সংসদ বহাল, ইভিএম ও নির্বাচন কমিশন
নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, তা অজানা নয়। নির্বাচনের সময় সংসদ বহাল থাকবে, সেটাও জানা। জানা বিষয়গুলো নিয়ে রাজনীতিতে আলোচনা তর্ক-বিতর্ক চলছে। এর সঙ্গে নতুন বিতর্ক যুক্ত হয়েছে ‘ইভিএম’। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন নিয়ে কিছু কথা।
১. অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, আগামী ২০ দিনের মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হতে পারে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে ২৭ ডিসেম্বর। সরকারের বিষয়ে তিনি কথা বলতেই পারেন। কিন্তু নির্বাচন কবে হবে, তা বলার বা ঘোষণা দেওয়ার একমাত্র এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের। সুনির্দিষ্ট কোন তারিখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, নির্বাচন কমিশন তা এখনো বলেনি। নির্বাচন কমিশনের আগে তা বললেন অর্থমন্ত্রী।
সাধারণভাবে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনগুলো সম্পর্কে ধারণা থাকে এমন যে, তারা সরকারের পরামর্শ বা নির্দেশনা অনুযায়ী চলে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নির্বাচন কমিশনকেই সংবিধান সুনির্দিষ্ট করে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে (ক্ষমতাসীন দলসহ) দিক নির্দেশনা দেওয়ার এখতিয়ার আছে নির্বাচন কমিশনের। বাস্তবে দেখা যায়, রাজনৈতিক দল বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের আকার- ইঙ্গিত বা নির্দেশনার দিকে তাকিয়ে থাকে নির্বাচন কমিশন। শুধু বর্তমান কমিশন নয়, অতীতের প্রায় সবগুলো কমিশনের ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা বা বক্তব্যের প্রেক্ষিতে জনমানুষের সেই ধারণা আরও দৃঢ় হতে পারে।
২. নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, সংবিধানে তা লেখা নেই। বর্তমান সরকারের রূপ সম্পূর্ণ এমন থাকা অবস্থাতে নির্বাচন হতে পারে। সরকারের আকার ছোট বা বড়ও হতে পারে। যা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছের ওপর। সেই ইচ্ছের অংশ হিসেবেই, সরকারের আকার ছোট করে আনা হতে পারে বা হবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই থাকবেন সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী। রুটিন কাজ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা নয়।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছে এমন দলের সংসদ সদস্যদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। সংসদে না থাকায় বিএনপির সেই সরকারে থাকার সুযোগ নেই। যদিও সংসদ সদস্য নন এমন ব্যক্তিকেও সংবিধান অনুযায়ী মন্ত্রী করার সুযোগ আছে। বহু নজীর আছে।
৩. সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় নির্বাচন, খুব গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি প্রসঙ্গ।
পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী বর্তমান সংসদ থাকা অবস্থাতেই আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বর্তমান এমপিরা এমপি পদে থেকেই এমপি নির্বাচনে অংশ নেবেন। সবার জন্যে সমান সুযোগ সৃষ্টির বিষয়টি কেমন হবে, তা ব্যাখ্যা না করলেও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
প্রশাসন ‘এমপি’র কথা শুনবেন, না তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাধারণ একজন প্রার্থীর কথা শুনবেন? গত ৮ এপ্রিল পিআইবির একটি অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, নির্বাচনের সময় সংসদ বহাল থাকলে আচরণবিধিতে কিছু সংযোজন করে এমপিদের ক্ষমতার জায়গা খর্ব করবেন কিনা? এই প্রশ্নের উত্তরে সিইসি বলেছিলেন, ‘ভালো প্রশ্ন করেছেন। আমরা অবশ্যই এটা ভেবে দেখব’।
এই কয়েক মাসে বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশন কী ভেবেছে, তা জানা যায়নি।
এমনকি বিষয়টি নিয়ে আর কোনো কথাও বলেনি নির্বাচন কমিশন।
বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, এমপিরা এমপি পদে থাকলেও তাদের কোনো ক্ষমতা থাকবে না। সংসদ অধিবেশন বা কার্যক্রমও চলবে না।
সংসদ সদস্যদের এখন যে ক্ষমতা আছে, যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর তা থাকবে না, সংবিধানে এমন কোনো কিছু লেখা নেই। নির্বাচন কমিশন আচরণবিধিতেও ‘সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা থাকবে না’ এমন কোনো বিধান সংযোজন করেনি। সুতরাং ‘ক্ষমতা থাকবে না’- এটা একটি রাজনৈতিক বক্তব্য ছাড়া আর কিছু নয়। সংসদ অধিবেশন যদি নাও চলে, তফসিল ঘোষণার পরও সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা একটুও কমবে না। গত সংসদের কার্যক্রম বিবেচনায় নিলে যদিও দেখা যায়, তফসিল ঘোষণার পরও অধিবেশন চলেছিল। নির্বাচন হয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। সংসদ অধিবেশন চলেছিল ২০১৩ সালের ২০ নভেম্বর পর্যন্ত ।
একজন এমপি পদে থেকে আবার এমপি নির্বাচন করবেন কিন্তু এমপির ক্ষমতা ব্যবহার করবেন না, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তা বিশ্বাসযোগ্য? এমন ‘মহানুভবতা’ বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগ কতটা আছে বা থাকবে?
৪. এবার আসি ইভিএম প্রসঙ্গে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ বছরের ৮ এপ্রিল পিআইবির অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা নেই। পরেও তা একাধিকবার বলেছেন। হঠাৎ করে গত ২৯ আগস্ট নির্বাচন কমিশনের সচিব ঘোষণা দিলেন ‘রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলে, ১০০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করা যেতে পারে।’
এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে পূর্বের অবস্থানের সঙ্গে বর্তমানের অবস্থানের বড় একটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হলো। বেশ কিছু প্রসঙ্গ সামনে এলো। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার এক মাসেরও কম সময় হাতে রেখে নির্বাচন কমিশন ইভিএম ব্যবহারের জন্যে অবিশ্বাস্য রকমের দ্রুতগতিতে তৎপর হয়ে উঠল। একজন নির্বাচন কমিশনার এই তাড়াহুড়োর বিরোধিতা করলেও, ইভিএম ব্যবহারের জন্যে আরপিও সংশোধন করার প্রস্তাব দিলো নির্বাচন কমিশন। এক্ষেত্রে অস্বচ্ছ কয়েকটি প্রসঙ্গ-
ক. ‘দেড় লাখ ইভিএম কেনার একটি প্রকল্প পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে’- নির্বাচন কমিশন সচিব একথা বললেন ২৯ আগস্ট ২০১৮।
খ. এর দুইদিন পর প্রথম আলো অনুসন্ধান করে বের করল, ইভিএম কেনার প্রকল্প যাচাই বাছাই, মূল্যায়ন- অনুমোদন, কোনো কিছুই হয়নি। কিন্তু জুলাই মাসে ইভিএম আমদানির জন্যে ট্রাস্ট ব্যাংক প্রায় ৮০০ কোটি টাকার এলসি খুলেছে।
গ. নির্বাচন কমিশন সচিব বললেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলে ইভিএম ব্যবহার করা হবে।’ এর আগে পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন বারবার বলে আসছিল, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আর কোনো আলোচনা করবে না নির্বাচন কমিশন।
তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নির্বাচন কমিশন বুঝবে কীভাবে? গণমাধ্যমে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর যে মতামত দৃশ্যমান হচ্ছে, তা বিবেচনায় নিলে তো আরপিও সংশোধনীর প্রসঙ্গই আসার কথা ছিল না।
ঘ. ইভিএম নিয়ে তাড়াহুড়া না করা বিষয়ক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর নির্বাচন কমিশনের সুর নরম বলে পরিলক্ষিত হচ্ছিল। এরমধ্যেই আবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, সরকার এ সংসদ চাইলে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। ‘সরকার ও সংসদ’- তো একই বিষয়। অর্থাৎ বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত বিবেচনায় নেওয়ার কথা ভাবছে না নির্বাচন কমিশন।
ঙ. ‘পৃথিবীর বহু দেশে ইভিএম ব্যবহৃত হয়’- নির্বাচন কমিশনের যুক্তি। পৃথিবীর বহু দেশে ইভিএম ব্যবহার হয় না, বক্তব্যে তা উল্লেখ করেনি নির্বাচন কমিশন। ইউরোপের বড় দেশ জার্মানি, নেদারল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স আরও অনেক দেশ ইভিএম ব্যবহার করে না। জার্মানির সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারকে ‘অসাংবিধানিক’ হিসেবে আদেশ দিয়েছেন। জার্মানিসহ ইউরোপের বড় দেশগুলো ইভিএম ব্যবহার শুরু করে ‘নির্ভরযোগ্য’ নয় বিবেচনায় আবার বাদ দিয়ে ব্যালটে ফিরে গেছে। আমেরিকার কিছু রাজ্যে স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হয়, সর্বত্র নয়।
চ. ইভিএম ব্যবহারের সবচেয়ে বড় উদাহরণ ভারত। ভারত ইভিএম ব্যবহারের জন্যে প্রায় ২০ বছর নানা রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। স্থানীয় নির্বাচনে ব্যবহার করে, অভিজ্ঞ ও সংশোধিত হয়ে জাতীয় নির্বাচনে ব্যবহার শুরু করেছে।
প্রথমদিকে ভোটার ইভিএমে ভোট দিলে বুঝতে পারতেন না, কোন মার্কায় তিনি ভোট দিলেন। বর্তমানে ভারত এর একটা সমাধান বের করেছে। ভোট দেয়ার পর এটিএম মেশিনের মতো এখনকার ইভিএম থেকে একটি কাগজ বের হয়। তা থেকে ভোটার নিশ্চিত হতে পারেন যে, তিনি কোথায় বা কাকে ভোট দিলেন। এখনও ভারত খুব কম জায়গায় এমন ইভিএম চালু করতে পেরেছে। তারপরও এবছর ভারতের সকল বিরোধীদল ইভিএমের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
ছ. শামসুল হুদা কমিশনের সময় প্রথম ইভিএম ব্যবহারের প্রসঙ্গ আসে। তখন বুয়েটের দুজন বিশেষজ্ঞ ইভিএম নিয়ে কাজ করেছিলেন। এখন তড়িঘড়ি করে ইভিএম কেনার সঙ্গে বুয়েটকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। যাচাই করে দেখা হয়নি, যে ইভিএম কেনা হবে, তা কতটা আধুনিক। যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে এনে দেশের মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি তা সংযোজন করবে। প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা খরচ করে কোন মানের মেশিন শেষ পর্যন্ত প্রস্তুত হবে, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন থাকছেই। নির্বাচন কমিশনেরও ইভিএম বিষয়ে ধারণা খুবই কম। অভিজ্ঞ লোকবল, প্রযুক্তিবিদ তো নেই-ই। কিন্তু ইভিএম কেনার ক্ষেত্রে আগ্রহের মাত্রা বিস্ময়কর রকমের বেশি।
৫. ‘নির্বাচন বানচাল করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে’ ‘প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে’- এমন কথা সরকারের মন্ত্রীরাও বলছেন। প্রশ্ন হলো বানচাল বা প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র কে করছেন, কারা করছেন? এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ভোটারদের আস্থায় আনার দায়িত্ব ছিল নির্বাচন কমিশনের। উল্টো ইভিএম প্রসঙ্গ সামনে এনে নতুন করে জটিলতা তৈরি করছে নির্বাচন কমিশন। ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়’-প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এমন বক্তব্যে জনআস্থাহীনতা প্রবল হয়ে উঠছে। ভোটারদের আস্থাহীন একটি নির্বাচন কমিশনের পক্ষে, দলীয় সরকারের অধীনে- সংসদ বহাল থাকা অবস্থায়, সুষ্ঠু- গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব, তা বিশ্বাস করা কঠিন।
তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, নির্বাচন কমিশনের আচরণে কি দৃশ্যমান হচ্ছে যে তারা দৃঢ়তার সঙ্গে নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে একটি সুষ্ঠু- গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে চান?
Comments