জঙ্গি মতাদর্শ মোকাবিলায় শক্তি প্রয়োগ যথেষ্ট?
দুই বছর আগে জঙ্গিরা গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলা চালিয়ে ১৭ জন বিদেশিসহ ২২ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করলে সরকার জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সাড়াশি অভিযান শুরু করে। পুলিশ ও র্যাবের একের পর এক অভিযানে ৭৯ জন সন্দেহভাজন জঙ্গি নিহত ও দেড় শতাধিক আটক হয়। এসব অভিযানে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদও উদ্ধার করা হয়েছে। যদিও দেশের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হামালার ছয়দিন পর কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছিল। ঈদুল ফিতরের জামাতের কিছুক্ষণ আগে সে হামলায় চারজন মারা যায়।
বাংলাদেশে মূলত আলকায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের আদর্শে উজ্জীবিত আনসার আল ইসলাম ও জামাতুল মুজাহিদিন সক্রিয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত এই দুই জঙ্গি সংগঠনকেই বাংলাদেশে বিভিন্ন হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে দায়ী করা হয়।
এরপর গত দুই বছরে বড় কোনো জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেনি। বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গিদের আস্তানার খবর পেয়ে তাদের ঘেরাও করে। অধিকাংশ অভিযানই শেষ হয়েছে বন্দুকযুদ্ধে জঙ্গিদের নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি তাদের অভিযানের ফলে জঙ্গি সংগঠনগুলোর নেটওয়ার্ক ভেঙে গেছে এবং তারা হামলার সক্ষমতা হারিয়েছে। এর ফলে জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ সফল এবং রোল মডেলে পরিণত হয়েছে দাবি করে সরকার একধরনের আত্মতুষ্টিতে ভুগছে।
আসলেই কি বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা বন্ধ হয়ে গেছে? প্রকৃতই কি সরকার জঙ্গি কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে? ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে যে জঙ্গিরা ব্লগার, ধর্মীয় সংখ্যালঘু , বিদেশি নাগরিক ও এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষকে লক্ষ্য করে একের পর এক হামলা চালিয়ে আসছে তারা কি আসলেই হামলার সক্ষমতা হারিয়েছে? নাকি তারা অভিযানের মুখে আত্মগোপনে চলে গেছে এবং সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে?
বাস্তবতা হচ্ছে, অভিযানের কারণে জঙ্গি সংগঠনগুলো দুর্বল হয়ে পড়লেও তাদের কার্যক্রম থেমে যায়নি। তারা তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। তবে তারা এখন অনেক কৌশলী। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র থেকে জানা যায়, হামলা করা ছাড়া অন্য সব ধরনের জঙ্গি কার্যক্রম তারা চালিয়ে যাচ্ছে। নানা উপায়ে তারা ধর্ম ও জিহাদ বিষয়ে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। লেখা, প্রবন্ধ ও বক্তব্য আদান-প্রদান এর মধ্যে অন্যতম। ডিজিটাল মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক, টুইটার, টেলিগ্রাম, উইকার এবং অন্যান্য নিরাপদ অ্যাপস ব্যবহার করা হচ্ছে এসব আদান প্রদান। এভাবে তারা মানুষকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে কর্মী সংগ্রহ করে যাচ্ছে। এদের বড় একটি অংশ অল্প বয়সী তরুণ-তরুণী যাদের ধর্ম সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নেই। ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিশ্ছিদ্র-নিরাপদ কারাগার প্রকোষ্ঠে চলছে কট্টর ইসলামী মতবাদে মগজধোলাইর কাজ।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাড়াশি অভিযানের ভেতরেও জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারছে কারণ সরকার শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ দমনের যে কৌশল নিয়েছে তা রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে উদ্ভূত এই ধরণের সমস্যা নির্মূলে যথেষ্ট নয়। শক্তি প্রয়োগ করে স্বল্পসময়ের জন্য সফলতা পাওয়া সম্ভব হলেও মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তা দীর্ঘমেয়াদী হয় না।
জঙ্গিবাদ বিস্তারের পেছনে যে কারণগুলো রয়েছে তার প্রায় প্রত্যেকটি বাংলাদেশে বিদ্যমান। ধর্মীয় অপব্যাখ্যা, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, দুর্বল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর তৎপরতা সবই বাংলাদেশে বিদ্যমান। কেবল শক্তি প্রয়োগ করে এসব মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এসব ক্ষেত্রে জঙ্গিরা আত্মগোপনে চলে যায়, গোপনে সংগঠিত হয়ে সুযোগের অপেক্ষা করে এবং সুযোগমতো হামলা চালায়। গত মার্চ মাসে অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবালের উপর হামলা এবং গত ১১ জুন মুন্সীগঞ্জে গুলি করে প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চু হত্যার ঘটনা সে ইঙ্গিত বহন করে। গোপনে সুসংগঠিত হয়ে আগামীতে আরও বড় ধরনের হামলার চালালে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তাই বাংলাদেশকে স্বল্পমেয়াদী সফলতার আত্মতুষ্টি থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের হয়ে আসতে হবে।
শক্তি প্রয়োগ করে বিশ্বের কোথাও জঙ্গিবাদ দমন করা সম্ভব হয়নি। বরং তা আরও বিপর্যয় ডেকে এনেছে। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক উন্নত দেশে এখন জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় বিকল্প কৌশল ভাবা হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে সিঙ্গাপুরের কথা বলা যায়। জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে দেশটি দীর্ঘমেয়াদী সমন্বিত একটি কৌশল নিয়েছে। জঙ্গি মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ জনগোষ্ঠীকে সুস্থ চিন্তাধারায় ফিরিয়ে এনে সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি জঙ্গিবাদের কারণগুলো নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সমন্বয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিতে হবে। জঙ্গি নয়, জঙ্গি আদর্শকে নির্মূল করা হবে লক্ষ্য। যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের জন্ম সেই মুক্ত চিন্তাকে উজ্জীবিত করে সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিসরে কট্টর ধর্মীয় মতবাদকে মোকাবিলা করতে হবে।
Comments