দুঃখ ঘোচেনি জজ মিয়ার

জজ মিয়া

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার ঘটনার ১৪ বছর পেরিয়ে গেলেও হামলাকারী হিসেবে ফাঁসানো ক্যাসেট বিক্রেতা জজ মিয়ার দুঃখের অবসান হয়নি। সাজানো মামলায় পাঁচ বছর কারাগারে থাকার পর মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু তাকে দেওয়া সরকারের প্রতিশ্রুতি এখনো রয়ে গেছে খাতা কলমেই।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে সন্ত্রাসী হামলায় ২২ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন আড়াই শয়ের বেশি লোক। এ মামলা তদন্তের এক পর্যায়ে পুলিশ জজ মিয়াকে গ্রেপ্তার করে। নির্যাতন চালিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল তাকে। খবরে শিরোনামে উঠে আসে জজ মিয়ার নাম। তবে তার জবানবন্দির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে শুরু থেকেই সন্দেহ ছিল।

সরকার পরিবর্তনের পর ২০০৯ সালে কারাগার থেকে ছাড়া পান জজ মিয়া। কিন্তু ততদিনে জীবন থেকে ঝরে গেছে মূল্যবান পাঁচটি বছর।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে পুনর্বাসনসহ চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এর পর গেছে আরও আট বছর। এখন তার বয়স ৩৭ হয়ে গেলেও প্রতিশ্রুত চাকরির দেখা পাননি জজ মিয়া।

‘আমাকে সবাই ভুলে গেছে। আমি কেমন আছি এটা আর কেউ দেখতে আসে না।‘ ভারাক্রান্ত মনে এই প্রতিবেদককে বলছিলেন জজ মিয়া।

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায় যখন জজ মিয়াকে ফাঁসানো হয় তখন তার বয়স ছিল ২৫ বছর। নোয়াখালীর সেনবাগে ভিটেমাটি থাকলেও গুলিস্তান সিনেমা হলের সামনে পোস্টার ও ক্যাসেট বিক্রি করে কোনোমতে জীবিকা চলত।

তাকে মুক্ত করতে ছয় বছরের আইনি লড়াইয়ে সেই ভিটেমাটিও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিল জজ মিয়ার পরিবার। সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, তাকে মুক্ত করতে তার ভাই, বোন সবাই নিঃস্ব হয়ে গেছে। কারাগার থেকে মুক্তি মিললেও অতি কষ্টে দিন যায় তার।

সাত মাস আগে জজ মিয়ার মা মারা গেছেন। দীর্ঘদিন কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। টাকা ধার নিয়ে মায়ের চিকিৎসা করিয়েছিলেন। সেই টাকা এখনো পরিশোধ করতে পারেননি।

জীবনের ঘুরে দাঁড়ানোরও চেষ্টা করেছিলেন জজ মিয়া। প্রাইভেট গাড়ি চালানো শুরু করেছিলেন তিনি। আড়াই বছর আগে বিয়েও করেন। কিন্তু পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতনে ভেঙে যাওয়া হাড়গুলো জোড়া লাগলেও এখনো যন্ত্রণা দেয় তাকে। ওষুধে ব্যথা কিছুটা উপশম হলেও ভয়াবহ দিনগুলোর স্মৃতি এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে।

গ্রেনেড হামলার প্রকৃত অপরাধীদের রক্ষা করতে ২০০৫ সালের ১০ জুন নোয়াখালীর সেনবাগের বাড়ি থেকে জজ মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের কারণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে থাকা জজ মিয়াকে  প্রথমে সেনবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তাকে ঢাকায় এনে নির্যাতন চালায়।

সে সময়ের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, গ্রেপ্তারের প্রায় এক মাস পর তাকে রাজধানীর দক্ষিণখানে নিয়ে গিয়ে ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। তারা বলে, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ স্বীকার করে নিলে লাভবান হবে সে।

কয়েকদিন পর মগবাজারে নিয়ে গিয়ে হাতকড়া খুলে দিয়ে তাকে দৌড়াতে বলে পুলিশ। পেছন থেকে  গুলি করা হতে পারে ভেবে পুলিশের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চায় সে। বিনিময়ে তাকে যা করতে বলা হবে তার সবই করতে রাজি থাকার কথা বলে সে।

এর পর প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে তাকে স্বীকারোক্তিমূলক একটি জবানবন্দি মুখস্থ করানো হয়।

১৯৯৬ সালের একটি বিস্ফোরণ মামলায় জজ মিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়। এই মামলায় এর আগে জামিনে ছিল সে।

প্রায় ছয় মাস পর কারা কর্তৃপক্ষ থেকে জজ মিয়াকে জানানো হয়, বিস্ফোরক মামলায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। ততদিনে ওই মামলার অন্য আসামিরা সবাই মারা যান।

এর আগে এক সাক্ষাৎকারে জজ মিয়া বলেছিলেন, মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিলে তাকে বিদেশে পাঠিয়ে তার পরিবারের ব্যয়ভার সামলানোর জন্য টাকা দেওয়া হবে। প্রতি মাসে জজ মিয়ার মাকে দুই থেকে আড়াই হাজার করে টাকাও দেয় পুলিশ। তবে এক পর্যায়ে টাকা দেওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জজ মিয়ার পরিবার পুরো ঘটনাটি ফাঁস করে দেয়।

২০০৮ সালের ১১ জুন গ্রেনেড হামলা মামলায় হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ২২ জনের নামে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। অভিযোগপত্রে হামলার পরিকল্পনার সঙ্গে কিছু সরকারি ও নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত দেওয়া হয়।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর গ্রেনেড সরবরাহকারীদের খুঁজে বের করার জন্য ২০০৯ সালের ২২ জুন বাড়তি তদন্তের জন্য আদালতে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। সে বছরই ৩ আগস্ট সিআইডির নতুন কর্মকর্তাদের যুক্ত করে তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত।

Comments

The Daily Star  | English

'March to Jamuna': Police charge baton to disperse JnU students

At least 25 students were taken to DMCH after suffering injuries from baton charges or falling ill due to tear gas inhalation

19m ago