কেউ। ভোটের দিন মাঠে বিরোধী দলের দুর্বল উপস্থিতি ও ভোটকেন্দ্র থেকে এজেন্টদের বের করে দেওয়ায় ভুয়া ভোট পড়লেও বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি কাউকে। ফলাফল হিসেবে সহিংসতার ঘটনাও ঘটেনি। সহিংসতা না হওয়ায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও কোনো ব্যবস্থা নিতে হয়নি। এভাবেই শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে গাজীপুরে নির্বাচন।
গাজীপুর নির্বাচনের মাস দেড়েক আগে খুলনা সিটি নির্বাচনেও প্রায় একই চিত্র দেখা গিয়েছিল। গত মঙ্গলবার গাজীপুরে যা যা হয়েছে তার সবই ঘটেছিল খুলনায়। এভাবে জাতীয় নির্বাচনের মাত্র ছয় মাস আগে সিটি নির্বাচনগুলোর মাধ্যমে নতুন এক ধরনের নির্বাচনী মডেল তৈরি হচ্ছে। অনিয়মই যেন নিয়ম হয়ে উঠছে।
আগেই বলেছি, বাংলাদেশের ইতিহাসে এরকম নিয়ন্ত্রিত ও সহিংসতা মুক্ত নির্বাচন বিরল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কথা। ওই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে দিনের পর দিন সহিংসতা চলে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সহিংস ওই নির্বাচনে প্রায় ১০০ মানুষ নিহত হন। জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে ভোটগ্রহণের দিন ২০ জন নিহত হন। গত পাঁচ বছরে দেশে আর যত নির্বাচন হয়েছে তার প্রায় সবগুলোতেই সংঘর্ষ হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
খুলনা ও গাজীপুরের নির্বাচন সেদিক থেকে ছিল সহিংসতামুক্ত। এই দুই নির্বাচন যে বার্তা দেয় তা আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। খুলনার নির্বাচন দিয়েই রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য আগামী জাতীয় নির্বাচনের দৌড় শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই শুরুটাকে কোনোভাবেই ভালো বলা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে গাজীপুরে যেভাবে নির্বাচন হলো তাতে আগামী জাতীয় নির্বাচন যে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে তেমন আশা আরও দুরূহ হয়েছে। এই অবস্থায় আগামী ৩০ জুলাই রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা এখন সুতায় ঝুলছে।
এখন যে সিটি করপোরেশনগুলোতে নির্বাচন হচ্ছে ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসের জাতীয় নির্বাচনের আগ দিয়ে এই সবগুলো সিটিতে নির্বাচন হয়েছিল। সেবার পাঁচটি সিটিতেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী পরাজিত হলেও নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সাধুবাদ পেয়েছিল সরকার। নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা তখনও প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। ওই নির্বাচনগুলোর উদাহরণ দেখিয়ে তখন সরকারের পক্ষ থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নাকচ করা হয়েছিল।
কিন্তু এবার জাতীয় নির্বাচনের আগে হাওয়া বইছে উল্টো দিকে। খুলনা ও গাজীপুরে যেভাবে নির্বাচন হলো তাতে আগামী জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে তা নিয়ে কোনো ইতিবাচক বার্তা পাওয়া যাচ্ছে না। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনের পর যতগুলো নির্বাচন হয়েছে সবগুলোতেই প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচনী ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়তে বসেছে। নির্বাচন কমিশনেরও দুর্বলতা ফুটে উঠছে। সর্বোপরি, শেষ দুই সিটি নির্বাচনের পর ইসি ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্টভাবে সামনে এসেছে।
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্ত ভিত্তির ওপর গড়ে তুলতে না পারলে নির্বাচনের গণতন্ত্র কার্যকারিতা হারায়। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের উদাহরণ রয়েছে আমাদের সামনে। কিন্তু এর পরও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভারসাম্য আনার জন্য সংসদ, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোকে কার্যকর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার আন্তরিক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ধীরে ধীরে অকার্যকর হতে বসেছে দেশের গণতন্ত্র। নির্বাচনের যে নতুন মডেল তৈরি হচ্ছে সেটা কি তারই ফল নয়?
Comments