আরও একটি মৃত্যু ও ‘সব দাবি মেনে নেওয়া’ প্রসঙ্গ

bike crash
ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের জাহাঙ্গীর গেটের কাছে বাসচাপায় প্রাণ হারিয়েছেন ৭১ টিভির একজন কর্মকর্তা। ছবি: সংগৃহীত

‘সব দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে’, ‘চোখ খুলে দিয়েছে’, ‘বিবেক-বোধ জাগ্রত করেছে’- কথাগুলো খুব বেশিদিন আগের নয়। নিশ্চয়ই সবারই স্মরণে আছে। স্কুল শিক্ষার্থী শিশু-কিশোরদের প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে কথাগুলো এসেছিল ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে।

গতকাল (২৯ সেপ্টেম্বর) বাস চাপা দিয়ে আরও একজন মোটরসাইকেল চালককে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার চালক একাত্তর টেলিভিশনের একজন কর্মী। মোটরসাইকেল চাপা দেওয়া বাসের ছবি ছাপা হয়েছে আজকের প্রায় সব পত্রিকায়। দেখানো হয়েছে টেলিভিশনগুলোর সংবাদে।

একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক ‘চোখ খুলে দেওয়া’-র পর পরিস্থিতিটা কেমন হয়েছে।

১. রাস্তায় পুলিশ বিশেষ করে ট্রাফিক সার্জেন্টরা অনেক তৎপর হয়েছেন। অর্থের বিনিময়ে তারা কাউকে ছাড় দিচ্ছেন, ঢাকার রাস্তায় এমন দৃশ্য চোখে পড়ছে না। তারা মূলত দেখছেন মোটরসাইকেল চালকদের লাইসেন্স, চালক-যাত্রী হেলমেট পরেছেন কিনা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাইভেট গাড়ির চালকের লাইসেন্স ও কাগজপত্রও পরীক্ষা করছেন। মামলা-জরিমানার সংখ্যা-পরিমাণ অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে।

২. মহাখালীতে যে বাসটি মোটরসাইকেলের উপর তুলে দিয়ে হত্যা করল, সেই বাসের কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। নেই চালকের লাইসেন্স। বাসের পুরো শরীর ক্ষত-বিক্ষত। শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল, এসব বাস রাস্তায় চলতে পারবে না, এমন চালকরা বাস চালাতে পারবে না। ‘সব দাবি মেনে নিলাম’ বললেও বাস্তবে এক্ষেত্রে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা বা উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

ভাঙা-চোরা ফিটনেসবিহীন যেসব বাস আগেও রাস্তায় চলত, চলেনি শুধু আন্দোলনের কয়েক দিন। তারপর আবার চলতে শুরু করেছে। ফিটনেসবিহীন কিছু গাড়ি এবড়ো-থেবড়ো রঙ করে রাস্তায় নামানো হয়েছে।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী বা জনমানুষের চোখে ধুলো নয়, যেন ‘রঙ’ দেওয়া হলো।

৩. ঢাকার রাস্তায় অন্যতম জঞ্জাল যে পরিবহনটি তার নাম ‘লেগুনা’। যেসব রাস্তায় বাস চলে না, সেসব রাস্তায় চলার অনুমতি নিয়ে লেগুনা চালু করা হয়েছে। সেসব রাস্তায় লেগুনা চলে না, চলার অনুমতি নেই যেসব রাস্তায় চলার অর্থাৎ মূল রাস্তায়। প্রতিটি লেগুনা প্রতিদিন ৭০০ টাকা চাঁদা দিয়ে, কোনো নিয়ম-নীতি না মেনে সবার সামনে দিয়ে চলে। ঢাকায় অবৈধ এই পরিবহন লেগুনার সংখ্যা ১০ হাজারের উপরে। মোট চাঁদার পরিমাণ অংক করে দেখতে পারেন।

ঢাকার পুলিশ কমিশনার ঘোষণা দিলেন ‘অবৈধ লেগুনা’ চলতে দেওয়া হবে না। একদিন বন্ধ থাকল। পরের দিন লেগুনা মালিকদের সঙ্গে মিটিং হলো পুলিশের। তার পরের দিন থেকে আবার লেগুনা চলতে শুরু করল। চালক সেই বারো-চৌদ্দ বছরের শিশু-কিশোররা এখন আরও বেপরোয়া।

লেগুনা বন্ধের ঘোষণা এবং চালু করার প্রেক্ষাপটটা বেশ কৌতুককর। লেগুনার উপর প্রচুর সংখ্যক যাত্রী নির্ভরশীল। বন্ধ হওয়ায় তারা বিপদে পড়লেন। ‘কেন লেগুনা বন্ধ’, ‘কীভাবে যাতায়াত করব’- যৌক্তিকভাবেই যাত্রীদের ক্ষোভের বিষয়টি সামনে এলো।

লেগুনার উপর কত যাত্রী নির্ভরশীল, তাদের জন্যে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা, তা ভাবা হলো না বন্ধ ঘোষণা দেওয়ার আগে।

বিআরটিসির হাজার দেড়েক বাস আছে। সব সময় পাঁচ-ছয়’শ বাস বিকল থাকে। এটা কাগজের হিসাব, বাস্তবে বিকলের সংখ্যা আরও বেশি। কিছু বাস বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে লিজ দিয়ে রাখা হয়েছে। অথচ জনগণের অর্থে এসব বাস কেনা হয়েছে গণপরিবহনের জন্যে। প্রতিষ্ঠানগুলো লিজ নেওয়া বিআরটিসির বাসে সকালে তাদের কর্মীদের অফিসে আনে, বিকেলে বাসায় পৌঁছে দেয়। বাসগুলো সারাদিন অলস বসে থাকে। বিআরটিসির কিছু বাস লিজ নিয়ে রাস্তায়ও চালানো হয়। লিজ প্রথা বিলুপ্ত করে, সারাদিন বসে থাকা বাসগুলো যদি লেগুনার রুটগুলোতে চালানোর উদ্যোগ নেওয়া যেতো, হয়ত জনদুর্ভোগ অনেকটাই কমানো সম্ভব ছিল। বিকল বাসগুলো মেরামতের উদ্যোগ নিলেও সুফল মিলতে পারত। সেভাবে ভাবা হয়নি। মেরামতের চেয়ে কর্তাদের আগ্রহ নতুন বাস কেনার প্রতি।

বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যে দেশ পৃথিবী বিখ্যাত ৫০টি দোতলা ভোলবো বাস ডিপোতে বছরের পর বছর ফেলে রাখছে এই যুক্তিতে যে, মেরামত ব্যয় বেশি! নতুন কিনছে প্লাস্টিক-টিন বডির বাস।

লেগুনা নির্ভর যাত্রী দুর্ভোগের একটা পরিস্থিতিই সম্ভবত তৈরি করতে চাওয়া হয়েছিল। বিষয়টি এমন যে বন্ধ করে দিয়েছিলাম, চাপে পড়ে মানুষের সুবিধার জন্যেই তো আবার চলার অনুমতি দেওয়া হলো! গণপরিবহনের নৈরাজ্য বেশ পরিকল্পিতভাবেই টিকিয়ে রাখা হয়েছে।

৪. সড়কের মন্ত্রী, দলেরও সাধারণ সম্পাদক। গত নয় বছরে সড়ক-মহাসড়ক উন্নয়ন- রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা। অথচ বাংলাদেশের কোন সড়কটি ভালো, তা খুঁজে বের করার জন্যে গবেষণা করতে হবে।

সামনে নির্বাচন। নিজ দল চাঙ্গা ও বিরোধী দল মোকাবিলায় সড়কমন্ত্রী এখন সারাদেশ ঘুরছেন। পদ্মা সেতুর নামকরণ, নির্বাচন-রাজনীতি নিয়ে কথা বলছেন। ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চললে, লাইসেন্সবিহীন চালকরা তা চালালে, সেই চালক বাসচাপা দিয়ে মোটরসাইকেল চালক বা সাধারণ মানুষ হত্যা করলে কী করবেন, সে বিষয়ক কোনো বক্তব্য তার মুখ থেকে শোনা যায়নি।

তিনি বলেছিলেন, সড়ক নিরাপত্তা আইন পাস হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সেই আইন সংসদে পাসও হয়েছে।

৫. আশা জাগানো সেই আন্দোলন বাস্তবে সড়ক নিরাপত্তায় কোনো ভূমিকা রাখতে পারল না। পুরো আন্দোলনটিকে ‘বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র’, ‘গুজব’ হিসেবে পরিচিতি দেওয়ার একটা প্রাণান্তকর চেষ্টা লক্ষ্য করা গেল। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ‘জেল-রিমান্ড’-এর মতো নির্দয় আচরণ দৃশ্যমান হলো। তারা জেল থেকে মুক্তি পেলেও মামলা এখনও চলছে। রাবার বুলেট ও স্প্লিন্টারে ক্ষত-বিক্ষত শরীর নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজীবুল চিকিৎসার জন্যে সহায়তা চাইছেন জনমানুষের কাছে। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পা ভেঙে দেওয়া তরিকুলকে অ্যাম্বুলেন্সে এসে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে, হাসপাতালে পরীক্ষার অনুমতি মিলছে না। আন্দোলনের পক্ষে কথা বলায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে জেলে পাঠানো হয়েছে। জামিন হচ্ছে না আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের।

বাসচাপা দিয়ে হত্যার শাস্তি তিন থেকে পাঁচ বছরের জেল হলেও, কথা বলা বা লেখার শাস্তি ১৪ বছরের জেল ও ২৫ লাখ টাকা জরিমানার আইন করা হচ্ছে!

৭. হত্যাকাণ্ডের শিকার মোটরসাইকেল চালক আনোয়ার যেহেতু একটি টেলিভিশনের কর্মী, সে কারণে আমরা হয়তো একটু বেশি আলোচনা করছি। সারাদেশে এমন আনোয়াররা বাস-ট্রাকের চাপায় প্রতিদিন জীবন হারাচ্ছেন। তাদের নিয়ে আলোচনাও হয় না।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিশু-কিশোরদের অভিনব চিন্তাকর্ষক স্লোগান ও দিকনির্দেশনামূলক আন্দোলনকে শুধুমাত্র ‘গুজব’-এর নিচে চাপা দিয়ে দেওয়ার একটা প্রক্রিয়ায় আমরা কি অংশগ্রহণ করিনি? কোথায় গেল সেই বড়-চাপাতিধারী হেলমেট বাহিনী, যারা শিশু-শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করল!

তদন্ত-বিচার-শাস্তির যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে শিশু-কিশোরদের ঘরে ফেরত পাঠালেন, তারা কী ভাবছেন- কী ভাবলেন আপনাদের বিষয়ে? কিছুতেই কিছু যায়-আসে না, তাই না!

Comments

The Daily Star  | English

Depositors leave troubled banks for stronger rivals

Depositors, in times of financial uncertainty, usually move their money away from troubled banks to institutions with stronger balance sheets. That is exactly what unfolded in 2024, when 11 banks collectively lost Tk 23,700 crore in deposits.

10h ago