মারলেন কেন! মারবেন কেন?

যে কিশোরীটিকে পুলিশ মোটা লাঠি দিয়ে পেটালো, তার বয়স বড়জোর ১৭ বছর। যে কিশোর বা কিশোরীর রক্তমাখা কাপড়ের জুতার ছবি ছড়িয়ে পড়ল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, যে পুলিশ পেটালো তারও নিশ্চয়ই এমন বয়সের একটি সন্তান আছে। যারা বা যাদের নির্দেশে পেটালো, সন্তান আছে তাদেরও।
মিরপুর ১৩ নম্বরে মঙ্গলবার বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের বেধড়ক লাঠিপেটা করে পুলিশ। বিমানবন্দর সড়কে গাড়িচাপায় দুজন শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার প্রতিবাদ করছিল তারা। ছবি: সংগৃহীত

স্কুল-কলেজের খুদে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে ক্ষোভ-বিক্ষোভ করল, বাস ভাঙচুর করল। এই ক্ষোভের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সংবেদনশীলতার সঙ্গে অনুধাবন করলেন না। করার চেষ্টা করলেন না। পুলিশ দিয়ে তাদের ধাওয়া দিলেন, পেটালেন। গ্রেপ্তার করে গাড়িতে তুললেন। যে কিশোরীটিকে পুলিশ মোটা লাঠি দিয়ে পেটালো, তার বয়স বড়জোর ১৭ বছর। যে কিশোর বা কিশোরীর রক্তমাখা কাপড়ের জুতার ছবি ছড়িয়ে পড়ল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, যে পুলিশ পেটালো তারও নিশ্চয়ই এমন বয়সের একটি সন্তান আছে। যারা বা যাদের নির্দেশে পেটালো, সন্তান আছে তাদেরও।

মাথায় ব্যান্ডেজ, কলেজের সাদা পোশাকে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ, পুলিশি নিপীড়নে আহত হয়ে হাসপাতালে শুয়ে আছে যে কিশোর, বাস পিষে মেরে ফেলেছে তার বন্ধুকে।

তার প্রতিবাদেই সে রাস্তায় নেমে এসেছিল। বন্ধু- সহপাঠী হারিয়ে শিক্ষার্থীরা যখন বিলাপ করছিলেন, মন্ত্রী তখন হাসছিলেন। ২ জন আর ৩৩ জনের তুলনা করছিলেন।

শিশু-কিশোরদের ক্ষোভের প্রতি সম্মান দেখালেন না। দেখালেন না সহানুভূতি বা সংবেদনশীলতা। হাসির পরে মন্ত্রী বললেন ‘আমি কেন ক্ষমা চাইব’। তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন একদিন পরে, গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী বলার পরে।

এক দিকে দুঃখ প্রকাশ, আরেকদিকে পুলিশ দিয়ে পেটালেন। কেন মারলেন! কেন মারবেন? আর কিছু করার ছিল না? সংবিধান তো এভাবে মারার অধিকার কাউকে দেয়নি।

ক্ষোভ প্রশমনের একমাত্র পথ যে পুলিশি লাঠিপেটা নয়, আমাদের কোনো ক্ষমতার দল কেন যেন বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। যারা বিক্ষুব্ধ ছিল, পিটিয়ে তাদের আরও বিক্ষুব্ধ করে দিলেন। করে দিচ্ছেন।

হ্যাঁ, এর ফলে তারা রাস্তায় টিকতে পারবে না, ঘরে-স্কুলে-কলেজে ফিরে যেতে বাধ্য হবে। না পেটালেও তারা ফিরে যেত। তারা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে আসেনি। এমনকি তাদের কোনো নেতাও নেই। তাদেরকে শান্ত করার আরও অনেক পথ খোলা ছিল। মন্ত্রীরা বা দলীয় নেতারা তাদের কাছে গিয়ে কথা বলতে পারতেন। তা না করে শক্তি প্রয়োগের পথ বেছে নিলেন।

পুলিশের লাঠির আঘাতে গুরুতর আহত আহাদকে স্কয়ার হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

টেলিভিশনের সামনে বলছেন, অপরাধীদের বিচার- শাস্তি দেওয়া হবে। অতীতেও একই কথা বলেছেন, শাস্তি- বিচার হয়নি। প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা বা বিশ্বাস না রাখার প্রেক্ষাপটও  আপনারাই তৈরি করেছেন। সেই আস্থা- বিশ্বাস তৈরির চেষ্টা তো করতে পারতেন।

হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে পুলিশি নির্যাতনে আহত হয়ত হয়েছেন দশ পনেরো বা বিশ জন। বাংলাদেশের বিবেচনায় সংখ্যায় তা হয়ত খুব বেশি নয়। কিন্তু এর যে সুদূরপ্রসারী ফলাফল, তা চিন্তা করলেন না। বিবেচনা করলেন না, পরিণতি কী হতে পারে। স্কুল বা কলেজের এসব শিক্ষার্থীদের কারও বয়সই ১৮ বছরের বেশি নয়। বোঝার বয়সের পর এই প্রথম তারা এমন একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি। এসব শিশু-কিশোরদের সঙ্গে যে আচরণ করা হলো, তাদের মনে যে ক্ষত জন্ম নিলো, কী দিয়ে তা দূর করবেন?

দমন-পীড়নে সাময়িক ফল হয়ত মেলে। মানুষের ক্ষুব্ধতা ভেতরে থেকে যায়। মনে করছেন কোটা সংস্কার আন্দোলন পিটিয়ে ঠান্ডা করে দিতে পেরেছেন। আসলেই কী পেরেছেন? এভাবে কেউ পারে, অতীতে পেরেছে?

পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়।

বাস ভাঙচুরে যেমন দুর্ঘটনা থেকে পরিত্রাণ মিলবে না, বিচ্ছিন্ন কোনো সিদ্ধান্তও পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় কোনো ভূমিকা রাখবে না। চলার অনুপযুক্ত বাসের জন্যে ফিটনেস পরীক্ষা করার কমিটি গঠন করে কী হবে? রোড পারমিটবিহীন লেগুনা চলতে দিয়ে, শিশু চালককে ধরে ফল মিলবে?

সামগ্রিক পরিকল্পনা ছাড়া, ঘটনার প্রেক্ষিতে টোটকা সমাধান- আর কত দিন?

সব কিছুর আগে রাস্তায় নেমে আসা শিক্ষার্থীদের বিষয়টি, ন্যায্যতা এবং সংবেদনশীলতার সঙ্গে দেখুন। ফিরে আসুন শক্তি প্রয়োগের পথ থেকে। স্কুল- কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তো নয়ই, কাউকেই মারবেন না।

Comments

The Daily Star  | English

Mob beating at DU: Six students confess involvement

Six students of Dhaka University, who were arrested in connection with killing of 35-year-old Tofazzal Hossain inside their hall on Wednesday, confessed to their involvement in the crime before a magistrate

5h ago