পুলিশের সঙ্গে লাঠিধারী যুবক, এরা কারা?

হেলমেট পরিহিত যুবক একজন শিশুর মাথার চুল ধরে আছে, আরেক যুবক পেছন থেকে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে যাচ্ছে। দুই হাত দিয়ে লাঠি ধরে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে সে আঘাত করছে। ভয় আতঙ্কে চিৎকার করছে শিশুটি। তার এই চিৎকারের ছবি আঘাত করার আগের। আঘাতের পরে তার পরিণতি কী হয়েছে, তা আমরা জানি না।

ক. হেলমেট পরিহিত যুবক একজন শিশুর মাথার চুল ধরে আছে, আরেক যুবক পেছন থেকে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে যাচ্ছে। দুই হাত দিয়ে লাঠি ধরে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে সে আঘাত করছে। ভয় আতঙ্কে চিৎকার করছে শিশুটি। তার এই চিৎকারের ছবি আঘাত করার আগের। আঘাতের পরে তার পরিণতি কী হয়েছে, তা আমরা জানি না।

খ. আরেকটি ছবিতে লাঠি-ঢাল হাতে ক্ষিপ্রগতিতে দৌড়ে আসছে পুলিশ। পুলিশের সামনে-মাঝে তার চেয়েও ক্ষিপ্ত একদল যুবক, তাদের হাতেও লাঠি। তারা ধাওয়া করছিল শিশু শিক্ষার্থীদের। যারা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে। পুলিশ-যুবকেরা মিলে পিটিয়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পেটানোর পরবর্তী পরিস্থিতি কেমন হয়েছিল, অনুধাবন করা হয়তো কঠিন নয়।

গ. লাঠিপেটা এবং ধাওয়া খেয়ে শিশুরা দৌড়ে উঠেছিল ফুটওভার ব্রিজের উপর। প্রশিক্ষিত পুলিশ ফুটওভার ব্রিজের দুই পাশ দিয়ে উঠে, আটকে পড়া শিশু-শিক্ষার্থীদের মোটা লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে। দেখে-শুনে সময় নিয়ে বেধড়ক পিটিয়েছে। এর একটি ভিডিও চিত্র ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

ওপরের বর্ণনার প্রথম দুটি ছবি গতকাল দ্য ডেইলি স্টার প্রকাশ করেছে। এই লেখার সঙ্গে আবারও প্রকাশিত হলো।

২.

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, ‘আন্দোলনের বিভিন্ন ভিডিওতে দেখেছি শিবিরের নেতাদের, বিএনপির ছাত্রদলের নেতাদেরও দেখেছি।’

রাস্তায় নেমে আশা শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে সরকার বলছে ‘ঘরে ফিরে যাও, অনেক হয়েছে’।

সরকারের চিন্তিত হয়ে পড়ার খুব যৌক্তিক কারণ আছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ। সে অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী সবাই শিশু। শারীরিক-মানসিক যেকোনো রকম নিপীড়ন-নির্যাতন থেকে শিশুদের রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের। যদি সরকার তা না করে বা করতে ব্যর্থ হয়, তবে প্রশ্নের জবাব দিতে হতে পারে সরকারকে। একবার তুর্কমেনিস্তানে শীতের সময় স্কুলের হিটিং সিস্টেম অকেজো হয়ে পড়েছিল। তারপরও স্কুল বন্ধ না দিয়ে শিশুদের স্কুলে পাঠানো হয়েছিল। কিছুসংখ্যক শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে। আন্দোলন হয় এবং তুর্কমেনিস্তানকে শিশু সনদের অঙ্গিকার ভঙ্গ করায় জবাবদিহি করতে হয়।

প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসা শিশুরা সরাসরি শারীরিক-মানসিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। সরকার তাদের শারীরিক নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে পারেনি। তার চেয়েও বড় বিষয়, পুলিশ শিশু-শিক্ষার্থীদের প্রহার করেছে। যার স্থির-ভিডিও চিত্র রয়েছে। শিশু সনদ অনুযায়ী এটা অপরাধ।

৩.

সরকারের নীতি-নির্ধারকরা শিশুদের প্রতিবাদে নাশকতার আশঙ্কা করছেন। ‘দাবি মেনে নেওয়া হলো’ ঘরে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। শিশুরা বিশ্বাস করছে না। তারা বারবার রাস্তায় নেমে আসছে। এই প্রতিবাদের সঙ্গেও ‘শিবির-বিএনপি’র গন্ধ পাচ্ছে সরকার। নাশকতার আশঙ্কা বিষয়ে সরকার আগে থেকে সচেতন হবে, সেটাই প্রত্যাশিত। প্রশ্ন হলো, পুলিশের সঙ্গে মিলে যারা শিশুদের শারীরিকভাবে আঘাত করল, তারা কারা? তারা কি ‘শিবির-বিএনপি?’ তাহলে পুলিশ তো তাদের গ্রেপ্তার করবে, সঙ্গে নিয়ে আক্রমণে গেল কেন? লাঠি হাতে পুলিশের ভেতরে, কেউ কেউ হেলমেট পরে অবস্থান নিলো কীভাবে?

সাদা শার্ট পরিহিত যে যুবক দুই হাত দিয়ে লাঠি ধরে শিশু শিক্ষার্থীকে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত করছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার একটা পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছে। সে পরিচিতি প্রকাশিত হয়েছে তা সঠিক না ভুল, তদন্ত করে তা জানাতে পারে পুলিশ। কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে পরিচিতি ছড়িয়েছে, মানুষ সেটাই বিশ্বাস করবে। শিশুদের প্রতিবাদে সুযোগ নেয়ার জন্যে ‘শিবির-বিএনপি’ যদি ঢুকেও থাকে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। ‘নাশকতা হতে পারে’- বলার মধ্য দিয়ে সরকারের দায়িত্ব শেষ হতে পারে না। ‘নাশকতার দায় সরকার নেবে না’- সরকারে থেকে একথা বলা যায় না।

যে কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের বিরুদ্ধে অবশ্যই সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। এই প্রশ্নগুলোরও জবাব দিতে হবে-

সরকারের পুলিশ, লাঠিধারী যুবকদের সঙ্গে নিয়ে কেন শিশু শিক্ষার্থীদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করল?

সরকারের মন্ত্রী- নীতি নির্ধারকরা নিশ্চয় এই চিত্র-ভিডিও চিত্র দেখেছেন। কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? এদের পরিচিতি শিবির- বিএনপি না ছাত্রলীগ, প্রকাশ করছেন না কেন? কেন তাদের গ্রেপ্তার করা হলো না বা হচ্ছে না?

৪.

ট্রাফিক পুলিশের কাজ শিক্ষার্থীদের নয়, তা নিয়ে তো কোনো বিতর্ক নেই। দুটি মৃত্যুই শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের কারণ নয়। রাস্তায় নেমে আসা, দীর্ঘদিনের ক্ষোভের প্রকাশ। ক্ষোভ প্রকাশে কিছু অশালীন পোস্টার ব্যথিত করেছে। পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকতে পারে, তা প্রকাশও হতে পারে। তবে তা অমার্জিত ভাষায় নয়। যতই বলা হোক এটা সমাজ বাস্তবতারই প্রতিফলন, তবুও মেনে নেওয়া যায় না। একই সঙ্গে এটাও লক্ষণীয়, হাজার হাজার অভিনব পোস্টার-প্ল্যাকার্ডের ভেতর থেকে দু’তিনটি অশালীন ভাষার পোস্টার নিয়ে প্রোপাগান্ডা চালানোটাও সৎ উদ্দেশের পরিচয় নয়। রাস্তায় নেমে অনেকগুলো গাড়ির গ্লাস শিশু শিক্ষার্থীরা ভেঙেছে, অসত্য নয়। গাড়ি ভাঙার সেই দৃশ্যই এই আন্দোলনের একমাত্র তাৎপর্য নয়। সবচেয়ে নির্মম তাৎপর্য বড়দের, নীতি নির্ধারকদের যা করার ছিল তা কেউ করেননি। সেই চিত্রটা শিশুরা সবাইকে অনুধাবন করাতে সক্ষম হয়েছে।

শিশুরা রাস্তায় নেমে আসার পর, আপনারা বলছেন ‘সব করব এখন তোমরা ফিরে যাও’।

যে আস্থা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা আপনারা হারিয়েছেন, তা ফিরিয়ে আনার জন্যে শুধু প্রতিশ্রুতিতে কাজ হবে না।

পুলিশ দিয়ে বা লাঠিধারী যুবকদের দিয়ে শিশুদের নির্যাতন-নিপীড়ন করবেন না। প্রতিবাদে অংশ নেওয়া শিশু শিক্ষার্থীদের স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার নীতি থেকেও ফিরে আসুন। বল প্রয়োগের নীতিতে শিশুদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে পারবেন, শিশুদের মন থেকে নিজেরাও হারিয়ে যাবেন।

Comments

The Daily Star  | English
speech by Dr Yunus

Yunus to address nation at 7:30pm

Chief Adviser Professor Muhammad Yunus will address the nation at 7:30pm today

35m ago