কোটা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানাই: আকবর আলি খান
ড. আকবর আলি খান সাবেক সচিব। অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, লেখক- গবেষক হিসেবেও তিনি পরিচিত। ১৯৭১ সালে চাকরিরত অবস্থাতেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তার অনুপস্থিতিতে পাকিস্তান সরকার বিচার করে তাকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কোটা সংস্কার বিষয়ে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ড. আকবর আলি খান কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের সঙ্গে।
প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা তুলে দেওয়ার বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
আকবর আলি খান: বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে কোনো চিরস্থায়ী কোটা রাখা সম্ভব নয়। কোটা প্রবর্তন করলে সেটাকে মূল্যায়ন করে দেখতে হবে যে, উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে কি না। প্রয়োজন পড়লে সরকার এটার সময় বাড়াতে পারে এবং কমাতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে কোটা প্রবর্তনের পর ৪৬ বছর ধরে সরকার এটার কোনো পর্যালোচনা করেনি। তবে সম্প্রতি সরকার যে সচিব কমিটি গঠন করেছিল তারা পর্যালোচনা করেছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই কি কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
আকবর আলি খান: কোটা নিয়ে অনেকেই কাজ করেছেন। বাংলাদেশের প্রথম প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী বলেছিলেন, কোনো কোটার প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশে শক্তিশালী প্রশাসনের প্রয়োজন রয়েছে। সুতরাং তার কমিশন কোনো কোটার সুপারিশ করেনি। বিএনপির আমলে পাকিস্তানের প্রাক্তন সচিব আব্দুর রশিদের নেতৃত্বে একটি কমিটি হয়। সেই কমিটিও বলেছে, কোটার কোনো প্রয়োজন নেই। তারপর এটিএম শামসুল হকের নেতৃত্বে একটি কমিটি হয়। সেই কমিটি জেলা কোটা তুলে দেওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট সুপারিশ করেছিল এবং অন্য কোটা রাখলেও সেটাকে পুনর্বিবেচনা করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল।
বাংলাদেশে যে তিনটি প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন করা হয়েছিল, তিনটি কমিশনই কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের কথা বলেছিলেন। কিন্তু গত ৪৬ বছর ধরে কোটা সংস্কার করতে গেলে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেই ভয়ে কোনো সরকার এটাতে হাত দেয়নি। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের তরুণ ছাত্র সমাজ এই কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এগিয়ে আসে এবং তার ফলে দেশে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে, সরকার বাধ্য হয়ে কোটা বাতিল করেছে।
একবারে কোটা তুলে দেওয়াই কি সমাধান?
আকবর আলি খান: কোটা তুলে দেওয়া যেতে পারে, যেটি আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এখন চূড়ান্ত লক্ষ্যে পাঁচ বছর না দশ বছরে পৌঁছানো যাবে তা ভিন্ন ব্যাপার। আর একটি হলো যে, পাঁচ বছর পরপর পর্যালোচনা করে ধাপে ধাপে কোটার সংস্কার করা যায়। আমি যে প্রতিবেদন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের জন্য রেখেছিলাম, সেখানে আমি সংস্কার করার কথা বলেছিলাম। কিন্তু ওই রিপোর্টের সিদ্ধান্ত ছিল- চূড়ান্তভাবে কোটা থাকবে না। দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কোটা একেবারে তুলে দেওয়া হলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে, সেই জন্য তদানিন্তন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে আমি এই প্রতিবেদন দিয়েছিলাম। সরকার এখন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন করেছে, কোটা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানাই।
কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, আপনি যে ধরনের ব্যবস্থাই প্রবর্তন করেন না কেন, কিছু লোক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তারা আন্দোলন করবে। সরকারের সামনে আরও উপায় ছিল, কিন্তু সরকার সে পথে না হেঁটে সোজা ১৯৭৩ সালের সংস্কার কমিশন যে প্রতিবেদন দিয়েছে এবং বর্তমান সচিব কমিটিও এটাকে সমর্থন করেছে, সেজন্য এটা করা হয়েছে।
প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা তুলে দেওয়া হলেও, তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে কোটা রাখা হয়েছে। এ বিষয়টিকে আপনি কতটুকু যুক্তিযুক্ত মনে করেন?
আকবর আলি খান: তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে কোটা রাখা হয়েছে। কারণ এসব স্তরের চাকরিতে মেধা নির্ধারণ করা অনেক শক্ত। কাজেই এই ধরণের অদক্ষ চাকরিতে কোটা রাখা যেতে পারে। তবুও বিদ্যমান কোটাগুলিকে পর্যালোচনা করা উচিত। কাজ হচ্ছে কি না, কোনটা বাড়ানো বা কমানোর প্রয়োজন আছে কি না- একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর পর্যালোচনায় করা জরুরি।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, নারী এবং অনুন্নত জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা সংবিধান-স্বীকৃত অধিকারের আওতায় পড়ে কি না?
আকবর আলি খান: এটা সাংবিধানিক অধিকার নয়। মেধার নীতি থেকে বিচ্যুতির জন্য সরকারকে এই অধিকার দেওয়া হয়েছে। এটা নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার নয়, সরকারের অধিকার। ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী তো গত ৩০ বছর ধরে কোটা ভোগ করেছে, এখন পর্যালোচনা করে দেখা হোক, এটাতে লাভ হয়েছে না ক্ষতি হয়েছে এবং এটার দরকার রয়েছে কি না। কোটা ব্যবস্থা কোনো চিরন্তন ব্যবস্থা নয়। কাজেই সরকার যদি মনে করে তাদের জন্যে কোটা রাখা উচিত তাহলে আবার তা চালু করতে পারে।
প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো কোটাই নেই এখন। এক শতাংশ ঐচ্ছিক কোটা যাও আছে তা অর্থহীন। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য সবার আগে যা দরকার তা হল- সরকারি চাকরির জন্য শারীরিক যোগ্যতার যে মাপকাঠি নির্দিষ্ট করা আছে তা শিথিল করা। প্রথম কাজটি হলো- প্রতিটি ক্যাডারে দেখতে হবে যে, এখানে প্রতিবন্ধীরা কাজ করতে পারে কি না। করলে কতটুকু পারবে। কিন্তু সেই যোগ্যতাগুলি নির্ধারণ করার কাজ এখনো হয়নি। এটা হওয়ার পরে সরকার যদি প্রয়োজন মনে করে তাহলে প্রতিবন্ধী কোটাও রাখতে পারে। কিন্তু এক শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা একটি প্রহসন।
সফল আন্দোলন করতে পারলে, কোটা সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহালের জন্য মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডসহ কয়েকটি সংগঠনের সদস্যরা শাহবাগে রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন করছে, বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?
আকবর আলি খান: যে বা যারাই আন্দোলন করুক না কেন, রাস্তার মিছিলের ভিত্তিতে সরকার এই সিদ্ধান্ত নেয়নি। সরকার হুট করেই কোটা বাতিল না করে বিষয়টি নিয়ে অনেক বিচার বিশ্লেষণ করেছে, সচিব কমিটি করেছে, তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুতরাং আমি মনে করি এটা সরকারের বিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্ত। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কোটা আসলে ফের কোটাবিরোধী আন্দোলন প্রবল হবে। সুতরাং বারবার আন্দোলন করলেই সরকার তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে বলে আমি মনে করি না।
Comments