ওসমান ও হিরু নৌমন্ত্রীর অনুসারী, তারা চান না চালকরা প্রশিক্ষিত হোক: ইলিয়াস কাঞ্চন
ইলিয়াস কাঞ্চন নায়ক হিসেবে সুপরিচিত হলেও, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করছেন অনেক বছর ধরে। প্রায়ই তাকে পরিবহন মালিক- শ্রমিকদের রোষানলে পড়তে হয়। সম্প্রতি তাকে বাস টর্মিনালগুলোতে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন ইলিয়াস কাঞ্চন।
দেশের সব বাস টার্মিনাল থেকে আপনাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। কারা অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছে?
ইলিয়াস কাঞ্চন: গত রোববার ফুলবাড়িয়াতে পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ একটি সমাবেশ করেছে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী, একই সংগঠনের সহ-সভাপতি ছাদেকুর রহমান হিরুসহ পরিবহন খাতের অন্যান্য নেতারা। হিরুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সমাবেশ থেকেই আমাকে অবাঞ্ছিতের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
আপনাকে কেন অবাঞ্ছিত করা হল?
ইলিয়াস কাঞ্চন: চালকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য আমরা তাদের একদিনের প্রশিক্ষণ দেওয়ার চিন্তা করেছিলাম। সেই কারণে অনেকগুলো টার্মিনালের পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের আমরা অনুরোধ করেছিলাম যে, সামনে ২২ অক্টোবর আমরা চালকদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে চাই। তারা বলেছিলেন অনুমতির ব্যাপারে আমাকে জানাবেন। কিন্তু তা না করেই তারা আমাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করলেন।
ওসমান আলী ও ছাদেকুর রহমান হিরু নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের অনুসারী। তারা কেউই চান না যে চালকরা দক্ষ ও প্রশিক্ষিত হোক। তারা যেটা চান তা হল- যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলুক। চালকরা দুর্ঘটনা ঘটাবে, এদের কোনো বিচার করা যাবে না।
কারণ পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতারা দেখেছেন যে, আইন নিয়ে কথাবার্তা যা কিছু হয়েছে, সেক্ষেত্রে আমিই একমাত্র মুখ খুলেছি। সংসদীয় কমিটির সঙ্গে আমিই বসেছি। সেই কারণে পরিবহন সেক্টরে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা আমাকে সমস্যা হিসেবে মনে করছেন।
যারা সড়ক পরিবহন আইনের বিরোধিতা করছেন, তারা ভালো করেই জানেন যে- তাদের জন্যই দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলোকে তারাই রাস্তাঘাটে নামিয়েছেন। তাদের ব্যবস্থাপনা অদক্ষ। চালকদের দক্ষতা ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। দুর্ঘটনা রোধে নেতারা চালকদের প্রশিক্ষিত ও দক্ষ না করে, আইন যেন তাদের ওপর প্রয়োগ না হয় সেটিই চাইছেন। কেউ অন্যায় করবে কিন্তু শাস্তি পাবে না- পৃথিবীর কোথাও বোধহয় এমন নিয়ম নেই।
পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের নেতাদের এই ঘোষণা আপনাকে বিচলিত করে?
ইলিয়াস কাঞ্চন: এ রকম হুমকি এটিই প্রথম নয়। স্কুলের বাচ্চাদের আন্দোলনের সময়ও ঢাকার যাত্রাবাড়ী ও খুলনায় আমার ছবি পুড়িয়েছে পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। ২০১২ সালেও শহীদ মিনারে বিশাল সমাবেশ ডেকে আমার ছবিতে জুতার মালা পরিয়েছিল তারা। পরে ছবিতে আগুনও দিয়েছে। এতে কী আসে যায়। আমি ভীত বা বিচলিত কোনোটাই নই। আমার কাজ আমি করে যাবই।
আমি তো তাদের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করছি না। আমি কাজ করছি সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে এবং তা কিভাবে রোধ করা যায় সেজন্য। সে কারণে যেখানে আইনের কথা বলা দরকার, আমি বলছি। কারণ আইন ছাড়া তো সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়।
আপনি ও আপনার পরিচালিত সংগঠন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) তো বাসচালক ও সহযোগীদের সচেতনতায় কাজ করছে, পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের এমন কথার কারণে কি আপনাদের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে?
ইলিয়াস কাঞ্চন: আমরা এসব হুমকিতে ভয় পাই না। এতে আমাদের কাজ বাধাগ্রস্ত হবে না। নিসচা আগের মতোই তার কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। এখন পরিষদের নেতারা যদি চালকদের প্রশিক্ষিত করতে না চান, তাহলে আমাদের একটি উদ্যোগ হয়তো বাধাপ্রাপ্ত হবে। শুধু চালকদের প্রশিক্ষণটিই মুখ্য নয়, পথচারী, যাত্রী, সাধারণ মানুষ এবং সরকার সবাইকে নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। চালকেরা যদি প্রশিক্ষিত হতে না চান, বিরোধিতা করেন, তাহলে আমরা বাকি জায়গাগুলোতে কাজ করব।
সম্প্রতি পাস হওয়া সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের জন্য সাত দফা দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
ইলিয়াস কাঞ্চন: আমার মনে হয়েছে, এ ব্যাপারে আমার চেয়ে বেশি চিন্তিত থাকা উচিত সরকারের। সরকারের মধ্য থেকেই তারা আমাকে অবাঞ্ছিত করেছে। সরকারের মধ্যে যারা আছেন, তাদের যে ফেডারেশন, তারাই এই কাজগুলো করছেন। সরকার এই ধরনের লোককে মন্ত্রিপরিষদে রাখে কারণ তারা সরকারকে বোঝাচ্ছে তারা নাকি দুই কোটি ভোটার, কিন্তু বাকি আট কোটি ভোটার তো বাকি থাকল। তাহলে এই আট কোটি ভোটারের কথা চিন্তা করবে সরকার, নাকি তথাকথিত দুই কোটি ভোটারের কথা ভাববে সেটি সরকারের সিদ্ধান্ত।
সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের জন্য সরকারকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। অন্যথায় ১৩ অক্টোবর থেকে সারাদেশে লাগাতার পরিবহন ধর্মঘটের হুশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। আপনার কি মনে হয় আইনটি সংশোধন করা উচিত সরকারের?
ইলিয়াস কাঞ্চন: পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ সবসময় তাই করে আসছে। এরা সরকারের দুর্বল মুহূর্তগুলোতে আঘাত করে করে দাবি আদায় করে নিচ্ছে। ১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের আমলে সড়ক দুর্ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান ছিল। এরশাদ সরকারের পতনের সময়েও এই পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ আন্দোলন করে তিন বছরের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রেখে আইনটি পরিবর্তন করতে বাধ্য করে। যখনই নির্বাচন ঘনিয়ে আসে তখনই পরিষদ সংশ্লিষ্টরা আন্দোলনে নেমে তাদের দাবি আদায় করে নেয়।
অথচ তারা নিজেরা দক্ষ হয় না। দুর্ঘটনা যাতে কমে, সড়কে যাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসে, মানুষ যাতে স্বস্তিতে চলাচল করতে পারে এমন সেবা দেওয়ার পক্ষে তাদের কোনো কার্যক্রম নেই।
রাষ্ট্রপতি যেহেতু আইনটি এখনও অনুমোদন দিয়ে সই করেননি, সেক্ষেত্রে একটি খটকা থেকেই যায়। এখন সরকার আইনটি বাস্তবায়ন করবে, না পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সংশোধন করবে তা সরকারের ব্যাপার।
Comments