সড়ক দুর্ঘটনায় দোষ চালকের একার নয়

বাংলাদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সড়ক দুর্ঘটনা হলেই দীর্ঘ কর্মঘণ্টা ও স্বল্প আয়ের এই চালকদেরকেই দায়ী করার প্রবণতা দেখা যায়। সম্প্রতি ঢাকায় দুজন শিক্ষার্থী বাস চাপায় নিহত হওয়ার পর সড়ক দুর্ঘটনায় চালকদেরকে দোষী করার মনোভাব আরও প্রকট হয়েছে।
ঢাকার রাস্তায় চলাচল করা বাসগুলোতে চালকের আসনের পাশেই চাপাচাপি করে বসে যাতায়াত করছেন যাত্রীরা। ছবি: রয়টার্স

একটি বেসরকারি পরিবহন সংস্থায় দিনে একটানা ১৭ ঘণ্টা করে সপ্তাহে তিন দিন বাস চালান খুরশিদ আলম। চালক হিসেবে নিয়মিত কোনো বেতন পাননা তিনি। ট্রিপভিত্তিক বাস ভাড়া নিয়ে তিনি বাস চালান। সব ড্রাইভারই মালিকের থেকে এভাবে ট্রিপভিত্তিক ভাড়া নিয়ে বাস চালান। প্রতি ট্রিপ হিসেবে মালিককে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে, তারপর চালকের আয় হিসাব করতে হয়। একারণে একজনের আগে আরেকজনের যাওয়ার প্রতিযোগিতা থাকে সব সময়। সবাই আগে গিয়ে বেশি যাত্রী তুলে বেশি আয় করতে চান।

বাংলাদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সড়ক দুর্ঘটনায় দীর্ঘ কর্মঘণ্টা ও স্বল্প আয়ের এই চালকদেরকেই দায়ী করার প্রবণতা দেখা যায়। সম্প্রতি ঢাকায় দুজন শিক্ষার্থী বাস চাপায় নিহত হওয়ার পর সড়ক দুর্ঘটনায় চালকদেরকে দোষী করার মনোভাব আরও প্রকট হয়েছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে এক সপ্তাহের বেশি ছাত্র আন্দোলনে ঢাকা কার্যত অচল হয়ে যাওয়ার পর বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে প্রাণহানির জন্য চালকের সাজা তিন বছর থেকে পাঁচ বছর করে একটি আইনের খসড়ায় অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, সড়কে প্রাণহানির দায় কি কেবলমাত্র চালকের?

বাংলাদেশের রাস্তায় যেসব বেসরকারি পরিবহন সংস্থার বাস চলাচল করে তার চালকদের নিয়মিত কোনো বেতনের ব্যবস্থা নেই। খুরশিদ আলমের মতো অন্য চালকদেরকেও যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা ভাড়া থেকে কমিশনের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ কারণেই একটু বাড়তি আয়ের জন্য বিশ্রাম ছাড়াই ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বাস চালাতে হয় তাদেরকে। সেই সঙ্গে বাড়তি যাত্রীর অর্থ হলো বাড়তি ভাড়া, আর বাড়তি ভাড়ায় আসে বেশি কমিশন। এ কারণে যাত্রী তুলতে রাস্তায় অন্যান্য বাসের সঙ্গে তাদের পাল্লা দিতে দেখা যায়।

গত মাসের ২৯ তারিখ ঢাকায় যে দুজন শিক্ষার্থী নিহত হয় তাদেরকেও এরকম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত একটি বাস চাপা দিয়েছিল। আটক বাস চালক আদালতকে বলেছেন, যাত্রী তোলার জন্য অন্য একটি বাসের সঙ্গে তিনি পাল্লা দিচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তিনি অপেক্ষমাণ যাত্রীদের ওপর বাস তুলে দেন।

এই ঘটনার পর থেকেই হাজারো শিক্ষার্থী ঢাকার রাস্তায় নেমে এসে প্রতিবাদ করতে শুরু করে। স্কুল ও কলেজ ইউনিফর্মে থাকা শিক্ষার্থীরা চালকদের লাইসেন্স ও ফিটনেসের কাগজপত্র পরীক্ষা করেছে। সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা এই আন্দোলনে ১ কোটি ৮০ লাখ জনসংখ্যার শহরটি অচল হয়ে পড়ে। শুরুতে আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকলেও শেষ পর্যায়ে এসে শিক্ষার্থীদের ওপর বল প্রয়োগ করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

৪৫ বছর বয়সী আলম বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানান, সপ্তাহে তিন দিন বাস চালান তিনি। সকাল ৬টায় বাস নিয়ে বেরিয়ে যান। রাত ১১টা পর্যন্ত এক টানা বাস চালান তিনি। সবুজ ও ছাই রঙের যে বাসটি তিনি চালান সেটির সামনের উইন্ডশিল্ডে চিড় ধরেছে। তিনি বলেন, উইন্ডশিল্ড পাল্টানোর জন্য তিনি বাস মালিককে বলেছিলেন, কিন্তু তিনি ব্যবস্থা করেননি। যে তিনদিন বাস চালান আলম, প্রতিদিন তার ১২০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। যেখানে প্রতিবেশী ভারতের সরকারি পরিবহন সংস্থা দিল্লি ট্রান্সপোর্ট করপোরেশনের চালকরা প্রতিদিন এর তিনগুণ আয় করেন।

বাস চালকদের নির্ধারিত বেতনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলম বলেন, ‘মাসিক বেতনের ব্যবস্থা থাকলে দুশ্চিন্তা ছাড়াই বাস চালানো যায়। নইলে সারাক্ষণ আমাদের কমিশনের কথা ভাবতে হয়।’

তুষার ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির স্বত্বাধিকারী আবুল কাশেমের ১০টি বাস ঢাকার রাস্তায় চলাচল করে। দীর্ঘ কর্মঘণ্টা বা প্রতিযোগিতার মানসিকতা নিয়ে দ্বিমত না থাকলেও তার মতে, চালকদের মাসিক বেতনসহ যেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করার কথা বলা হচ্ছে তাতে বাড়তি ভাড়া গুণতে হবে যাত্রীদের। কিন্তু বাস ভাড়া বৃদ্ধি করা বাংলাদেশে সব সময়ই একটি স্পর্শকাতর বিষয়।

তিনি বলেন, ‘সরকার আমাদেরকে কর্মঘণ্টা কমিয়ে আট ঘণ্টা করতে বললে আমরা তা মেনে চলব। কিন্তু এতে দিনে অন্তত দুই শিফটে বাস চালাতে হবে। আর তাতে ভাড়াও বাড়বে। ফলে যাত্রীরা ক্ষুব্ধ হবেন। সেক্ষেত্রে কি সরকার আমাদের ভর্তুকি দিবে?’

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

5h ago