কয়লা গায়েব: বন্ধ হওয়ার পথে বড়পুকুরিয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন

বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে উত্তোলন করে রাখা বিপুল পরিমাণ কয়লা গায়েব হয়ে যাওয়ার পর জ্বালানি সংকটে পড়েছে কয়লা খনির পাশের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যাপ্ত কয়লা না থাকায় আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই অনির্দিষ্ট কালের জন্য ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে।
কয়লা সংকটের কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ১২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিট ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। অপেক্ষাকৃত বেশি দক্ষতা সম্পন্ন ২৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার অপর ইউনিটটিও একই কারণে বন্ধ হওয়ার পথে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিদর্শক মাহবুবুর রহমান জানান, এই ইউনিটটি এখন সীমিত ক্ষমতায় চালিয়ে ১৫০ মেগাওয়াট উৎপাদনে রয়েছে।
শনিবার দ্য ডেইলি স্টার কয়লা গায়েবের খবরটি প্রকাশ করলে বিষয়টি আলোচনায় আসে। তবে এখন পর্যন্ত সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি জ্বালানির জন্য বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ওপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। পূর্ণ ক্ষমতায় চালাতে প্রতিদিন এখানে তিন হাজার ৩০০ টন কয়লার প্রয়োজন হলেও এখন মাত্র ৬০০ টন কয়লা পাওয়া যাচ্ছে। মাহবুবুর জানান, এভাবে চালালেও আগামী ২৫ জুলাইয়ের পর কয়লাশূন্য হয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সংকটের বিষয়টি সামনে আসার পর জানা যায় খনি থেকে উত্তোলন করে ইয়ার্ডে রাখা ১ লাখ ৪২ হাজার টন কয়লা গায়েব হয়ে গেছে। বর্তমান বাজার মূল্যে এই কয়লার দাম ২২৭ কোটি টাকার ওপরে। গত সোমবার বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সদস্য আবু সাঈদ কয়লা খনি এলাকা পরিদর্শনে যাওয়ার পর কয়লা গায়েব হওয়ার কথা প্রথম জানা যায়।
এই ঘটনায় বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির (বিসিএমসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও একজন মহাব্যবস্থাপককে প্রত্যাহার করা হয়েছে। আরও একজন মহাব্যবস্থাপক ও উপ-মহাব্যবস্থাপককে সাময়িক বরখাস্ত করেছে খনি কোম্পানিটির নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা।
খনি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিব উদ্দিন আহমদকে অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি (ওএসডি) করে পেট্রোবাংলায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। গত বছর এপ্রিল মাসে তাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কোম্পানি সেক্রেটারি ও মহাব্যবস্থাপক আবুল কাশেম প্রধানিয়াকে তাৎক্ষণিক বদলি (স্ট্যান্ড রিলিজ) করে সিরাজগঞ্জে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানিতে পাঠানো হয়েছে।
আর সাময়িক বরখাস্ত কর্মকর্তারা হলেন, আবু তাহের মো. নূর-উজ-জামান, মহাব্যবস্থাপক (মাইন অপারেশন) ও খালেদুল ইসলাম উপ-মহাব্যবস্থাপক (স্টোর)। বিসিএমসিএল’র একজন কর্মকর্তা জানান, দায়িত্বে অবহেলার জন্য এই চারজনের বিরুদ্ধে এখন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
গত ২০ জুন ঢাকায় পেট্রোবাংলা ও বিপিডিবি’র কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠকে হয়। সেখানে কয়লা খনির এক কর্মকর্তা জানান, ১ লাখ ৮০ হাজার টন কয়লা ইয়ার্ডে মজুদ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেসময় খনির ইয়ার্ড কার্যত ছিল ফাঁকা। পেট্রোবাংলা ও বিপিডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গত সোমবার ও মঙ্গলবার খনি পরিদর্শন করে মাত্র ৩০ হাজার টনের মতো কয়লা পেয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন জানান, ১ লাখ ৪২ হাজার টন কয়লার হদিস পাওয়া যায়নি।
বিসিএমসিএল কর্মকর্তারা বলেন, গত ৩০ মার্চ পর্যন্ত ২ লাখ ৫০ হাজার টন কয়লা তাদের ইয়ার্ডে মজুদ ছিল। এর পর ২৯ জুন পর্যন্ত আরও ১ লাখ ৮৫ হাজার টন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে। আর বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১ এপ্রিল থেকে ১০ জুলাইয়ের মধ্যে কয়লা গেছে ২ লাখ ৫০ হাজার টন। হিসাব অনুযায়ী ১ লাখ ৪২ হাজার টন কয়লা থাকার কথা ছিল, যার কোনো হদিস নেই।
খনির ভেতরে যন্ত্রপাতি স্থানান্তরের জন্য ২৯ জুন থেকে কয়লা উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। খনি কোম্পানির একজন মহাব্যবস্থাপক বলেছেন, তাদের আশা আগামী মাস থেকে ফের উত্তোলন শুরু হবে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কয়লা মজুদ না থাকার কথা খনি কর্মকর্তারা সময়মতো জানালে হয়ত এরকম তীব্র সংকটে পড়তে হতো না। কিন্তু তাদের দিক থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এরকম কোনো তথ্য জানানো হয়নি। পর্যাপ্ত কয়লা পেলেই কেবল বিদ্যুৎ উৎপাদন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব।
গতকাল বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিদর্শনে যাওয়া বিপিডিবির কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কতদিন বন্ধ হয়ে পড়ে থাকবে সে নিয়েও তারা এখন ধন্দে রয়েছেন।
কয়লা গায়েব হওয়ার ঘটনা তদন্তে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন এন্ড মাইনস) মো. কামরুজ্জামানকে প্রধান করে একটি তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। পেট্রোবাংলার পরিচালক (প্ল্যানিং) আইয়ুব খান চৌধুরীকে বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে বিসিএমসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে। গতকাল তিনি কয়লাখনি এলাকায় গিয়েছিলেন। তবে কোনো মন্তব্য করতে তিনি রাজি হননি।
পাশের বিদ্যুৎকেন্দ্রটিই বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির প্রধান গ্রাহক। তারা প্রতি টন কয়লা কিনে ১১ হাজার টাকা দরে। আর ইটভাটার জন্য যে কয়লা বিক্রি করা হয় তার দাম রাখা হয় টন প্রতি ১৭ হাজার টাকা। বিপিডিবি’র একজন কর্মকর্তা জানান, দাম বেশি হওয়ায় খনির কর্মকর্তারা ইটভাটা মালিকদের কাছে কয়লা বিক্রিতেই বেশি উৎসাহী। কারণ এতে বোনাস হিসেবে লভ্যাংশ বেশি পাওয়া যায়।
ইটভাটার মালিক ও স্থানীয় লোকজন জানান, খনি এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। সেখান থেকে এমন বিপুল পরিমাণ কয়লা চুরি হয়ে যাওয়া তাদের কল্পনাতীত।
Comments